ঐতিহ্যপূর্ণ তিলোত্তমা'র স্মৃতিকথাঃ
বনেদীয়ানা পরিবার চেষ্টা করে কলকাতা এবং সমগ্র বঙ্গের বেশকিছু ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে। তিলোত্তমার গতপর্বে আলোচনা করেছিলাম স্মরণিকা ট্রাম মিউজিয়ামের কথা, এই পর্বে আলোচনা করলাম রাইটার্স বিল্ডিং'এর টুকরো ইতিহাস, লিখলেন শুভদীপ। বনেদীয়ানা পরিবার কৃতজ্ঞতাস্বীকার করল শ্রী অশোক কুমার রায় মহাশয়ের কাছে, তার লেখা বই 'ঠিকানা কলকাতা; ঐতিহ্যের ঘরবাড়ি' এর সামান্য কিছু অংশই তুলে ধরা হল এই প্রতিবেদনে। রাইটার্স বিল্ডিং সম্পর্কে আপনাদেরও কিছু তথ্য জানা রয়েছে। আমরা চাই সেই তথ্য আপনারা এই প্রতিবেদনের কমেন্টে অথবা মেলের মাধ্যমে আমাদের জানান আমরা চেষ্টা করবো সকলের তথ্যের ঐতিহাসিক ভিত্তি দেখে এক পর্বে সমগ্র রাইটার্স বিল্ডিং'এর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করতে।
তিলোত্তমার আর কোন কোন ঐতিহ্য আপনারা জানতে চান?? আর কোন কোন বাড়ির ইতিহাস জানতে চান আমাদের জানান আমরা তুলে ধরবো সেই ইতিহাস। আপনারা সকলে বাড়িতে থাকুন, সুস্থ থাকুন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী'র সকল নির্দেশিকা মেনে চলুন এবং তাদের সহযোগিতা করুন। চলুন দেখা যাক সেই টুকরো স্মৃতিকথা।
স্মৃতির ইতিহাসে রাইটার্স বিল্ডিংঃ- কলকাতা
রবার্ট ক্লাইভের বিজয় অভিযানের পর থেকে কলকাতার নিস্তরঙ্গ তটরেখামূলে আঘাত করেছে বিবর্তনের অজস্র ঢেউ। শ্বাপদসংকুল জঙ্গলাকীর্ণ কলকাতার আঁধার তপস্যা খানখান হয়ে ভেঙে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের আলোকবাহী সাম্রাজ্য পিপাসুর সৃজন উল্লাসে। রাইটার্স বিল্ডিং- অফুরন্ত মর্যাদার আত্মসমাহিত যেন। কিন্তু বাড়িটার এতবড় কৌলীন্য মর্যাদা কতদিনের? সেই সুদূর কাল থেকে এই অট্টালিকার যেমন ঘটেছে বাহ্যিক সংস্কার তেমনি ভেতরের ইতিহাসও বদলেছে বারবার।
কম্পানির আমলে জুনিয়ার সিভিলিয়ান কর্মচারীদের 'রাইটার' নামে বলা হত। আরও ভালো ভাবে বলতে গেলে রাইটার বলতে কম্পানির কেরানীদের বলা হত। গোড়ার দিকে বড় বড় কর্মচারীরা ব্যবসা বুঝতেন। সামরিক শিক্ষাও ছিল তাদের, কিন্তু লেখাপড়ায় সুপণ্ডিত তা বলা যায় না। তাই হিসাবপত্র রাখার জন্য কেরানিদের রাখা হত। কিন্তু তাদের আয়ত্তে রাখা মুশকিল হয়েছিল, তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজে তাদের তত্ত্বাবধান শুরু করে ও বসত বাড়ি নির্মাণ করে। যেহেতু কেরানিরা থাকবে তাই বাড়িটার নাম 'রাইটার্স'। অবশ্য রাইটার্স বিল্ডিং'এর সূচনা অনেক আগে। যখন জোব চার্নক তার চারজন লোক নিয়ে কলকাতায় পদার্পণ করার তিনদিনের মধ্যে বললেন রাইটারদের জন্য মাটি এবং খড় দিয়ে ঘর তৈরি হবে(১৬৯০খ্রীঃ,১৬ই আগস্ট)। দ্বিতীয়ত রাইটার্স এর সূচনা প্রাচীন ফোর্ট উইলিয়াম সংলগ্ন কোন এক স্থানে। বর্তমান জিপিও এবং ফেয়ারলি প্লেসস্থ পূর্বরেল দপ্তরের মধ্যবর্তী কোন স্থানে।
১৭৫৬ সাল সিরাজদৌল্লা আচমকা কলকাতা বিধস্ত করে গেলেন। এর পর পুরানো দুর্গের জন্য ব্যয় বাড়ানো হয়। কলকাতা দখলের পর দপ্তরের কাজ বেড়ে যাওয়ায় রাইটার্স বিল্ডিং'এর ভূখণ্ড খালি পড়েছিল দেখে রাইটারদের জন্য পাকা বসতবাড়ি নির্মাণকল্পে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জমি পাট্টা দিলেন টমাস লায়নকে(১৭৭৬সালে,১৮ই নভেম্বর)। দুই খণ্ডে জমির পরিমান ১৬বিঘা ১৭কাঠা ৮ছটাক। ওই পাকা দালানের নির্মাতা হিসাবে টমাস লায়নের পরিচিতি আছে বিল্ডিং'এর পেছনে 'লায়নস্ রেঞ্জ' পথের নামে।১৭৭৭সালের মধ্যে নতুনবাড়ি দখল করলেন রাইটাররা, কাজ শেষ হল ১৭৮০এর পর। সেই বছরই এই সম্পত্তি হস্তান্তরিত হল হেস্টিংস কাউন্সিলের অন্যতম সদস্যের হাতে। বলা বাহুল্য সেই বিল্ডিং'এর সাথে এই দালানের কোন সম্পর্ক নেই।
পাশাপাশি ১৬টি ঘর, বারান্দা ও দুই প্রান্তে কাঠের চওড়া সিড়ি, লায়নস্ রেঞ্জের দিকে করিডোর দিয়ে সংযুক্ত টয়লেট। এই ছিল প্রথম অবস্থা, এরপর ইংরেজ আমলে পরিবর্তন হয় পুরানো কাঠামোর, বিশাল আকারের রূপান্তরিত হয়। ১৭৭০-৮০এর এই বিল্ডিং সেকালের কলকাতার এক অন্যতম প্রসাদ-সৌধ।
১৭৮৯এর উইলিয়াম হকি তার 'গেজেটে' লিখেছেন, রাইটার্স বিল্ডিং কলকাতার প্রথম তিনতলা অট্টালিক। এতকাল এ দেখতে ছিল আয়ারহাউসের মতন। ক্রমশ এর আমূল পরিবর্তন ঘটে, ১৮২১ পর্যন্ত সুন্দর ব্যালকনি দেখা দিল সামনের দিকে। মাঝখানের অংশ কিছুকাল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ছিল, সেখানে রাইটাররা পড়াশুনা করত। একতলায় ক্লাস, দোতালায় চারটি ঘর নিয়ে লাইব্রেরী আর তিনতলায় পরীক্ষার ঘর। আশেপাশের অংশে থাকতেন ২২জন রাইটার ছাত্র। শুধুমাত্র অবিবাহিত ছাত্রদের জন্য এই ব্যবস্থা, বিবাহিত কর্মচারী এখানে থাকতে পারতেন না।
সেদিনের ডালহৌসি স্কোয়ার ও তার আশেপাশের দৃশ্য আজ আর কল্পনাও করা যাবে না। একদিকে আদি গির্জা, অন্যদিকে মারহাট্টা ডিচ পরিবেষ্টিত প্রাচীন দুর্গ। অদূরে ছিল অট্টালিকার কেন্দ্রে সেদিনের থিয়েটার হল, ইংরেজদের একমাত্র আনন্দ নিকেতন।
লালদিঘি-কাছের ও দূরের মানুষের একমাত্র বেড়াবার স্থান। রাইটার্সের মর্যাদা বেড়েছে কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ ঘুচে গেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ১৮২০-২২ রাইটার্সের বর্তমান রূপায়ন।
প্রথম পরিবর্তন, লর্ড বেন্টিঙ্কের সময়। নতুন ব্যবস্থায় চলে গেলেন রাইটাররা, শিক্ষা বন্ধ হল। বিশাল সৌধ খালি পড়ে থাকল কিছু কাল। পরে সরকার ভাড়া দিলেন ব্যবসায়ীদের। এই ভাবে চলল ৪১বছর। ১৮৭৭ স্যার অ্যাসলির সময় সরকারি তরফ থেকে পুনরুদ্ধার করা হল। মার্টিনের হাতে দিলেন সংস্কারের ভার। ১৮৮০ বাড়ির গায়ে পোড়ামাটির রঙের প্রলেপ, খোদাই করা হল নানান মূর্তি। দেখা গেল কোরিন্থীয় ধাঁচের চেহারা। সেই কৃত্তিম স্তম্ভগুলির ওপর ত্রিকোনী চূড়া। এসবের মধ্যে ফুটে উঠল ভিক্টোরীয় রাজশক্তির এক নাগরিক দম্ভ।
বলাবাহুল্য কলকাতার ঐতিহ্যময় স্থানের মধ্যে অন্যতম এই রাইটার্স বিল্ডিং, বহু ঐতিহাসিক বহু তথ্যই তুলে ধরেছেন। আমরা চেষ্টা করলাম এই বিল্ডিং'এর কিছু স্মৃতিকথা তুলে ধরতে শ্রী অশোক কুমার রায়'এর রচনা থেকে। আপনাদের কাছেও যদি এই রাইটার্স বিল্ডিং সম্পর্কিত তথ্য থেকে থাকে তাহলে আমাদের কমেন্টে জানান, এবং সকলে সমৃদ্ধ হোক এই ইতিহাস জেনে।
সকলকে আবারও অনুরোধ আপনারা বাড়িতে থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং সরকারের সকল নির্দেশিকা মেনে চলুন। ট্রাডিশানাল হেরিটেজ টিম'এর অন্যান্য ব্লগ ও ওয়েব লিঙ্ক দেওয়া হল আপনারা ওখানে গিয়েও প্রতিবেদন দেখতে পারেন। সকলে ভালো থাকুন।
তথ্য সংগ্রহেঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- 'ঠিকানা কলকাতা:ঐতিহ্যের ঘরবাড়ি'-অশোক কুমার রায়
চিত্রঃ- সংগৃহীত
Email:
heritagetraditional@gmail.com
Blog Link:
https://heritagetraditional.blogspot.com/
https://heritagewestbengal.blogspot.com/
Wordpress
Link: https://traitionalheritage.wordpress.com/
No comments:
Post a Comment