প্রাচীন দুই মন্দির দক্ষিণ কলকাতায়ঃ
গত প্রতিবেদনে আমরা প্রকাশ করেছি কলকাতার বেশকিছু প্রাচীন কালীমন্দিরের কথা এবং নববর্ষে সেই মন্দিরের কিছু কথা। এই পর্বে আমরা দক্ষিণ কলকাতার দুই মন্দিরের কথা উল্লেখ করবো, একটি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বোড়ালে শ্রীশ্রী ত্রিঁপুরাসুন্দরী মন্দির এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার রাজপুরে শ্রীশ্রী বিপত্তারিণী চণ্ডীবাড়ির কথা, লিখলেন শুভদীপ।
বলাবাহুল্য এই দুই মন্দিরের ইতিহাস বা দুই মন্দিরের উৎসবকে কেন্দ্র করে বহু ভক্তসমাগম হয়, আমরা আজ এই প্রতিবেদনে সেই মন্দিরের কিছু স্মৃতিকথাই জানবো। কেমন লাগল জানাবেন অবশ্যই। আবারও আপনাদের অনুরোধ করছি আপনারা সকলে বাড়িতে থাকুন, সুস্থ থাকুন। প্রশাসনের সকল নির্দেশিকা মেনে চলুন। দেখা যাক দুই মন্দিরের ইতিহাস।
ঐতিহ্যময় শ্রীশ্রী ত্রিঁপুরাসুন্দরী মন্দির এবং রাজপুর শ্রীশ্রী বিপত্তারিণী চণ্ডীবাড়িঃ- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
শ্রীশ্রী ত্রিঁপুরাসুন্দরী জয়তুঃ-
'বালার্কমন্ডলাভাসাং চতুর্বাহুং ত্রিলোচনাম্।
পাশাঙ্কুশশরাংশ্চাপং ধারয়ন্তীং শিবাং শ্রয়ে।।'
অর্থাৎ নবোদিত সূর্যমণ্ডলের ন্যায় যাঁর চারটি বাহু, তিনটি নয়ন এবং চারি হস্তে পাশ, অঙ্কুশ শর ও ধনুক ধারন করিয়া আছেনঃ সেই শিবাকে আমি ভজনা করি। বোড়ালের শ্রীশ্রী ত্রিঁপুরাসুন্দরী মন্দির বহু পুরানো এবং সেই সঙ্গে ঐতিহাসিক স্থান। মন্দিরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে বহু ঐতিহ্যময় নিদর্শন, যেমন সেনস্তূপ খননকালে প্রাপ্ত প্রস্তোরোৎকৃত ভগ্ন শিব মুখমণ্ডল ও শায়িত শিব, মন্দির পার্শ্ববর্তী স্তূপ খনন কালে প্রাপ্ত হরিণের শিং, অঙ্গারীভূত সূঁদরী গাছের কান্ড, প্রস্তরীভূত হস্তীর কঙ্কাল আরও ঐতিহাসিক নিদর্শন। এই মন্দিরের ইতিহাসও বহু প্রাচীন, চলুন দেখা যাক।
'জবাকুসুমসঙ্কাশং দাড়িমীকুসুমোপমাম্।
চন্দ্ররেখাং জটাজুটাং ত্রিনেত্রাং রক্তবাসসীম্।।
নানালঙ্কার সুভগাং পীনোন্নতঘনস্তনীম্।
পাশাঙ্কুশ বরাভীং ধারয়ন্তীং
শ্রয়ে।।'
ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বৈদিক যুগ থেকে যে সমস্ত মহাশক্তিমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে এক প্রসিদ্ধ পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে তা কলকাতার অন্তর্গত গড়িয়ার নিকটবর্ত্তী সুপ্রাচীন বোড়াল গ্রামে তন্ত্রোক্ত দশমহাবিদ্যার অন্তর্গত তৃতীয়া মহাবিদ্যা ষোড়শী ও ত্রিপুরসুন্দরী দেবীর মূর্ত্তি ভারতের তীর্থ-জগতে এক উচ্চস্থান অধিকার করে আছে। তন্ত্রে দুটি নামের উল্লেখ রয়েছে, একটি নাম ত্রিপুরসুন্দরী এবং অপরটি ত্রিপুরা সুন্দরী। প্রথম নাম ত্রিপুরসুন্দরীই প্রধানা। এই ত্রিপুরসুন্দরীই বোড়াল গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। দেবীর দ্বিতীয় নাম হল ত্রিপুরাসুন্দরী। এই দ্বিতীয় নামের উদ্ভব হল যখন দেবী প্রবল পরাক্রমশালী ত্রিপুরা নামক অসুরকে নিধন করলেন তখন।
এই
দেবীর ভৈরব শ্রীশ্রী পঞ্চানন দেব। এই পীঠে ইনি পশ্চিম দিকে সেন দীঘির পশ্চিম কূলে অবস্থান করছেন। এই ত্রিঁপুরসুন্দরী দেবীর প্রাচীন মন্দিরের স্তূপ খনন করে দেখা যায় যে মন্দির ভিত্তির বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ধরণের কারুকার্য ইট এবং গাঁথুনির বিভিন্ন প্রকার কৌশল রয়েছে। মূল মন্দিরের সংস্কার হয়েছে তবুও এই মন্দিরের স্তূপ ও পার্শ্ববর্তী স্থান খননকালে খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের নানা প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন থেকে শুরু করে মৌর্য, কুশাণ, গুপ্ত, পাল ও সেনরাজাদের আমলে বহু পোড়া মাটির মাতৃকামূর্ত্তি, যক্ষমূর্ত্তি, খণ্ডিত শিবমূর্ত্তি, বিষ্ণুমূর্ত্তি, উৎকীর্ণ বৃহদাকার শিলা, তারামূর্ত্তি, কালীমূর্ত্তি, নানাধরনের তৈজস পত্রাদি, মাটির মাল্যদানা ইত্যাদি পাওয়া গিয়েছে।এখনও সেনস্তূপ খননকালে প্রাপ্ত প্রস্তোরোৎকৃত ভগ্ন শিব মুখমন্ডল ও শায়িত শিব, হরিণের শিং, অঙ্গারীভূত সূঁদরী গাছের কান্ড, প্রস্তরীভূত হস্তীর কঙ্কাল ইত্যাদি রয়েছে। কথায় কথায় জানা গেল বোড়াল গ্রামের এই শ্রীশ্রী ত্রিঁপুরসুন্দরী দেবী পৌরাণিক বাহান্ন পীঠের অন্তর্গত। কথিত আছে, কালীঘাটে ভাগীরথীর পূর্বকূলে দেবীর দক্ষিণ চরণের অঙ্গুলি এবং বোড়াল গ্রামে, ভাগীরথীর পশ্চিমকূলে দেবীর অঙ্গুলিবিহীন বাম করতালু পতিত হয়েছিল। এককালে এই দেবীর মন্দিরের পূর্ব সীমা দিয়ে অদিগঙ্গা ভাগীরথী প্রবাহিতা ছিলেন। “গঙ্গার পশ্চিম কূল বারাণসী সমতুল”। এই দেবীর মন্দিরও ঐ পশ্চিমকূলেই অবস্থিত ছিল। সেই সময় উক্ত ভাগীরথীর কূলে গড়িয়ায় এবং এই দেবীর নিকটবর্ত্তী স্থানে বন্দর ছিল। ছোটো জাহাজ ও নৌকা এই বন্দরে আসত।
পাল, সেন যুগে রাজাদের আমলে এবং তার পরবর্তীকালেও নবদ্বীপের গঙ্গা থেকে জাহাজ ও নৌকা ভাসিয়ে গড়িয়া, বোড়াল প্রভৃতি অঞ্চলের বন্দরগুলি অতিক্রম করে সওদাগররা তমলুকের প্রধান বন্দরে যেতেন। শ্রীশ্রী ত্রিঁপুরসুন্দরী দেবীর উক্ত পুরাতথ্যসমূহ ও বোড়াল গ্রামের প্রাচীন ইতিহাস বহু ঐতিহাসিক কর্তৃক সমর্থিতও হয়েছে। ত্রিপুরা দেবীর ভৈরবী মূর্তিও বহুলখ্যাত। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে প্রায় তিন শত বছরের পুরোনো যদুনাথের ধর্মপুরাণের গ্রাম্যদেবতার বন্দনায় বোড়ালের দেবীকে ভৈরবী বলা হয়েছে। এই চৈতন্য ভৈরবীর ধ্যানটি হল
“উদ্যদ্ভানু সহস্রভাং নানালঙ্কারভূষিতাম্।
মুকুটাগ্রলসর্চ্চন্দ্রিরেখাং রক্তাধরাষ্ঠিতাম্।।
পাশাঙ্কুশধরাং নিত্যাং বামহস্ত কপালিনীম্।
বরদাভয়শোভাঢ্যাং পীনোন্নতঘটস্তনীম্।।”
অর্থাৎ উদীয়মান সহস্র সূর্য্যের মত যার দেহকান্তি, সর্বাঙ্গ নানা অলংকারে শোভিত, মস্তকে মুকুট-মুকুটোপরি চন্দ্রকণা, পরিধানে রক্তবস্ত্র, বামহস্তে পাশাঙ্কুশ ও নরকপাল এবং দক্ষিণহস্তদ্বয়ে বর ও অভয়, যাঁর স্তনযুগল পীন ও উন্নত ও ঘন(সেই দেবীকে ধ্যান করি) ভুবনেশ্বরী ভৈরবীর পূজামন্ত্র চৈতন্য ভৈরবীরই অনুরূপ।
তবে ইহার ধ্যান পৃথক-
“জবাকুসুমসঙ্কাশং দাড়িমীকুসমোপমাম্।
চন্দ্ররেখাং জটাজুটাং ত্রিনেত্রাং রক্তবাসসীম।
নানালঙ্কার সুভগাং পীনোন্নতঘটস্তনীম্।
পাশাঙ্কুশ বরাভীং ধারয়ন্তীং শিবাং শ্রয়ে।।”
অর্থাৎ জবাফুল দাড়িম্বফুলের মতন যাঁর বর্ণ রক্তবর্ণ, যাঁর মস্তকে চন্দ্রকণা ও জটাজুট, যাঁর তিনটি চক্ষু, পরিধানে রক্তবস্ত্র ও অঙ্গে বিবিধ ভূষণ, যাঁর স্তনদ্বয় স্থূল উন্নত ও ঘন এবং হস্তে পাশ, অঙ্কুশ, বর ও অভয় ধারণ করে আছেন, সেই শিবা দেবীকে প্রণাম।
ত্রিপুরা দেবীর আর একটা রূপ “সুন্দরী” রূপ। তাঁকে বলা হয় ত্রিপুরসুন্দরী। এটি শ্রীবিদ্যারও রূপ। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে তাঁর পূজা প্রশস্ত। কাশ্মীরের তন্ত্রাচার্যদের কাছে এই মূর্তিই সমাদর। শঙ্করাচার্যের “সৌন্দর্য লহরী” গ্রন্থে এই সুন্দরীর রূপই প্রাধান্য পেয়েছে। প্রায় এক হাজার বছর আগে ভগবান শঙ্করাচার্য দেবী ত্রিঁপুরসুন্দরীর মূর্ত্তি দর্শন করে যে স্তোত্র পাঠ করেছিলেন তার কিছুটা অংশই-
-:ত্রিঁপুরসুন্দরী স্তোত্রম:-
“কদম্ববন চারিণীং মুনিকদম্বকাদম্বিনীং
নিতস্বজিতভূধরাং সুরনিতস্বিনীসেবিতাম্।
নাবাম্বুরুহ-লোচনামভিনবাম্বুদশ্যামলাম্
ত্রিলোচন-কুটুম্বিনীং ত্রিপুর সুন্দরীমাশ্রয়ে…।।”
শ্রীশ্রী ত্রিঁপুরসুন্দরী দেবীর পীঠস্থান কিছু কারণে দীর্ঘকাল জনশূণ্য হয়ে থাকে। পরে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে শ্রী জগদীশ ঘোষ নামে পূর্ব্ববঙ্গের এক ধনাঢ্য জমিদার নৌকাযোগে তীর্থ ভ্রমণ করতে এসে মা ত্রিঁপুরসুন্দরী পীঠস্থানে আসেন এবং দেবীর নির্দেশেই তিনি তার পিতৃশ্রাদ্ধাদি সম্পন্ন করেন। তিনি লক্ষ করেন এই ত্রিঁপুরসুন্দরীর মন্দিরের সংস্কার প্রয়োজন। তাই তৎকালীন মুসলমান সুবেদারদিগের কাছ থেকে বোড়াল গ্রামে