ঐতিহ্যের অন্নপূর্ণাপর্বঃ
গত তিনটি পর্বে আমরা তিন পরিবারের অন্নপূর্ণা পুজোর ইতিহাস ও রীতিনীতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ অন্নপূর্ণা পুজোর চতুর্থপর্ব আলোচনা করছি আপনাদের সাথে। বঙ্গের অন্যতম অন্নপূর্ণা মন্দিরের ইতিহাস ও পুজোর রীতিনীতি নিয়েই আমরা আলোচনা করবো আজকে।
আলোচনায় আজ শিবশক্তি অন্নপূর্ণা মন্দির ও দেবোত্তর এস্টেট, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রী জগদম্বাদেবী(১২ই এপ্রিল,১৮৭৫)। চলুন উত্তর চব্বিশ পরগনার ব্যারাকপুরের অন্নপূর্ণা মন্দিরের ইতিহাস জানা যাক। লিখলেন শুভদীপ।
ব্যারাকপুরের অন্নপূর্ণা মন্দিরঃ- ঐতিহ্যের
গতবছর বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে উপস্থিত ছিলেন শুভদীপ অন্নপূর্ণা পুজোর দিন। বনেদীয়ানা পরিবার কৃতজ্ঞতাস্বীকার করল শ্রী বিশ্বজিত বিশ্বাস (রাণী রাসমনি পরিবারের বংশধর), শ্রী অলোক কুমার বিশ্বাস (রাণী রাসমনি পরিবারের পঞ্চমপুরুষ) এর কাছে।
"আমি চানকে অন্নপূর্ণা প্রতিষ্ঠার সময় দ্বারিকাবাবুকে বলেছিলাম(১৮৭৪-৭৫) বড় দীঘিতে বড় মাছ আছে গভীর জলে। চার ফেল, সেই চারের গন্ধে ঐ বড় মাছ আসবে। এক একবার ঘাি দেবে। প্রেম ভক্তি রূপ চার।"- শ্রীশ্ররামকৃষ্ণ (কথামৃত, ৫ম ভাগ, দ্বাদশ খণ্ড, ৫ম পরিচ্ছেদ)
স্নেহধন্যা জগদম্বাদেবীর ঐকান্তিক আগ্রহে পরমহংস শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব চানকের এই অন্নপূর্ণা মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবসেই যে উপস্থিত ছিলেন তাই নয়, তাঁরই অনুমোদনক্রমে মথুর-জগদম্বার মনোবাঞ্ছা-মোতাবেক বিনির্মিত হয়েছে এই ঐতিহ্যমণ্ডিত মাতৃমন্দির। এই পুণ্যভূমিতে অবতারবরিষ্ঠ পদার্পণ করেছেন মোট চারবার। প্রথমবার এসেছিলেন জগদম্বাদেবীর বাসনায় জমি ক্রয়কালে উপস্থিত ছিলেন উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করতে। দ্বিতীয়বার এসেছিলেন তিনি এসেছিলেন ভিত স্থাপন উপলক্ষে। তৃতীয়বার এসেছিলেন মন্দির প্রতিষ্ঠার দিন, অর্থাৎ চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিনে। চতুর্থবার এসেছিলেন দেববিগ্রহ দর্শন করতে নৌকাযোগে। এই অন্নপূর্ণা মন্দিরের প্রাচীনত্ব ও আভিজাত্য বহুদিনের, ইতিহাস যেন কথা বলে এই মন্দির প্রাঙ্গণে দাঁড়ালে।
অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির প্রতিষ্ঠার ঠিক ২০বছর বাদে। মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাণি রাসমণির কনিষ্ঠা কন্যা ভক্তিমতী জগদম্বাদেবী। প্রায় লক্ষ মুদ্রা ব্যায়ে নির্মিত এই নবরত্ন মন্দির, ছয় শিবমন্দির, নহবতখানা, নাটমন্দির, স্নানঘাট এবং দপ্তরখানার ঘর। মন্দিরের অন্নপূর্ণা দেবী অষ্টধাতুর এবং বিগ্রহটি শ্রীশ্রীশিবশক্তি অন্নপূর্ণা ঠাকুরানী নামেই খ্যাত। রৌপশতদল আসীনা দেবীর একটি পদ নিচে ঝোলানো, বাম হাতে অন্নপাত্র এবং দেবীর ডান হাতে হাতা। মহাদেব দণ্ডায়মান, অন্নপ্রত্যাশী। এছাড়া যে ছয়টি শিবমন্দির রয়েছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে তাঁদের নাম যথাক্রমে- কল্যাণেশ্বর, কাম্বেশ্বর, কিন্নরেশ্বর, কেদারেশ্বর, কৈলাসেশ্বর এবং কপিলেশ্বর। প্রায় ১৪৫বছরের প্রাচীন মন্দিরের ঐতিহ্য এবং রীতিনীতি সত্যই প্রশংসার দাবী রাখে।
অন্নপূর্ণা পুজোর দিন বহু ভক্তসমাগম ঘটে এই মন্দিরে। মন্দিরে দেবী পুজো দিতে আসেন দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা, কেউ বহুবছর ধরেই এই দিনটিতে আসেন আবার কেউ প্রথমবার। পুজোর দিন সকাল থেকে দেবীর পুজো শুরু হয়, ভোগ নিবেদন করা হয় বিভিন্ন পদ রান্নাকরে। ভোগে থাকে পোলাও, লুচি, নানান রকমের তরকারি, ভাজা, পাঁচ রকমের মাছ, চাটনি, পায়েস ইত্যাদি। এই দিন অনুষ্ঠিত হয় অন্নকূট উৎসব, প্রায় একশো কেজি চালের অন্নকূট হয় ব্যারাকপুরের অন্নপূর্ণা মন্দিরে। মন্দির যারা পৌরহিত্য করেন তারা হলেন শ্রী তপন চক্রবর্তী, শ্রী জয়দেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং চুনার মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত থাকেন শ্রী জয়দেব বন্দ্যোপাধ্যায়। মন্দিরে চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীতিথি ছাড়াও প্রতিমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমীতে বিশেষ পুজো হয় মায়ের। এছাড়া মন্দিরে বিপত্তারিণী পুজো, জন্মাষ্টমী, দুর্গাপুজো, প্রতিষ্ঠা দিবস, কালীপুজো, অন্নকূট ইত্যাদি নানান পুজোও অনুষ্ঠিত হয় নিষ্ঠার সাথে। বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে মন্দিরের সকল সদস্যদের জানাই আগাম শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- শ্রী বিশ্বজিত বিশ্বাস, শ্রী অলোক কুমার বিশ্বাস, মন্দিরের সেবায়েতবৃন্দ এবং কল্যাণবাবু।
তথ্য লিপিবদ্ধেঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment