আজ
১৯চৈত্র ১৪২৬, শুক্লানবমীতিথি, আজ এই পুণ্যতিথি রামনবমী নামে বিশেষ পরিচিত সমগ্র বঙ্গ তথা ভারতে। ভগবান শ্রীবিষ্ণুর সপ্তম অবতার ছিলেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র। ভারতবর্ষে এই পুণ্যতিথির মাহাত্ম্য বহুপ্রাচীন, চৈত্র মাসের নবরাত্রীর সময় নবমীতিথিতে এই উৎসব পালন করা হয় মহাসমারহে এবং নিষ্ঠার সাথে। ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং অধর্মকে বিনাশ করতে রঘুকুলপতি ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের আবির্ভাব হয়েছিল। তাঁর শ্রীচরণে আমাদের শতকোটি প্রণাম ও শ্রদ্ধা জানাই। সকলকে আবারও অনুরোধ আপনারা বাড়িতে থাকুন, করোনা ভাইরাসের সাথে মোকাবিলা করতে হলে প্রতিটি ভারতবাসীকে বাড়িতে থাকতে হবে- এটাই সবথেকে উল্লেখযোগ্য পথ। সকলে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্যসরকারের সাথে সহযোগিতা করুন, ভালো থাকুন এবং সুস্থ থাকুন।
আজ
রামনবমীর পুণ্যতিথিতে বনেদীয়ানা পরিবার প্রকাশ করল কলকাতার স্বনামধন্য পরিবার জানবাজারের মাড়বাড়ি, অর্থাৎ করুণাময়ী তথা মা-জগদম্বার অষ্টসখীর অন্যতমা লোকমাতা রানী রাসমনির বাড়ির কুলদেবতা শ্রীশ্রীরঘুনাথ জীউ'এর সম্পর্কিত সামান্য তথ্য এবং উৎসব বর্ণনা, লিখলেন শুভদীপ। কেমন লাগল প্রতিবেদনটি জানাবেন এবং সঙ্গে থাকুন আমাদের।
রানী রাসমনির বাড়ির শ্রীশ্রীরঘুনাথ জীউঃ- রামনবমী
অবতারবরিষ্ঠ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছিলেন, 'রানী রাসমণি শ্রীশ্রীজগদম্বার অষ্টনায়িকার একজন। ধরাধামে তাঁহার পূজা প্রচারের জন্যই আসিয়াছিলেন।' উত্তর চব্বিশ পরগনার কুমারহট্ট হালিশহর, অতিপ্রাচীন স্থান। এই কুমারহট্ট হালিশহরেই সাধক রামপ্রসাদের সাধনপীঠ, শ্রীশ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর গুরু শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী(সাবর্ণ গোত্রীয়)র জন্মস্থান, যেখানে মহাপ্রভু নিজে এসে প্রেমরসে কীর্তনানন্দে মগ্ন হয়েছিলেন এবং তাঁর গুরুদেবের জন্মস্থান থেকে মাটি তুলে তিলক ধারণের উদ্দেশ্যে কৌপীনে বেঁধে নিয়ে গিয়েছিলেন। 'চৈত্যডোবা' নামে সেই পবিত্র স্থানটি আজও বর্তমান। এই কুমারহট্ট হালিশহরই বিখ্যাত সাবর্ণদের কুলতিলকদের সমাজসংস্কারে আবার রানী রাসমনির জন্মস্থান হিসাবেও সমাধিক প্রসিদ্ধ। হালিশহর সংলগ্ন "কোনা" গ্রামে ১২০০বঙ্গাব্দের ১১আশ্বিন, বুধবার প্রাতঃকাল এক দরিদ্র মাহিষ্যবংশের বৈষ্ণব-দম্পতির গৃহে রাসমণি দেবীর জন্ম। প্রসঙ্গত এই মাহিষ্যবংশে জন্ম হওয়ায় তৎকালীন সমাজে রানী রাসমনি দেবীকে অনেক তাচ্ছিল্যতা সহ্য করতে হয়েছে। এই জাতপাতের ক্ষেত্রে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন, 'এক উপায়ে জাতিভেদ উঠে যেতে পারে। সে উপায়-ভক্তি। ভক্তির জাত নাই। ভক্তি হলেই দেহ, মন, আত্মা, সব শুদ্ধ হয়ে যায়।...ভক্তি না থাকলে ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ নয়। ভক্তি থাকলে চণ্ডাল, চণ্ডাল নয়।' এই বিষয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের উক্ত কথা, পরমভক্তিমতী, লোকমাতা রানী রাসমণি দেবী সম্পর্কেও বিশেষভাবে প্রযোজ্য, একথা বলা বাহুল্যমাত্র। রানী রাসমণি দেবীর সাথে কলকাতার এক প্রাচীন মাহিষ্যবংশীয় ধনাঢ্য জমিদার বাড়িতে বিবাহ হয়েছিল। স্বামীর নাম রাজচন্দ্র দাস। পরে তিনি "রায়" উপাধি পাওয়ায়, 'রায় রাজচন্দ্র দাস' নামে অবিহিত হতেন। রাসমণি দেবী ছিলেন রাজচন্দ্র দাসের তৃতীয়পক্ষের স্ত্রী। ১২১১বঙ্গাব্দের ৮ বৈশাখ যখন তাঁদের বিবাহ হয় তখন রাসমণি দেবীর বয়স মাত্র ১১বছর।
রানী রাসমণির জানবাজারের বাড়ির কুলদেবতা ছিলেন শ্রীশ্রীরঘুনাথ জীউ, সেই কুলদেবতার পূজা পালাক্রমে তাঁর বংশধরগণ সম্পাদন করতেন। কিন্তু ১৯৮৯ খ্রীঃ জুন মাস থেকে সেই কুলদেবতাকে দক্ষিণেশ্বরের রাধাকান্ত মন্দিরে রেখে পুজোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।.... প্রসঙ্গত একদিন বৈশাখ মাসের দুপুরে রাজচন্দ্র নিদ্রা যাওয়া সময় জনৈক সন্ন্যাসী অযাচিতভাবে তাঁর বাড়িতে গলদ্ঘর্ম অবস্থায় উপস্থিত হন। সন্ন্যাসীর দেহটি কৃশ হলেও বেশ উন্নত ও বলিষ্ঠ ছিল; পরিধানে গৈরিক বস্ত্র ও ধূলিমাখা নগ্নপদ। সন্ন্যাসী দেউড়িতে এসে দ্বারবানদের জানান যে, তিনি জমিদার রাজচন্দ্রবাবুর সাথে সাক্ষাৎ করতে চান। প্রথমে দ্বারবানরা তাঁকে প্রবেশ করতে না দিলে খুব বাকবিতণ্ডা হয়। অবশেষে সন্ন্যাসীর পীড়াপীড়িতে অন্দরমহলে রাজচন্দ্রের কাছে এই সংবাদ পাঠানো হয়। অতঃপর রাজচন্দ্র সন্ন্যাসীর সাথে সাক্ষাৎ করতে এলে তিনি বলেন, 'আমার কাছে রঘুনাথজিউ শিলা আছেন, আপনাকে দেব, আপনি তাঁর সেবা করবেন। আপনার মঙ্গল হবে। আমি বহুদূর তীর্থদর্শনে যাব; ফিরব কিনা সন্দেহ।' এরপর কিছু কথোপকথনের পর তিনি বাবু রাজচন্দ্রকে রঘুনাথজিউকে অর্পণ করেন। কিন্তু বিনিময়ে রাজচন্দ্র কিছু দেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করলেও সন্ন্যাসী সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সঙ্গে সঙ্গে বিদায় গ্রহণ করেন। এই রঘুনাথজিউকে রাজচন্দ্র বাড়ির অন্দরমহলের ঠাকুরঘরে প্রতিষ্ঠা করেন এবং রামচন্দ্রকে স্মরণে রেখে রাজচন্দ্র ঐ শিলাটির পাশে একটি রৌপনির্মিত হনুমান মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করেন। এই রঘুনাথ জীউ জানবাজারের মাহিষ্য জমিদার বংশের "কুলদেবতা", যাঁকে রানী রাসমণি একদা নিজের জীবন বিপন্ন করে গোরাদের আক্রমণের থেকে রক্ষা করেছিলেন।
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, কোন কোন গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, জনৈক সন্ন্যাসী একটি অর্ধহস্তপরিমাণ "বিষ্ণুমূর্তি" রাজচন্দ্রকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু শ্রদ্ধেয় আশুতোষ দাস মহাশয় বলেন, সেটি কোন মূর্তি ছিল না; সেটি ছিল একটি 'রামশিলা' যা 'রঘুনাথজিউ' নামে পরিচিত। রাসমণি দেবীর বাড়িতে রঘুনাথ জীউ থাকার জন্য দোল, রাস ও জন্মাষ্টমীর উৎসবগুলি নিয়মিতভাবে পালিত হত এবং প্রতিটি উৎসবে রাসমণি দেবী পুজো ছাড়াও দানধ্যান ও দরিদ্রনারায়ণ সেবায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন।
বর্তমানে দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরের পাশে বিষ্ণুমন্দিরে শ্রীশ্রীরঘুনাথ জীউ অবস্থান করছেন। মন্দিরটি পশ্চিমমুখী। সাতটি খিলানযুক্ত বারান্দা। একটি রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহও রয়েছে সেখানে। নিত্য সেবাপূজা হয় মন্দিরে। এখানে নিরামিষ ভোগের ব্যবস্থাও রয়েছে। স্নানযাত্রায় অর্থাৎ দেবালয় প্রতিষ্ঠা দিবসে, ঝুলন, জন্মাষ্টমী, রাস প্রভৃতি বিষ্ণু অর্চনার দিনগুলিতে এখানে বিশেষ পূজার ব্যবস্থা করা হয়। বলাবাহুল্য অতীতে রানী রাসমণির জানবাজারের বাড়িতে রঘুনাথ জীউ'এর দোলউৎসব এবং রথযাত্রা উৎসব মহাসমারহে পালিত হত। রাসমণি দেবী শক্তি আরাধনা করলেও মূলত তিনি পিতৃসূত্রে বৈষ্ণবভাবাপন্ন ছিলেন এবং শ্বশুরালয়েও 'রঘুনাথজিউ' পরবর্তীকালে গৃহদেবতা রূপে প্রতিষ্ঠিত হন। রাসমণিদেবীর স্বামী রাজচন্দ্র দাসের জীবদ্দশায় বাড়িতে দোল-দুর্গাপুজো হলেও রথযাত্রা হত না। স্বামীর মৃত্যুর পর রাসমণি দেবী রথযাত্রা উৎসব করতে এবং সেই রথে গৃহদেবতা শ্রীশ্রীরঘুনাথ জীউকে বসাতে মনস্থ করেন। ১৮৩৮ সালে রাসমণি দেবী প্রথম রথযাত্রা উপলক্ষে রথনির্মাণ করেন ও প্রতিষ্ঠা কার্যে সওয়া লক্ষ টাকা ব্যয় করেন এবং গৃহদেবতা রঘুনাথ জীউকে সেই রথে বসিয়ে মানসিক অভিলাষ পূর্ণ করেন।
বর্তমানে রানী রাসমণির দলিলের নির্দেশানুসারে রাধাকান্ত মন্দিরে(দক্ষিণেশ্বরের মায়ের মন্দির সংলগ্ন) পূজারির কাজে রাঢ়ীশ্রেণীর ব্রাহ্মণ নিযুক্ত আছেন। এছাড়া অতীতে জানবাজারের জমিদার বাড়িতেও ধুমধাম করে দোল উৎসব হত রঘুনাথ জীউকে কেন্দ্র করে। প্রাচীন ঐতিহ্য ও রীতিনীতিকে মেনে আজও রাধাকান্ত মন্দিরে সেবা পান রঘুনাথ জীউ। বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে রাসমণির পরিবারের সকল সদস্যদের জানাই রামনবমীর শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- 'রানী রাসমণির জীবনবৃত্তান্ত', শ্রী নির্মলকুমার রায়(কিছুঅংশ)
তথ্য লিপিবদ্ধেঃ- শ্রী শুভদীপ রায় চৌধুরী
চিত্রঋণঃ- শ্রীমতী মৌ কয়াল
No comments:
Post a Comment