জঙ্গল কেটে গ্রামের শ্রীবৃদ্ধি করেন। তিনি গ্রামে ব্রাহ্মণ, কুলীন, কায়স্থ, ধোপা, নাপিত, কুম্ভকার ইত্যাদি মানুষের ভূসম্পত্তি দান করেন এবং তাদের স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা করেন। তিনি দেবী ত্রিঁপুরসুন্দরীর নিত্য পূজার্চনার ব্যবস্থা করেন। তাঁর সঙ্গে বড়িশার প্রতাপশালী জমিদার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের এবং ভূকৈলাসের রাজবংশীয়গণের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি বড়িশা ও বোড়াল গ্রামের সহিত ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করেন এবং বড়িশার স্বনামধন্য জমিদার বংশ সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের জমিদারগণকে শ্রীশ্রী ত্রিঁপুরসুন্দরী দেবীর সেবাকার্যে অনুপ্রাণিত করেন।
মন্দিরের যিনি পুরোহিত তিনি এবং তাঁর পিতা এই মন্দিরের পুরোহিত, নিত্যপূজা তিনি করেন। কথায় কথায় জানতে পারলাম আগে পূজা করতেন শ্রী পশুপতিনাথ মুখোপাধ্যায়, তারপর পূজা করতেন শ্রী গুনিপদনাথ মুখোপাধ্যায়, এই গুনিপদনাথ মুখোপাধ্যায় ২০১৭সালে দেহত্যাগ করেন। তারপর থেকে তিনি এবং তাঁর পিতা পূজা করেন। দেবীর বুধবারে বিশেষ পূজা হয়। প্রতিদিনই অন্নভোগ দেওয়া হয়। অন্নভোগে থাকে ভাত, ডাল, ভাজা, তরকারি, পায়েস ইত্যাদি। রীতিনীতি মেনেই পূজা হয়। বিশেষ বিশেষ তিথিতে বহু ভক্তের সমাগম হয়। বুধবারে বহুমানুষ তাদের গ্রহদোষ কাটাতে এই দেবীপীঠে আসেন। বাৎসরিক পূজাতে চণ্ডীপাঠ, হোমযজ্ঞ ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়।
দুর্গাপুজোর ১৫দিন এই শ্রীশ্রী ত্রিঁপুরসুন্দরী দেবীর মন্দিরে একপক্ষে সকালে মঙ্গলারতি হয়। এবং প্রতিদিনই নাটমন্দিরে কীর্তন, ভক্তিগীতি এবং গীতাপাঠ হয়। বিশেষ পূজার দিন সকাল ৯টায় শুরু হয় চণ্ডীপাঠ।
এই
ত্রিঁপুরসুন্দরী দেবীর পীঠস্থানে বহু সাধক সিদ্ধিলাভ করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম সুপ্রসিদ্ধ সাধক শ্রীমৎ স্বামী শিবচৈতন্য গিরি। সাম্প্রতিককালে দেবীর সাধনা করেন শ্রীমৎ স্বামী হরানন্দ সরস্বতী ও জগতগুরু শঙ্করাচার্য্য ১১০৮ শ্রীমৎস্বরূপানন্দ গিরি।
তৎকালীন অর্থাৎ ১৩২৫সালে ভূমি জরিপের সময় শ্রী হীরালাল ঘোষ ও ঠাকুর বসন্ত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ত্রিপুরসুন্দরী দেবীর সমস্ত ভূসম্পত্তির সেবাইত রূপে রেকর্ড হয়। ফরতাবাদ ও অন্যান্য স্থানের সম্পত্তিগুলি তদ্বিরের অভাবে বেদখল হয়। তদানুসারে সেই আইনের বলে উক্ত দুইজন ট্রাস্টি ১৩৪১সালে এক সাধারণ সভায় ৭জন ব্যক্তিকে নিয়ে একটি