আজ
২৩শে মাঘ,১৪২৬ অর্থাৎ মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশী তিথি। এই পুণ্যতিথির মাহাত্ম্য অনেক, যা কোন ভাষাতেই বর্ণনা করা সম্ভব নয়, কারণ আজই আবির্ভূত হয়েছিলেন শ্রীশ্রী নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর। তাঁর শ্রীচরণে আমাদের শতকোটি প্রণাম জানাই। এই বিশেষ তিথিতে আমরা শ্রীমৎ নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর কিছু কাহিনী বর্ণনা করতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করছি, কারণ তাঁদের লীলাকথা বর্ণনা করা এক সৌভাগ্যের ব্যাপার। লীলাকথার কিছু অংশ একত্রিত করে শুধুমাত্র লিপিবদ্ধ করলেন বনেদীয়ানা'র শুভদীপ।
২০১৯সালের রাসের মহোৎসব চলাকালীন বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে শুভদীপ উপস্থিত ছিলেন খড়দহের শ্রীশ্রীশ্যামসুন্দর জীউর মন্দির সহ শ্রীশ্রী নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর বাসস্থান সংলগ্ন মন্দিরে। সাহায্য করেছিলেন শ্রী সরোজেন্দ্রমোহন গোস্বামী(নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর বংশধর) এবং শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর জীউের মন্দিরের কোষাধ্যক্ষ শ্রী দেবমাল্য গোস্বামী মহাশয়। সেই প্রতিবেদনেরও লিঙ্ক দেওয়া হল আপনাদের আরও কিছুটা সমৃদ্ধ করবার জন্য আজকের এই পুণ্যতিথিতে।
https://www.facebook.com/Heritagetraditional/posts/2502338446669468?__tn__=K-R
শ্রীশ্রীনিত্যানন্দ মহাপ্রভুর আবির্ভাব- শুক্লা ত্রয়োদশী
"বন্দেহনন্তাদ্ভুতৈশ্বর্য্যং শ্রীনিত্যানন্দমীশ্বরম্।
যস্যেচ্ছায়া তৎস্বরূপমজ্ঞেনাপি নিরূপ্যতে।।
যাঁহার ইচ্ছায় মূঢ় ব্যক্তিও তাঁহার স্বরূপ নির্ণয় করিতে পারে, সেই অনন্ত অদ্ভুতৈশ্বর্য্যবান, ঈশ্বর নিত্যানন্দ প্রভুকে বন্দনা করি।
জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় নিত্যানন্দ।
জয়াদ্বৈতচন্দ্র জয় গৌরভক্তবৃন্দ।।
ষষ্ঠ শ্লোকে কহিল কৃষ্ণচৈতন্য-মহিমা।
পঞ্চ শ্লোকে কহি নিত্যানন্দ-তত্ত্ব-সীমা।।
সর্ব্ব অবতারী কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান্।
তাঁহার দ্বিতীয় দেহ শ্রীবলরাম।।
একই স্বরূপ দোঁহে ভিন্নমাত্র কায়।
আদ্য কায়াব্যূহ কৃষ্ণ লীলার সহায়।।
সেই কৃষ্ণ নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যচন্দ্র।
সেই বলরাম সঙ্গে শ্রীনিত্যানন্দ।।....."
(-শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত। পরমভাগবৎ শ্রীমৎ কৃষ্ণদাস করিবার গোস্বামী কৃত। পঞ্চম পরিচ্ছেদ। আদিলীলা-পৃষ্ঠাঃ৩৩)
জয়
নিতাই জয় নিতাই জয় নিতাই
১৩৯৫ শকাব্দে (১৪৭৩খ্রীঃ)মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের ত্রয়োদশীতে মধ্যাহ্নে বীরভূমের একচক্রা গ্রামে নিত্যানন্দপ্রভু আবির্ভূত হয়েছিলেন। পিতা হাড়াই পণ্ডিত(ওঝা), মা পদ্মা দেবী। বাল্যকালে নাম ছিল, অনেকের মতে চিদানন্দ। বাবা-মা সঙ্গী-সাথীরা তাঁকে কুবের বলে ডাকতেন। ছোটোবেলা থেকেই নিত্যানন্দের অদ্ভুত খেলা। কৃষ্ণ-কৃষ্ণ খেলা, শকট-ভঞ্জন, কালীয়-দমন এই সব খেলাকেই ভালোবাসে। নিতাইয়ের বয়স যখন নয় তখন উপনয়ন হয়। নিত্যানন্দের বয়স যখন বারো অর্থাৎ ১৪০৭ শকাব্দ (১৪৮৫খ্রীঃ), নবদ্বীপে সন্ধ্যায় তখন গৌরচন্দ্রের উদয় হল। একচক্রা থেকে গর্জন করে উঠল নিতাই। এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল। এ কিসের শব্দ? কোথাও বাজ পড়ল বোধ হয়, না কি গৌড়েশ্বর শিব প্রলয়-বিষাণ হুংকার ছাড়লেন? নিত্যানন্দকে কেউ চিনতে পারল না। সেই থেকেই নিত্যানন্দের মন কেমন ঘরের বন্ধন থেকে কোথাও চলে যাওয়ার জন্যে ছটফট করতে শুরু করল।
হঠাৎ একদিন এক সন্ন্যাসী এসে হাড়াই পণ্ডিতের আতিথ্য নিলেন। সারারাত কৃষ্ণ প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করলেন দুজনে। ভোর হলে সন্ন্যাসী যখন বিদায় নেবেন তখন হাড়াইকে বলেন 'আমার একটি ভিক্ষে আছে, আমি তীর্থ পর্যটনে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে কোন ব্রাহ্মণ নেই। আপনার বড় ছেলেটিকে দিন, আমার সে সঙ্গী হবে।'
হাড়াই পণ্ডিত ও তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন অতিথিকে কখনো বিমুখ করবেন না। নিত্যানন্দের হাত ধরে সন্ন্যাসী পথে বরিয়ে পরলেন। কে এই সন্ন্যাসী? প্রথম শ্রেণীর বৈষ্ণব ইতিহাস গ্রন্থে (শ্রীশ্রীচৈতন্য-ভাগবত, চৈতন্য-চরিতামৃত, চৈতন্যমঙ্গল ইত্যাদি) সন্ন্যাসীবরের নাম নেই। পরবর্তীযুগে অদ্বৈতপ্রকাশ, ভক্তি-রত্নাকরাদিতেও নাম নেই। নাম পাওয়া যাচ্ছে প্রেমবিলাসে "ঈশ্বরপুরী"অভিধায়। শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী নিত্যানন্দকে একচক্রা গ্রাম থেকে নিয়ে যান, একথা মধ্যযুগীয় তথ্য-ইতিহাসময় গ্রন্থ "প্রেমবিলাসে" পাওয়া যায়। তাই সন্ন্যাসী হিসাবে শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরীকেই স্বীকার করাই বোধ হয় সঙ্গত হবে।
গৃহত্যাগ করে নিতাই প্রথম বক্রেশ্বর যান, সেখান থেকে বৈদ্যনাথ। তারপর গয়া, কাশী, প্রয়াগ, মথুরা, বৃন্দাবন হয়ে হস্তিনাপুর। বেশ কিছু বছর পর্যটন করে নিত্যানন্দ মহাপ্রভু নবদ্বীপে এলেন। নিমাই বললেন, আমার মনে হচ্ছে নবদ্বীপে কোন মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছে। শ্রীবাস, হরিদাসকে নির্দেশ দিলেন খোঁজ করে আসতে। কিন্তু তাঁরা খোঁজ নিয়ে আসতে না পারায় নিমাই নিজে গেলেন নন্দন আচার্য্যের বাড়িতে। গিয়ে দেখলেন নিত্যানন্দ অবধূত হয়ে বসে আছেন। 'ধ্যানসুখে পরিপূর্ণ হাসয়ে সদায়', এক পলকে চিনে নিলেন নিত্যানন্দকে। এ যে তাঁর সেই 'আপন ঈশ্বর', আপনবান্ধব। কৃষ্ণরূপ বর্ণনার শ্লোক পড়লেন শ্রীবাস। শ্লোক শুনতেই নিত্যানন্দের প্রেমাবেশ হল, নিমাইয়ের বাহুবন্ধনে ধরা দিলেন নিমেষে। চুপি চুপি জিজ্ঞেস করেলন,'তুই সেই কানাই নারে? কিন্তু তোর চূড়ো আর বাঁশি কই?'
'...যস্যাংশাংশঃ শ্রীলগর্ভোদশায়ী, যন্নাভ্যব্জং লোকসংঘাতনালম্।
লোকস্রষ্টুঃ সূতিকাধাম ধাতুস্তং শ্রীনিত্যানন্দরামং প্রপদ্যে।।'
যাঁহার নাভিসরোজনালে যাবতীয় লোকের অধিষ্ঠান, যাঁহাকে লোকস্রষ্টা বিধাতার সূতিকাগৃহস্বরূপ বলিয়া কীর্ত্তন করা যায়, সেই দ্বিতীয় পুরুষাবতার হিরণ্যগর্ভান্তর্য্যামী যাঁহার অংশের অংশ, আমি সেই নিত্যানন্দসংজ্ঞ রামের (বলরামের) আশ্রয় গ্রহণ করি।
(শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত। আদিলীলা-পৃষ্ঠাঃ২)
শ্রীমৎ নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর আবির্ভাবতিথির পুণ্যদিনে সমগ্র বর্ণনা সম্ভব না হওয়ায় সংক্ষিপ্ত তাঁর জীবনী বর্ণনার মাধ্যমে তাঁর শ্রীচরণে প্রণাম জানালাম।
'জগৎ যারে ত্যাগ করে নিতাই তাকে বুকে ধরে,
অদৃশ্য অস্পৃশ্য বলে জগৎ যারে ঠেলে ফেলে,
ভয় নেই তোর আছি বলে নিতাই তারে করে কোলে।।'
জয়
নিতাই। জয় নিতাই। জয় নিতাই।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- 'শ্রীমন্নিত্যানন্দ কথা'-শ্রী সরোজেন্দ্র মোহন গোস্বামী(প্রভু নিত্যানন্দের চতুর্দশ বংশধর)
তথ্য লিপিবদ্ধেঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment