কালীকথায় তিলোত্তমাঃ-
আজ
০২বৈশাখ,১৪২৭ বুধবার। গতকাল ছিল পয়লাবৈশাখ, বাংলা নববর্ষের সূচনা। ১৪২৬কে পিছনে রেখে আমরা এগিয়ে এলাম আরও একটি বছরের দিকে। এবছরের পয়লা বৈশাখের দিনটি বাঙালি একটু অন্যরকম ভাবেই কাটালো, কারণ এখন করোনা ভাইরাসের কারণে সবাই গৃহবন্দী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সকলেই এখন ঘরবন্দী থাকবেন এবং বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে সকলকে অনুরোধ আপনারা ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন। ট্রাডিশনাল হেরিটেজের পক্ষথেকে সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
তিলোত্তমা কলকাতার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আছে কলকাতার কালীমন্দিরগুলি। বহু ঐতিহাসিকদের মতে কালীঘাটের নামানুসারে এই 'কলকাতা' নামের উৎপত্তি, যদিও এ বিষয়ে বিতর্কও বর্তমান। যাই হোক ঘরবন্দী বাঙালিকে নববর্ষের সামান্য উপহার দিতেই আজ আমরা কলকাতার বেশকিছু কালীমন্দিরের টুকরো স্মৃতিকথা তুলে ধরবো। চলুন দেখা যাক সেই সমস্ত কালীমন্দিরের টুকরো ইতিহাস, লিখলেন শুভদীপ। সকলকে আবারও আমাদের অনুরোধ আপনারা বাড়িতে থাকুন এবং ভালো থাকুন, আর অবশ্যই বনেদীয়ানা'র সাথে থাকুন।
কালীতীর্থে তিলোত্তমাঃ- এ এক অন্যরকম নববর্ষ
কালীঘাট কালীমন্দিরঃ- প্রতিবছরই নববর্ষের দিনে কলকাতার বিভিন্ন কালীমন্দিরে ভীড় করেন ভক্তরা, কারণ তাদের একটাই প্রার্থনা সকলে যেন ভালো থাকেন এবং সুস্থ থাকেন। নববর্ষের আগের দিন থেকেই লম্বা লাইন দেখা যায় তিলোত্তমার বিভিন্ন কালীমন্দিরে। এবছরের চিত্রটা একটু আলাদা, এবছর নববর্ষের দিন বাঙালি বাড়িতে বসেই পালন করলো নিজেদের মতন করে। করোনা ভাইরাসের কারণে এখন সকলেই আতঙ্কিত, এবং প্রশাসনের নির্দেশে প্রত্যেকেই ঘরবন্দী। তিলোত্তমা যেন এক অন্যরকম মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল ১৪২৭এর নববর্ষে।
প্রতিবছরই নববর্ষের দিন ভীড়ে থিক্থিক্ করে কালীঘাট কালীমন্দির চত্বর, আগের দিন বিকাল থেকে লম্বা লাইন দেখা যায় মন্দিরচত্বরে। কালীঘাট কালীমন্দির তিলোত্তমার অন্যতম প্রাচীন মন্দির, এই মন্দিরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে বহু কাহিনী ও ইতিহাস। এই কালীঘাট ৫১সতীপীঠের অন্যতম এক পীঠস্থান বলেই প্রসিদ্ধ, দক্ষের যজ্ঞে সতী দেহ পরিত্যাগ করলে মহাদেব ক্রুদ্ধ হয়ে দক্ষের যজ্ঞ পণ্ড করেন এবং উন্মত্তের মতন নৃত্য করতে শুরু করেন। তখন জগত সংসারকে রক্ষা করতে বিষ্ণু তাঁর সুদর্শনচক্রের দ্বারা সতীর দেহ খণ্ড করেন। যে যে স্থানে সতীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রক্ষিপ্ত হয় সেই স্থানই পীঠস্থান হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। কালীঘাটে সতীর দক্ষিণ পদের চারটি আঙুল পড়েছিল, একান্নটি সতীপীঠের মধ্যে কালীঘাট একচল্লিশতম সতীপীঠ। কালীঘাট বহু প্রাচীন এক তীর্থস্থান। কিছু কিছু তথ্যের ভিত্তিতে এও প্রমানিত হয় কালীঘাট বা কালীঘট্ট বল্লাল সেন যুগেরও প্রাচীন।
প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী বর্তমান কালীঘাটের মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদার সন্তোষ রায় চৌধুরী, মন্দির তৈরি শেষ হয় ১৮০৯সালে। পূর্ণেন্দু পত্রী "ছড়ায় মোড়া কলকাতায়" লিখেছেন, এঁরা(সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারি) মধ্যেই কালীঘাট। বুড়িগঙ্গার তীরে এঁরাই কালীঘাটের মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। সামাজিক নিমে বাঁধে বলে এরা নিজেরা পুজো করতে পারেন না। তাই দূর দেশ থেকে ডেকে আনা হল হালদার গোষ্ঠীর ব্রাহ্মণদের। সেই থেকে এই মন্দিরে হালদাররাই সেবায়েত। এছাড়া মায়ের মন্দিরকে কেন্দ্র করে বহু প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। এককথায় কলকাতার ঐতিহ্যের সাথে কালীঘাট ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরঃ- কলকাতার ইতিহাসে বহু প্রাচীন পরিবার, বহু মহাপুরুষের আবির্ভাব জড়িয়ে রয়েছে। কলকাতার বনেদী পরিবারের অন্যতম হল জানবাজারের রানী রাসমণির পরিবার। রানী রাসমণির অবদান কলকাতায় অপরিসীম। তিনিই তৈরি করেছিলেন দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী কালীমন্দির। এই মন্দিরেও বহু মানুষের ভীড় দেখা যায় নববর্ষের আগের দিন, সকলে লাইন দিয়ে মায়ের কাছে পুজো দেন বছরের শুরুর দিনে। প্রতিবছরই নববর্ষের সকাল থেকেই মন্দিরচত্বরে থিক্থিক্ করে দর্শনার্থীদের ভীড়।
এই
মন্দিরের ইতিহাসও বহু প্রাচীন, রীতিনীতি ও ধারাবাহিকতাতে আজও সেই ধারা দেখা যায়। দক্ষিণেশ্বরের স্থানটি কূর্মপৃষ্ঠের মতন। এমন স্থানই শক্তিসাধনার উপযুক্ত। প্রায় ৬০বিঘা জমির ওপর এই মন্দির। দক্ষিণেশ্বরের নবরত্ন মন্দির বাংলার শিল্পকলার এক অপূর্ব নিদর্শন। মন্দিরের উচ্চতা একশো ফুট। মন্দিরের গর্ভগৃহে কালো পাথরের বেদীর ওপর রুপোর প্রস্ফুটিত শতদল। মা এখানে রাজবেশে সজ্জিতা, ত্রিনয়নী জ্যোতির্ময়ীরূপে বিরাজমানা। ভবতারিণী মন্দিরের উত্তরে রাধাকৃষ্ণের মন্দির, উল্টোদিকে সারি দিয়ে বারোটি শিবমন্দির। ১৮৫৫সালের ৩১মে স্নানযাত্রার দিন মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রানী রাসমণি স্নানযাত্রার দিন। প্রাচীন রীতি মেনেই পুজো হয় দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দিরে।
ঠনঠনিয়া কালীবাড়িঃ- তিলোত্তমার অন্যান্য কালীমন্দিরের মতনই ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতেও নববর্ষের দিন বহু ভক্তসমাগম ঘটে। ৩১৬বছরের আগে যে মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে সেই মূর্তি আজও বর্তমান। প্রত্যেক বছর কালীপুজোর আগে মায়ের অঙ্গরাগ করা হয়। নববর্ষের দিন বহু ভক্তরা মায়ের কাছে পুজো দিতে আসেন, কামনা করেন নতুন বছর যেন তাদের ভালো কাটে। আমাদের ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবও আসতেন এই মায়ের মন্দিরে, পুজো করতেন। এই ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শঁঙ্কর ঘোষ মহাশয়(১৭০৬সাল), কিন্তু মৃন্ময়ীকে প্রতিষ্ঠা করেন উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী ১৭০৩সালে। তখন এই ঠনঠনিয়া ছিল সুতানুটি মহাশ্মশান, সেই সময় উদয়নারায়ণ ব্রহ্মচারী মায়ের মৃন্ময়ী প্রতিমা, মায়ের ঘট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই মূর্তি ও দেবীঘট আজও বর্তমান।
টালিগঞ্জ করুনাময়ী কালীমন্দিরঃ- বঙ্গের কালীমন্দিরের মধ্যে অন্যতম মা করুণাময়ী, টালিগঞ্জে অবস্থিত। নববর্ষের দিন এই মন্দিরেও বহু ভক্তসমাগম হয়, হালখাতা করতে আসেন বহু দর্শনার্থী। মঙ্গল কামনা করতে আসেন মায়ের মন্দিরে যাতে তাদের পরিবার ভালো থাকেন। এই টালিগঞ্জের মা করুণাময়ী কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাবর্ণ গোত্রীয় নন্দদুলাল রায় চৌধুরী ১৭৬০সালে। এই মন্দিরের দেবী সপ্তমবর্ষীয়া, কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে প্রতিষ্ঠিত হন মা করুণাময়ী। টালিগঞ্জ করুনাময়ী কালীমন্দিরও ঐতিহ্যে অটুট, আজও নিষ্ঠার সাথে মায়ের পুজো হয়ে আসছে।
সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরঃ- বঙ্গের কালীমন্দিরের মধ্যে অন্যতম সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, উত্তরের গিন্নীমা বলে পরিচিত। নববর্ষের দিনও এই মন্দিরেও ভীড় কোনঅংশে কম হয় না। আনুমানিক ৫০০বছরের প্রাচীন এই মন্দির, কালীবর তপস্যী নামক জনৈক তপস্যী স্বপ্নাদেশে দেবী কালীর এই রূপ দেখেছিলেন। জমিদার কেদারেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের বংশধরগণ মায়ের সেবা করে থাকেন। ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব গিরিশ বাবুর আরোগ্যলাভের জন্য দেবী সিদ্ধেশ্বরীর কাছে ডাব-চিনি মানত করেছিলেন, ঠাকুরের সেই মানত সফল হয়েছিল। ঐতিহ্যে আজও অটুট উত্তরের গিন্নীমা মা সিদ্ধেশ্বরী।
লেককালীবাড়িঃ- দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম কালীমন্দির এই লেককালীবাড়ি। সারাবছরই ভক্তসমাগম হয়েই থাকে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে, নববর্ষের দিনও সেই দৃশ্যের পরিবর্তন দেখা যায় না। মা এখানেও করুণাময়ী দয়াময়ীরূপে বিরাজমানা। ১৯৪৯সালে শ্রীশ্রী হরিপদ চক্রবতী লেককালীবাড়িতে করুণাময়ী মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিন কলকাতার সাউদার্ণ এভিনিউ'র বিখ্যাত কালীবাড়ি বলেই পরিচিত। সকলেই ভক্তি সহকারে মায়ের পুজো দিতে আসেন এই লেককালীবাড়িতে।
ফিরিঙ্গি কালীবাড়িঃ- উত্তর কলকাতার জনপ্রিয় কালীমন্দিরের মধ্যে অন্যতম ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি। প্রথমথেকেই এই কালীবাড়ি ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি নামে পরিচিত ছিল না, এই মন্দির পরিচিত ছিল শিবমন্দির হিসাবে। ব্রিটিশ শাসনকালে অ্যন্টনী ফিরিঙ্গি সাহেব এই মন্দিরে এসেছিলেন এবং ঠিক করেছিলেন এখানে তিনি কালীমায়ের পুজো করবেন। তখন থেকেই অ্যন্টনী ফিরিঙ্গির নামানুসারে মন্দিরের নাম হয় ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি। দেশবিদেশ থেকে বহু ভক্তসমাগম হয় এই কালীবাড়িতে। নিত্যকালীপুজো ছাড়াও এই মন্দিরে ভীড় করেন দর্শনার্থীরা বাংলা নববর্ষের দিনও, তাদের মনোবাঞ্ছা পুরণের জন্য। কৃষ্ণবর্ণা মা সিদ্ধেশ্বরীকেই এখানে দেবী কালীরূপে পুজো করা হয়।
আদ্যাপীঠ কালীমন্দিরঃ- কলকাতার জনপ্রিয় কালীমন্দিরগুলির মধ্যে অন্যতম এই আদ্যাপীঠ। দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির যারা গিয়েছেন তারা এই আদ্যাপীঠ অবশ্যই গিয়েছেন এবং ভক্তিভরে মাকে পুজোও দিয়েছেন। মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীঅন্নদা ঠাকুর, তিনি নিয়ম তৈরি করেছিলেন যে দর্শনার্থীদের মায়ের মন্দিরে প্রবেশ করা যাবে না এমনকি মন্দির স্পর্শও করা যাবে না। এই প্রসঙ্গে অন্নদা ঠাকুর বলেছেন, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব স্বপ্নাদেশ দিয়ে তাঁকে এই আদ্যামায়ের মূর্তি তৈরির কথা বলেছিলেন। মন্দিরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে আরও অনেক অজানা ইতিহাস ও কাহিনী, পরে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
কেমন লাগল প্রতিবেদনটি? আরও কোন কোন কালীমন্দির নিয়ে জানতে চান আপনারা?? আমাদের ই-মেল করুন, আমরা চেষ্টা করবো সেই ইতিহাস তুলে ধরতে। আমাদের অন্যান্য ব্লগ ও ওয়ার্ডপ্রেস লিঙ্ক নীচে দেওয়া হল আপনারা ওখানেও আমাদের প্রতিবেদনগুলি পড়তে পারেন।
Email:
heritagetraditional@gmail.com
Blog Link: https://heritagetraditional.blogspot.com/
Wordpress Link: https://traitionalheritage.wordpress.com/
তথ্য লিপিবদ্ধেঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী
সাহায্যে- দেবযানী বসু ও সুরজিত সাহা
No comments:
Post a Comment