Monday, February 10, 2020

ঐতিহ্যের চট্টোপাধ্যায় বাড়িঃ- জামুড়িয়ার ইকড়া

ঐতিহ্যের অন্নপূর্ণাপর্বঃ
 গত চারটি পর্বে আমরা বঙ্গের বেশকিছু অন্নপূর্ণা মন্দিরের ইতিহাস পুজোর রীতিনীতি নিয়ে প্রকাশ করেছি প্রতিবেদন আজ আবারও পঞ্চমপর্বে প্রকাশ করতে চলছি প্রায় ৩৫০বছরের প্রাচীন অন্নপূর্ণা পুজোর ইতিহাস, লিখলেন শুভদীপ
আজ বনেদীয়ানা প্রকাশ করল জামুড়িয়ার ইকড়া গ্রামের চট্টোপাধ্যায় বাড়ির পুজোর ইতিহাস চলুন দেখা যাক সেই বাড়ির রীতিনীতির কথা

ঐতিহ্যের চট্টোপাধ্যায় বাড়িঃ- জামুড়িয়ার ইকড়া
 আজ থেকে প্রায় ৩৫০বছর আগে জামুড়িয়ার ইকড়া গ্রামে বাস করতেন সহৃদয় ব্রাহ্মণ বিজয় গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায় মানুষের কল্যাণে উনি সবসময় এগিয়ে থাকতেন তিনি, তাই মা অন্নপূর্ণার কৃপাদৃষ্টি পড়লো বিজয় গোবিন্দ বাবুর ওপর দেবীর স্বপ্নাদেশ পেলেন তিনি, দেবী বললেন, 'তুই বাঁকুড়া জেলার সুশুনিয়া পাহাড়ে যা, গিয়ে দেখবি জলের মধ্যে আমি আছি, আমাকে নিয়ে আয়' বিজয় গোবিন্দ ছুটলেন পাহাড়ে গিয়ে দেখলেন প্রচুর মানুষ ভিড় জমিয়েছে সেই পুকুরের ধারে, সামনে গিয়ে দেখলেন এক ছোট্ট শিলা চরকির মতন ঘুরে বেড়াচ্ছে সারা পুকুরে, প্রচুর মানুষ তাকে ধরবার চেষ্টা করছে কিন্তু সেই শিলা কারোর হাতেই আসছেনা বিজয় গোবিন্দ কোনোকিছু না ভেবেই পুকুরের জলে দুহাত পাতলেন, তখনই শিলাখণ্ড বিজয়ের হাতে এলো, শান্ত হল এইভাবেই অভাবের সংসারে অন্নপূর্ণা রূপে পুজো পেতে লাগলেন দেবী অন্নপূর্ণা কালক্রমে বিজয় গোবিন্দ চট্টোপাধ্যায় যে ইংরেজের কোম্পানিতে চাকুরি করতেন, সেই কোম্পানির সহ আরও ৬টি কয়লা খনির মালিক হলেন আর হয়ে উঠলেন এক দানশীল জমিদার বর্ধমানের মহারাজের থেকে পেলেন 'রাজর্শি' উপাধি, কারণ জমিদার হলেও তিনি একজন সাধক এরপর দেবী বাসন্তী কৃপা করলেন বিজয়কে, সেও এক অনন্য ইতিহাস আজও দুই দেবীর পুজো মহাসমারহে পালন করা হয় এই পরিবারে
 যেহেতু বাসন্তীপুজোর অষ্টমীর দিনই অন্নপূর্ণা পুজো হয়, সেহেতু একসাথেই দুটি পুজো হয়ে থাকে ঠাকুরদালানে তিনদিন অনুষ্ঠিত হয় দেবীর যজ্ঞ একেই সাথে হয় মহাভোগের আয়োজন সবমিলিয়ে আভিজাত্য নিষ্ঠায় একটুও ভাটা পড়েনি চট্টোপাধ্যায় পরিবারের বংশধররা আজও নিষ্ঠার সাথে পুজো করে আসছেন সপ্তমীর দেবী বাসন্তীর নবপত্রিকা আসার পর পুজো শুরু হয়, সপ্তমীর ভোগে থাকে ভাত, ডাল, সাত রকমের ভাজা, চাটনি, পায়েস অষ্টমীর ভোগে থাকে লুচি, ভাজা ইত্যাদি নবমীর ভোগে থাকে পোলাও, ভাজা, তরকারি, পায়েস ইত্যাদি এই পরিবারে বলিদানপ্রথা আজও বর্তমান পরিবারের সদস্য ৫০০ছাড়িয়েছে, কিন্তু পুজোর সময় সবার একসাথে রান্না খাওয়া হয় চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজোয় কাজী নজরুল ইসলাম বহুবার এসেছিলেন, এসেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর এসেছিলেন চট্টোপাধ্যায় পরিবারের কুলগুরু শিবাবতার শ্রী শ্রীমৎ সাধক বামদেব

