ঐতিহ্যের শহর কল্লোলিনী তিলোত্তমাঃ
কলকাতা এমন একটি শহর যার ইতিহাস, যার ঐতিহ্য এবং ব্যাপ্তি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত।
১৪৯৫ খ্রীঃ বিপ্রদাস পিপ্পলাই প্রথম তাঁর 'মনসামঙ্গল' কাব্যে কলিকাতার উল্লেখ করেছিলেন। পরে কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম 'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যে এবং আবুল ফজলের 'আইন-ই-আকবরিতে'ও কলিকাতার কথা পাওয়া যায়। ১৬৬০ খ্রীঃ Van Dan Brouke-এর তৈরি ম্যাপেও কলিকাতার উল্লেখ আছে। এছাড়াও গুরমুখী ভাষাতে উল্লেখ আছে যে ১৫১০ খ্রীঃ নানক কালীক্ষেত্র দর্শনে এসে কলিকাতায় কিছুদিন বসবাস করেন। প্রসঙ্গত আমরা একটি প্রচলিত কথা শুনে থাকি যে 'কলিকাতা-গোবিন্দপুর এবং সুতানুটি এই তিনটি গ্রাম নিয়ে কলকাতার উৎপত্তি', আসলে কলকাতা তিনটি নয় পঞ্চান্নটি গ্রাম নিয়ে তৈরি। অর্থাৎ বলা যেতে পারে এই পঞ্চান্নটি গ্রাম মূলত পঞ্চান্নটি গ্রামের তৌজি। এর আয়তন ২৬০বর্গমাইল। সীমা হল-উত্তরে বরানগর,পূর্বে দমদম, দক্ষিণে টালির নালা আর পশ্চিমে ভাগীরথী। বর্তমানে কলকাতর মধ্যে এই পঞ্চান্ন গ্রামের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হতে বসেছে।
কলকাতায় যেমন রয়েছে প্রাচীন মন্দির থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাচীন রাজপরিবার এবং জমিদারপরিবার ঠিক তেমনই রয়েছে বিভিন্ন স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের নিদর্শন। রয়েছে বিভিন্ন সংগ্রহশালা, যেখানে আজও গেলে মনে হবে ইতিহাস যেন কথা বলে, মনে হবে বহু পুরানো দিনের কথা-রয়েছে 'ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম', রয়েছে 'ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল', 'কলকাতা পুলিশ মিউজিয়াম', 'নেহেরু চিল্ডরেন্স মিউজিয়াম', 'স্টেট আরকিওলজিকাল মিউজিয়াম', আরও অনেক।
ঠিক সেই রকমই আজ আমরা এমন একটি মিউজিয়ামের কথা বলব যেখানে গেলে আপনি ফিরে যাবেন বেশ কিছু বছর আগে আর উপভোগ করবেন ইতিহাসের গন্ধ। 'স্মরণিকা'-ট্রাম মিউজিয়াম, কলকাতার ময়দান অঞ্চলে। এই মিউজিয়ামে Traditional Heritage Team পৌঁছে গিয়েছিল ইতিহাসের সন্ধানে, সেই মিউজিয়াম সম্পর্কেই আজ প্রতিবেদন প্রকাশিত হল, লিখলেন আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক শুভদীপ। চলুন দেখা যাক সেই মিউজিয়ামের কিছু কথা আর ফিরে যাওয়া যাক কিছু বছর আগে, ইতিহাসের গন্ধ পেতে।
আপনাদের আমাদের তরফ থেকে অনুরোধ বাড়িতে থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং প্রশাসনের সাথে সম্পূর্ণভাবে সহযোগিতা করুন।
স্মরণিকা-ট্রাম মিউজিয়ামঃ- ইতিহাসের হাতছানি
কলকাতার প্রাচীন ঐতিহ্যের মধ্যে এক অন্যতম বিষয় ট্রামব্যবস্থা। সেই ট্রামের উৎপত্তি বা তার বিকাশ দেখতে হলে আপনাকে খোঁজ রাখতে হবে ইতিহাসের পাতায় এবং পৌঁছে যেতে হবে 'স্মরণিকা ট্রাম মিউজিয়াম'এ। তবুও ট্রামের ইতিহাস পড়লে দেখা যাবে, এটি মূলত একটি যাত্রীবাহী যান, যদিও অনেক ক্ষেত্রে পণ্য পরিবহনেও ট্রামকে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন দেশে ট্রাম বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন- ট্রামকার, ট্রলি, ট্রলিকার, স্ট্রিটকার ইত্যাদি। সিলেসিয়ান ইন্টারআরবানস্ ও মেলবার্ণের ট্রাম নেটওয়ার্ককে বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম ট্রাম নেটওয়ার্ক বলে উল্লেখ করা হয়। বলাবাহুল্য ট্রাম একটি বহুল পরিচিত যান। বর্তমান পৃথিবীতে ৪৩টি দেশের ৩০০টিরও বেশী শহরে ট্রাম চলে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য দুইটি শহর হল- ১। ভারতবর্ষের অন্তর্গত কলকাতা এবং ২। অস্ট্রেলীয়ার অন্তর্গত মেলবার্ণ।
প্রসঙ্গত এই দুই মহাদেশের দুই ভাষাভাষি
ভিন্ন সংস্কৃতির দুই শহরকে বেঁধে রেখেছে এই ট্রাম ব্যবস্থা। ট্রাম সংস্কৃতির আদান প্রদান দুই শহরের মানুষের উদ্দ্যোগে- ১৯৭৬,১৯৯৭,২০০০,২০০১,২০০২,২০১২,২০১৩,২০১৪ সেই ইতিহাসও পাওয়া যাবে এই ট্রাম মিউজিয়ামে।
এই স্মরণিকা ট্রাম মিউজিয়াম তৈরি করা হয় ১৯৩৮সালে। মূলত এটি কাঠের তৈরি 'স্ট্রিমলাইনড্ কার'। এই সংগ্রহশালা উদ্বোধন করা হয় ২০১৪সালে। এখানে রয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিক উপাদান। যেমন বিভিন্ন সময়কার ব্যবহৃত টুপি [১৯০২ সালে ড্রাইভার, কনডাকটরস্ এবং সিনিয়ার পদাধিকিরীদের ব্যবহৃত টুপি]। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন সময়কার পরিচয় চিহ্ন বা ব্যাজ [১৯০৫সালের ব্যাজ, যা ইনসপেক্টর, সিনিয়ার ইনসপেক্টররা ব্যবহার করতেন]। রয়েছে বিভিন্ন সময়ের মুদ্রা, কারণ মুদ্রা ও ট্রামের টিকিট অতঃপ্রত ভাবে জড়িত এই ট্রাম ঐতিহ্যের সাথে। এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন টিকিট, পাস ও কুপন, যেমন- ৪পয়সা ছাড় টোকেন, ১০পয়সা ছাড় টোকেন, সারাদিনের টিকিটের নিদর্শন, ১৯৭৪সালের মাসিক টিকিট, ১৯৭১সালের মাসিক টিকিটের নিদর্শন, ১৯৮৬সালের মাসিক টিকিট, এছাড়াও রয়েছে ট্রাম কর্মীদের ক্যান্টিনের কুপন। ট্রাম মিউজিয়ামে রয়েছে 'মুদ্রা বিনিময় যন্ত্র' অর্থাৎ ট্রাম কন্ডাক্টরের ব্যবহৃত বিশেষ প্রকারের বিনিময় যন্ত্র, প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট মূল্যের মুদ্রা বেরিয়ে আসত এই যন্ত্র থেকে, যখন কন্ডাক্টররা বিশেষ বোতামে চাপ দিতো নির্দিষ্ট মূল্যের মুদ্রা জন্য। স্মরণিকা'য় রয়েছে ১৮৭৩ সাল থেকে আজ অবধি নানা টিকিট ও মুদ্রা ব্যবহার হয়েছে তার নিদর্শন, ১আনা পয়সা, ২আনা পয়সা, কানা পয়সা ইত্যাদি।
অর্থাৎ আপনি এই স্মরণিকা ট্রাম মিউজিয়ামে গেলে নিজেই হারিয়ে যাবেন ইতিহাসের গন্ধে আর উপভোগ করবেন অতীতের। আমরা চেষ্টা করলাম সামান্য কিছু তথ্য দিয়ে মিউজিয়ামের বর্ণনা করতে। আপনাদের কাছে আবরও অনুরোধ বাড়িতে থাকুন এবং সুস্থ থাকুন। আপনি বাড়িতে থাকলে এই ভাইরাসকে আমরা খুব সহজেই পরাজিত করতে পারবো। ট্রাম মিউজিয়ামের বর্ণনা কেমন লাগল জানাবেন আর কোন কোন ইতিহাসের খোঁজ পেতে চান বলবেন আমাদের ই-মেলে। আমরা চেষ্টা করবো সেই ইতিহাস তুলে ধরতে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
তথ্য লিপিবদ্ধেঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment