ঐতিহ্যের অন্নপূর্ণাপর্বঃ-
বিগত দুইটি পর্বে আমরা দুই পরিবারের অন্নপূর্ণা পুজোর কথা উল্লেখ করেছি, কেমন লাগল সেই দুই পুজোর রীতিনীতি ও কিছু চিত্র দেখে??? আর কোন কোন বাড়ির অন্নপূর্ণা পুজোর কথা জানতে চান? আমাদের এখুনি জানান আপনাদের মতামত ই-মেলের মাধ্যমে। আমরা চেষ্টা করবো পুজোর রীতিনীতি তুলে ধরার।
আজ আমরা অন্নপূর্ণাপর্বের তৃতীয়দিনে তুলে ধরবো বড়িশায় সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের অন্নপূর্ণা পুজোর কথা। সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের ঐতিহ্যপূর্ণ মন্দির সমূহ এবং বংশধরেরা বহু জায়গায় রয়েছেন, তারমধ্যে বড়িশায় তাদের প্রাচীন মন্দির রয়েছে মা অন্নপূর্ণার। চলুন দেখা যাক সেই মন্দিরের ইতিহাস ও পুজোর রীতিনীতি। লিখলেন শুভদীপ।
বড়িশার ঐতিহ্যবাহী অন্নপূর্ণা মন্দিরঃ- সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার
বড়িশা এক অত্যন্ত প্রাচীন জায়গা। আগেকার দিনের লোকেরা একে 'বঁড়শে' বা 'বোড়শে' বলে ডাকত। বহু জনশ্রুতি অনুযায়ী জানা যায়, এই জায়গাটি সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারীর 'বড় হিস্যা' ছিল। তার থেকেই নাম বড়িশা। ১৬০৮ সালে যখন লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় মুঘল সম্রাট নূর-উদ্-দিন জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে খেতাব ও জায়গীর লাভ করেছিলেন, তখন তিনি পিতৃভূমি হালিশহর ছাড়া কলকাতা ও বড়িশা গ্রামকে কুঠি ও কাছারি স্থাপনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার সমগ্র বাংলার সামাজিক ইতিহাসে এক বিশেষ ও স্বতন্ত্র স্থান অধিকার করে রয়েছে। খ্রীষ্টীয় দশম শতকে যখন বাংলার শাসনকর্তা মহারাজ আদিশূর কনৌজ থেকে পাঁচজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে রাঢ়-বঙ্গে নিয়ে আসেন তার মধ্যে সাবর্ণ পরিবারের আদিপুরুষ মহামতী বেদগর্ভ অন্যতম। কালীঘাটের সঙ্গে এই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা নিবিড় ও প্রাচীন। কালীঘাটের দেবী কালিকাই হলেন এই রায় চৌধুরী পরিবারের কুলদেবী।
এছাড়া বড়িশায় সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের বহু প্রাচীন মন্দির ও দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, সেই প্রাচীন মন্দিরের মধ্যে অন্যতম বড়িশার শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণা মাতাঠাকুরাণীর মন্দির। সাবর্ণ গোত্রীয় নন্দদুলাল রায় চৌধুরীর বড় ছেলে রাঘবেন্দ্র প্রথম ব্যক্তি যিনি 'বড়িশাধিপতি' খেতাব ব্যবহার শুরু করেন। রাঘবেন্দ্র'র একমাত্র সন্তান হলেন তারিণীচরণ, যিনি অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে বড় বাড়ির উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে এক বাজার বসান। আগে ছিল সাপ্তাহিক হাট, জমিদারের খেয়ালে বাজার ; তাই নাম হল 'সখের বাজার'। তারিণীচরণের মোট আটটি ছেলে। কিন্তু এঁদের মধ্যে শুধু রামকুমার, কালীকান্ত ও চন্দ্রকান্তের বংশ রক্ষা পেয়েছিল। চন্দ্রকান্ত রায় চৌধুরী দুবার বিবাহ করেছিলেন, কিন্তু বংশ রক্ষা না হওয়ায়, তিনি সাবর্ণ পাড়ার যদুনাথ রায় চৌধুরীর তৃতীয় পুত্র রাজেন্দ্রকুমারকে দত্তক নেন। রাজেন্দ্রকুমারের সাবালকত্ব অর্জনের পর বিবাহ হলে তাঁর হারাধন নামে এক ছেলে জন্মায়। কয়েক বছর পর সেও মারা গেলে চন্দ্রকান্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েন। তার ওপর তাঁর দুই স্ত্রী স্বামীর মৃত্যুর পুর কাশীবাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে চন্দ্রকান্ত রায় চৌধুরী আনুমানিক ১৮৫০-৬০ সাল নাগাদ তাঁর নবনির্মিত বাড়ির উঠোনে মা অন্নপূর্ণার এক পঞ্চরত্নের মন্দির ও জোড়া শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। চন্দ্রকান্ত রায় চৌধুরী প্রতিষ্ঠিত ৩০০ ভরি ওজনের সোনার অন্নপূর্ণা বিগ্রহ ১৯৫৬ সালে মন্দির থেকে চুরি হয়ে যায়। কিন্তু প্রায় ১মন ওজনের রজত-নির্মিত শিব বিগ্রহটি আজও বর্তমান।
১৯৫৬ সালে তাঁরাকুমার রায় চৌধুরীর বংশধরেরা জরাজীর্ণগ্রস্ত পুরানো মন্দিরটি সংস্কার করে সেখানে নতুন মন্দির নির্মাণ করেন ও অষ্টধাতুর অন্নপূর্ণি বিগ্রহ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। রায় চৌধুরী পরিবারের অন্নপূর্ণা মন্দিরের বয়স ১৭০বছর অতিক্রান্ত। আজও নিষ্ঠার সাথে মায়ের পুজো হয়। প্রতিবছরই শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণা মাতাঠাকুরাণীর বাৎসরিক পূজা মহাসমারহে অনুষ্ঠিত হয় বড় বাড়ীতে। সকালে মঙ্গলারতি হয়। তারপর অন্নপূর্ণা পূজা হয় বহু ভক্তের সমাগম ঘটে এই মন্দিরে। কলকাতা শহরে এমন প্রাচীন মন্দির খুবই বিরল। অন্নপূর্ণা পূজার দিন দেবীকে দশ রকমের মাছ, দশ রকমের তরকারি, সাদাভাত, পোলাও, খিঁচুড়ি, পায়েস, দই, নানান রকমের মিষ্টান্ন প্রদান করা হয়। রায় চৌধুরী পরিবারে সেইদিন মন্দিরে অন্নকূট উৎসব অনুষ্ঠিত হয়, প্রায় একশো কেজি চালের অন্নকূট হয় পূজার দিন। এছাড়া বলিদানের প্রথাও রয়েছে এই পরিবারে। রাত্রে নিত্য-গীত-বাদ্যাদি রাগসেবা হয় মন্দিরে। এছাড়া শ্রীশ্রীদেবীমাহাত্ম্য পাঠ ও ১০৮দীপদান প্রথাও রয়েছে সাবর্ণ পরিবারে।
বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে রায় চৌধুরী পরিবারের সদস্যদের জন্য রইল আগাম শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- 'বড়বাড়ি'-ডঃ প্রবাল রায় চৌধুরী মহাশয়
তথ্য লিপিবদ্ধেঃ- শুভদীপ
No comments:
Post a Comment