সর্ব্বসম্মত ট্রাস্ট বোর্ড গঠন করা হয়। এই কমিটির মারফত দেবীপীঠের উন্নতিমূলক সেবাকার্য হয়। বিশেষ করে প্রায় চার হাজার টাকা খরচ করে দেবীর মাটির মূর্তির বদলে অষ্টধাতুর মূর্তি নির্ম্মিত হয়। নবনির্ম্মিতদেবী বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হয় ২৩শে মাঘ,১৩৪১সাল, শুক্লা তৃতীয়ার দিন, শ্রী পঞ্চমী বা সরস্বতী পূজার দুইদিন আগে। এই ট্রাস্ট বোর্ড গঠন হলে দেবীর পীঠে বহুকালের প্রচলিত পশুবলি বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ফল পাকুড়ও বলি দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
এই
ট্রাস্ট বোর্ডের দীর্ঘদিন ব্যাপী অক্লান্ত চেষ্টার ফলে
একটি সুবৃহৎ মন্দির নির্মিত হয়েছে। এই মন্দির নয়টি চূড়া বিশিষ্ট মন্দির অর্থাৎ বলা যায় নবরত্ন মন্দির। উচ্চতা প্রায় ৫২ফুট। এই মন্দিরের সম্পূর্ণ নক্সা করেছেন মার্টিন এন্ড বার্ণ কোং এর ইঞ্জিনিয়ার ঢাকুরিয়া নিবাসী শ্রী সরোজ কুমার চট্টোপাধ্যায়। এই মন্দির ও নাটমন্দির নির্ম্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় একলক্ষ টাকা এবং সময় লেগেছে প্রায় এক বৎসর কাল। এই মন্দির সংলগ্ন একটি সংগ্রহশালাও রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন সময়ের খনন কার্যে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক উপাদান রয়েছে। এছাড়াও একটি বৃহদায়তন তীর্থযাত্রী নিবাসও তৈরী হয়েছে।
প্রতিবছর মাঘ মাসের শুক্লা তিতীয়া থেকে পঞ্চমী পর্যন্ত সাড়ম্বরে দেবীর বাৎসরিক পূজা হয়। এই পূজা উপলক্ষে যজ্ঞ, চণ্ডীপাঠ, কীর্তনাদি, নরনারায়ণ সেবা হয়। গবেষণায় সঙ্গে ছিলেন শ্রীমান্ সৌমজিৎ মাইতি এবং শ্রীমান্ সায়ন সেনগুপ্ত
পথনির্দেশঃ হাওড়া স্টেশন থেকে নাকতলা-হরিনাভি মিনিবাস এবং সরকারি ৫/৬নং বাস যোগে গড়িয়া বাসস্ট্যান্ড বা মেট্রোরেলে কবি নজরুল স্টেশন থেকে বোড়াল রক্ষিতের মোড় অটোরিক্সায় বোড়াল হাইস্কুল বা বেলতলা স্টপেজে নামলেই এই পীঠস্থানে আসা সম্ভব।
শ্রীশ্রী বিপত্তারিণী চণ্ডীকায়ৈঃ নমঃ-
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার অন্তর্গত রাজপুরে অবস্থিত শ্রীশ্রী বিপত্তারিণী চণ্ডীবাড়ি, যা সমগ্র বঙ্গদেশে পরিচিত মা চণ্ডীর বাড়ি হিসাবে। বহু ভক্তসমাগম ঘটে এই মন্দিরে, হয় নিত্য পূজাপাঠ। মন্দিরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে এক আধ্যাত্মিক কাহিনী, সেই কাহিনীর কিছু অংশ আজ বর্ণনা করলাম, দেখা যাক সেই ইতিহাস।
'জয় জয় দেবী চণ্ডীর জয়।
জয় বিপত্তারিণী চণ্ডীর জয়।।
জয় জয় দেবী চণ্ডীর জয়।
জয় সিংহবাহিনী চণ্ডীর জয়।।'
“দুর্গান্ শিবান্ শান্তিকরিং ব্রহ্মাণী ব্রহ্মণ্যপ্রিয়াং সর্ব্বলোকঃ প্রণেতিঞ্চ প্রণমামি সদাশিবাম্। মঙ্গলাং শোভনাং শুদ্ধাং নিষ্কলাং পরমাঙ্কলাং বিশ্বেশ্বরীং বিশ্বমাতাং চণ্ডিকাং প্রণমাম্যহম।।”
বিপত্তারিণী চণ্ডী বাড়ির ইতিহাস শুরুতেই শ্রী গোকুল ঘোষের উক্তিই মনে আসে-
“রাজপুর ধামে বিপত্তারিণী নামে,
স্থাপিলে চণ্ডীরে,
করি কোলাহল বসিয়া সকল
সেই সুধা-সাগরের তীরে।
দেহো গো সু-জ্ঞান হে মহারাজন
আমাসম মূঢ় জনে,
তোমারি কথন করিয়া যতন
জানাব বিশ্বজনে।।”
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে ২৪পরগণা জেলার অন্তর্গত রাজপুর গ্রাম। কলিকাতা নগরীর শিয়ালদহ সাউথ স্টেশন থেকে ২৪পরগণার বিভিন্ন গ্রামে বা শহরে ট্রেনযোগে আসা যায়। ট্রেন পথে সোনারপুর স্টেশনে নেমে রাজপুর আসা যায়। রাজপুর গ্রামে অধিকাংশ বর্দ্ধিষ্ণু ব্রাহ্মণ পরিবারের বসবাস। তারমধ্যেই কিছু মাহিষ্য পরিবার অতি সজ্জন ও সাধু। এই পরিবারের নিতাইচাঁদ দাশ মহাশয় অতি সাধু ব্যক্তি ছিলেন। দেবদ্বিজে ছিল তাঁহার অগাধ ভক্তি। নিঁতাইচাঁদ দাশ ও অঁপর্ণা দাসীর একমাত্র পুত্র সাঁধন চন্দ্র দাশ। সাধন চন্দ্র দাশের স্ত্রী বসন্তকুমারী দেবী অতীব নিষ্ঠাবতী কন্যা। তাঁদের মোট সাতটি সন্তানাদি হয়। পুত্রসন্তান তিনটি এবং কন্যাসন্তান চারটি। জ্যেষ্ঠপুত্র দুলালকে গর্ভে ধারন করে তিনি হয়েছিলেন রত্নগর্ভা। বাংলা ১৩২৩ সালের কার্ত্তিক সংক্রান্তি বুধবার সকাল ৬টায় বসন্তকুমারী প্রসব করলেন এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। বৈষ্ণবগণ পথে মহাপ্রভুর গান গাইতে গাইতে চলছিলেন। নবজাত শিশু ভূমিষ্ঠ হলেন এবং বৈষ্ণবগণ গান গাইতে গাইতে প্রবেশ করলেন গৃহে-
“নন্দ দুলাল এলো নন্দ দুলাল।
ব্রজের গোপাল এলো ব্রজের রাখাল।।”
নবজাতকের নাম কেউ দিলেন “নন্দদুলাল” আবার কেউ বললেন “দুলাল”। গঠন বৈশিষ্ট্যে অতিব সুন্দর তাঁহার মুখখানি। নবজলধর শ্যাম করলেন স্পর্শ বাংলার মাটি। ধন্য হল এই মাটি।জগন্মাতা দক্ষিণা কালিকা নতুন রূপে নতুন ভাবে আবির্ভূতা হলেন দুলালের সামনে। শিবোপরি দিগম্বরী করালবদনা মুণ্ডমালিনী আজ হলেন সিংহবাহিনী মহাশূল ধারিণী। নাম তাঁর বিপত্তারিণী চণ্ডী। দক্ষিণা কালিকা আজ আবির্ভূতা হলেন মা চঁণ্ডী রূপে। জগতে যখনই অশুভের প্রভাব বেড়েছে সেই অশুভকে নাশ করতে মা ধরাধামে অবতীর্ণা হলেন বিপত্তারিণী চণ্ডী নামে। দুলালের গৃহে মা বিরাজ করলেন ভক্তদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে। বহু দূর দূরান্ত থেকে ভক্ত আসত দুলালের বাড়িতে মায়ের দর্শণে। খুব ছোট্টো স্থানেই চণ্ডীমাতাকে রেখেছিলেন তিনি, ভক্তরা অপেক্ষা করতেন কখন মায়ের দর্শণ তারা পাবেন।
আষাঢ় মাস। বাংলা ১৩৩৪ সাল। জগন্নাথদেবের রথযাত্রার আর বিশেষ দেরীও নেই। রথযাত্রা উৎসবের মধ্যে পঞ্জিকায় শ্রীশ্রী বিঁপত্তারিনী দুর্গামাতার ব্রতের কথাও উল্লেখ আছে। কিন্তু ভক্তরা একটা সংকটে পরলেন যে পঞ্জিকায় শ্রীশ্রী বিঁপত্তারিনী চণ্ডীমাতার উল্লেখ নেই। আগ্রহী ভক্তরা তখন বসন্তকুমারী দেবীকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন এই বিষয়ে সাহায্য করেন। তখন বসন্তকুমারী দেবী তাঁর পুত্রকে নির্দেশ দিলেন চণ্ডীমাতার থেকে ব্রতের সমস্ত বিধি ব্যবস্থা ও রীতিনীতি জানার জন্য। দুলাল বাবা বারবার মায়ের কাছে বলেন-“দেখ্ মা, পাড়ার দিদিমা, ঠাকুমা, জেঠিমারা বলছেন যে তোর নাকি বিপত্তারিণী ব্রত আছে। ঐ ব্রত পূজার রীতিনীতি তারা জানতে চায়।”
এইভাবে দশ দিন কেটে গেল। তারপর একদিন বালক দুলাল বসে আছেন নিজের ঘরে চৌকিতে তখন মা আলোকিত করে এলেন তাঁর কাছে। তিনি আনন্দিত হয়ে প্রণাম করলেন দেবীকে আর তখন বালিকারূপিণী চণ্ডীমাতা তাঁকে বিপত্তারিণীর ব্রতের কথা বলতে লাগলেন-
“আষাঢ়স্য শুক্লপক্ষে দ্বিতীয়ার পর
এই ব্রত আচরিবে দশমী ভিতর।
পূর্বদিনে নিরামিশ্য খাবে একবার
এই ব্রত করিবে শুধু মঙ্গলবার।।
ত্রয়োদশ গ্রন্থিযুক্ত রক্তবর্ণ ডোরে-
নরনারী সবে ধর দক্ষিণ করে।।”
এছাড়াও তিনি আরও বললেন- তের রকমের ফল আমার ষোড়শোপচারে দেবে। ষোলো আনার পরিবর্তে ষোল পয়সা নেবে। ডোরের নিমিত্ত চার পয়সা আর দক্ষিণা বাবদ চার পয়সা। দক্ষিণা ছাড়া ব্রতীর ব্রত পূর্ণ হয় না, তাই দক্ষিণা গ্রহন করো। গরীবের জন্যই আমি এসেছি, তারা সহজ সাধ্য মতন তাহাদের মনোস্কামনা পূরণের জন্যই আমার এই আদেশ।
এইভাবে চণ্ডীমাতা জানিয়ে গেলেন বিপত্তারিণী ব্রতের রীতিনীতি। বালক দুলাল সমস্ত কথা ভক্তদের বলে দিলেন যা তাঁকে স্বয়ং মা বলেছেন। বাংলার ১৩৩৪ সালে বিপত্তারিণী চণ্ডীব্রত আরাম্ভ হয় এবং তা আজও প্রচলিত এই চণ্ডী বাড়িতে। বর্তমানে মাত্র ৩৫পয়সায় ব্রতাদি সম্পন্ন হয়। প্রচলিত বিধিমতে শ্রীশ্রী বিঁপত্তারিনী দুর্গাব্রতের কথা উল্লেখ পাওয়া যায় কিন্তু শ্রীশ্রী বিঁপত্তারিনী চণ্ডীব্রতের উল্লেখ নেই। এইরূপে অপ্রচলিত বিপত্তারিণী চণ্ডীব্রত পণ্ডিতমহলকে বিচলিত করে কিন্তু বালক দুলাল তাতে বিন্দুমাত্র বিচলত ছিলেন না, কারণ দেবী তাঁকে স্বয়ং নিজে বলেছেন ব্রতের সমস্ত নিয়ম। কড়াপাক সন্দেশ বালক দুলালের প্রিয় আর চণ্ডীমাতার প্রিয় কাঁচাগোল্লা।
আজ রাজপুরের চণ্ডী বাড়ি বঙ্গের প্রাচীন মন্দিরের এক অন্যতম মন্দির। বহু ভক্তের কাছে আজ এক তীর্থস্থান এই বিপত্তারিণী বাড়ি। মায়ের বিগ্রহ ছাড়াও রয়েছে দেবী দুর্গার বিগ্রহ, রয়েছে বিভিন্ন দেবদেবীর বিগ্রহ, রয়েছে সাধক দুলাল বাবার মূর্তি, এবং তাঁর ব্যবহৃত জিনিসের সংগ্রহশালা। রয়েছে রত্নবেদী এবং ভক্তদের পূজা দেবার জন্য সমস্ত ধরনের উপকরণের দোকান। বিপত্তারিণী ব্রতের দিন বহু ভক্তের সমাগম ঘটে এই চণ্ডীবাড়িতে। মায়ের কাছে সবার একটাই প্রার্থনা সবাইকে ভালো রেখো মা।
রত্নবেদীঃ- এটি বাবা দুলালের সাধন পীঠ, স্থাপিত বাংলার ১৩৪০ সাল। সিদ্ধ মহাপুরুষগণ যাঁরা শক্তি সাধনার দ্বারা ঈশ্বরের স্বরূপ দর্শণে ব্রতী হন তাঁরা তন্ত্রমতে পঞ্চমূণ্ডের আসন স্থাপন করেন এবং তাতে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন। কিশোর দুলাল জগন্মাতার স্বরূপ দর্শণে ব্রতী হয়ে পঞ্চমূণ্ডের আসনের জন্য নরমুণ্ড সংগ্রহ করতে থাকেন। তাঁর গর্ভধারিণী মা এই সংবাদ পেয়ে তাকে বিরত করেন এবং বলেন এমন আসন তৈরি করো যাতে সকলের বসার অধিকার থাকে। তারপর দুলাল বাবা শ্রী শ্রী চঁণ্ডীমাতার নির্দেশে বিভিন্ন রত্নদ্বারা বিল্ব বৃক্ষ মূলে যে আসন তৈরি করেন তাহাই এই রত্নবেদী। এই রত্নবেদী বাবা দুলালের সিদ্ধাসন। এখানেই তিনদিন তিনরাত্রি সাধনা করে তিনি মায়ের দর্শণ পান ও সিদ্ধিলাভ করেন।
বাবা দুলালের সংগ্রহশালাঃ- এই সংগ্রহশালায় রয়েছে চাকীবেলুন, রয়েছে কাঁসার বাটি, রয়েছে খড়ম, নাড়িকেল মালার কমণ্ডলু যা বাবাকে ১৩বছর রয়েসে শ্মশানে জনৈক এক সাধু উপহার দিয়েছেন, রয়েছে পিতলের ঘটি ইত্যাদি নানান রকমের জিনিস। এছাড়া ১৯৭০ সালের চণ্ডীমাতা ও বাবা দুলালের চিত্র, পুরোনো নাটমন্দিরের চিত্র, ১৯৭৫ সালে নতুন নাটমন্দিরে মায়ের বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার চিত্র, পুরোনো নাটমন্দিরে বিপত্তারিণী ব্রতের দিন তোলা ছবি ইত্যাদি।
আজ তাই বনেদীয়ানা পরিবারও এই প্রার্থনা জানিয়ে এলেন মায়ের কাছে।
“জয় জয় দেবী চণ্ডীর জয়
জয় বিপদতারিণী চণ্ডীর জয়।।
তোমার শরণাগত আমি মাগো হই।
তোমার প্রসাদে মাগো রক্ষা যেন পাই।।
বার বার তাই মাগো প্রণাম জানাই।
রক্ষা কর রক্ষা কর আর কেহ নাই।।”
তথ্য লিপিবদ্ধেঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- ‘ত্রিঁপুরসুন্দরী মন্দির’: শ্রী রথীন্দ্রনাথ সিংহ(সম্পাদক),
শ্রী প্রকাশচন্দ্র রায়(পুরোহিত), শ্রীশ্রী ত্রিঁপুরসুন্দরী সেবা সমিতি, শ্রীমতী সুনিতি
সাহা(মন্দিরের সাথে যুক্ত)। ‘বিপত্তারিণী চণ্ডী বাড়ি’: “বাবা
দুলাল”(প্রথম
খণ্ড)- শ্রী পুলিনবিহারী আঢ্য
No comments:
Post a Comment