 চট্টোপাধ্যায় পরিবারের বাড়ির পুজোর ইতিহাস পর্বালোচনার পাশাপাশি একটি ঘটনাও উল্লেখ করা প্রয়োজন বিজয় গোবিন্দের ছেলে হৃষিকেশ চট্টোপাধ্যায় একবার হাওড়া থেকে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন, তখন প্লাটফর্মে এক সাধু হঠাৎ বলে উঠলেন, 'সামনের অমাবস্যায় তোর অপঘাতে মৃত্যু হবে, তবে তুই যদি কোন মহাসাধকের কাছে আশ্রয় নিস তবে নিস্তার পাবি' কিন্তু কাজের চাপে সেই কথা ভুলেই গেলেন হৃষিকেশ বাবু এরপর একদিন হৃষিকেশ চট্টোপাধ্যায় বাবা মায়ের ঔষধ আনতে তিনি পৌঁছে গেলেন তারাপীঠের পাশের এক গ্রামে, দেখতে দেখতে পথ হারিয়ে ফেললেন আর আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন আজ অমাবস্যা তখনই সেই সাধুর কথা মনে পড়ল তখন উনি ভাবলেন মৃত্যু যখন হবেই তখন মা তাঁরার কাছেই হোক এই ভাবেই তিনি চলেন গেলেন তারাপীঠের মহাশ্মশানে দেখলেন সাধকশ্রেষ্ঠ শ্রীবামদেব তাকে বলছেন, 'আয় এতক্ষণ তোরই অপক্ষায় ছিলাম' হৃষিকেশ বাবু এই কথা শুনে অবাক বামদেব বললেন, 'আজ এই পঞ্চমূণ্ডির আসনে তুই সাধনা করবি আমি এক গণ্ডী কেটে যাচ্ছি, যা কিছু হয়ে যাক এই বাইরে বেরোবি না আজ সারারাত তুই একা থাকেবি এই মহাশ্মশানে' এরপর এরপর হৃষিকেশ চট্টোপাধ্যায় বসলেন সাধনায় কালক্রমে ঘনিয়ে এলো সেই কালসর্প নানা ভূতপ্রেত তারা নানান ভাবে হৃষিকেশের সাধনা নষ্ট করবার চেষ্ট করল কিন্তু গণ্ডী ভেতরে কেউ আসতে পারল না এই ভাবে সকাল হল বামদেব এসে হৃষিকেশ চট্টোপাধ্যায়কে দীক্ষা দিলেন আর বললেন, 'আজ থেকে তোর পরিবারের কাউকে কোনদিন সাপ আর ভূত কিছু করবে না' এরপর সাধক শ্রীবামদেব বাবা তিনবার এসেছিলেন ইকড়া জমিদার বাড়িতে শেষবার এসে হৃষিকেশ বাবু গৃহে তাঁরা সাধনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন স্বয়ং তারাপীঠ ভৈরবের কাছে বামদেব শুনে বললেন,যে তাঁরা সেই জগদ্ধাত্রী, তাই বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো করতে একই সাথে তাঁর হাতের ত্রিশূলটি দিয়ে যান আর বলে গেলেন এই ত্রিশূলেই কালীপুজো করতে সেই থেকে ইকড়া জমিদার বাটীতে মা অন্নপূর্ণা আর বাসন্তীপুজো সহ কালীপুজো আর জগদ্ধাত্রীপুজো শুরু হল ধুমধামের সাথে
 তাই আজও এই প্রাচীন পুজোর রীতিনীতি আর আভিজাত্যে কোন ভাটা পড়েনি বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সকল সদস্যদের জানাই আগাম শুভেচ্ছা অভিনন্দন
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- শ্রী যুবরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়(পরিবারের অন্যতম সদস্য)
তথ্য লিপিবদ্ধেঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী


No comments:

Post a Comment