Friday, May 31, 2019

অনন্ত শ্রী ঠাকুর সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ দেব


রত্নগর্ভা ভারতভূমি পর্ব
 আজ প্রকাশিত হল অনন্ত শ্রী ঠাকুর সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ দেব পর্ব-, লিখলেন বনেদীয়ানা পরিবারের গুরুত্বপূর্ন সদস্য শ্রীমান্ কৃষ্ণেন্দু বিশ্বাস শ্রী শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী পর্ব শেষে আজ শুরু হল ঠাকুর ওঙ্কারনাথ দেবকে নিয়ে প্রথমপর্ব
 অনন্ত শ্রী ঠাকুর সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ দেব

 "যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত
 অভ্যুথ্থানাম্ অধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।।"
 বর্তমান কাল থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে বৃন্দাবনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অবতীর্ণ হয়েছিলেন গোলকের স্বপার্ষদ নিয়ে মর্ত্যধামে তাঁর লীলাসম্বরণ করে ফিরে যাওয়ার আগে সকল মানবের জন্য যেটি রেখে গিয়েছিলেন সেটি হল "শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতা", যার ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ আজ সমগ্র মানবজাতি গীতার উল্লিখিত শ্লোকটির অর্থ হল, জগতে ধর্মের সংকট কালে ভগবান আবির্ভূত হন পৃথিবীতে, যুগে যুগে
কলিযুগে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভুর পর বহু মহাপুরুষের জন্ম হয় ভারতবর্ষে, যাদের "অমৃতস্যপুত্রা" বলা হয় এই মহাপুরুষগণের মধ্যে অন্যতম বঙ্গ প্রাণপুরুষ হলেন সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুর বাংলায় হুগলি জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম কেওটায় ১৮৯২ সালের ৬ই ফাল্গুন নিজ মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রী ওঙ্কারনাথ ঠাকুর পিতা প্রাঁণহরি চট্টোপাধ্যায় এবং মাতা মাঁল্যবতী দেবী সদ্যোজাত শিশুর নামকরণ করা হয় প্রবোধচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাল্যকালে প্রবোধ হারিয়ে ফেলেন তার মা মাল্যবতীকে তবে তাঁর পিতা প্রাঁণহরি চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় স্ত্রী গিরিবালা দেবী, ছোট্টো প্রবোধকে চোখে হারাতেন "প্রেবো"(প্রবোধ) ছিল তাঁর চোখের মণি গিরিবালা মায়ের ভালোবাসায় প্রবোধ বড়ো হতে থাকে
 একদিন প্রবোধের হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে বলেন তাঁর পিতাকে, "বাবা উনি কে বাবা, গলায় মস্ত সাপ, সর্বাঙ্গে ছাই মেখে সাদা, হাতে শূল আর মাথায় জটা কে বাবা উনি?" পিতা প্রাঁণহরি চট্টোপাধ্যায় বুঝলেন যে ছোট্টো প্রবোধ কোন সাধারণ কেউ নয়, যে ছেলে বাল্যবস্থায় শিবদর্শণ পান সে কখনই সামান্য কেউ নন, অবশ্যই কোন মহাপুরুষ বা দিব্যপুরুষ হবেন এইরকমভাবে কত ছোট্টো ছোট্টো অদ্ভূত লীলার সাক্ষী ছোট্টো প্রবোধের পিতা মাতা এবং আত্মীয়স্বজন

 ডুমুরদহের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত আছেন "ব্রজনাথ", নিত্যসেবাও হয় তবে সেবা চলে অভাবের সংসারে খুবই কষ্টে একদিন দেখা যায় যে ভারার সম্পূর্ণ খালি, তখন গিরিবালা দেবী প্রবোধকে বলেন সেই অভাবের কথা এবং সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলেন যে সেই দিন ব্রজনাথের সেবার মতন অন্নও নেই তখন ছোট্টো প্রবোধ মাকে বললেন, চিন্তা করো না, যার সেবার অন্ন সে নিজেই জোগাড় করে নেবেন হঠাৎই সেইদিন এক ভক্ত নিত্যসেবার জন্য দক্ষিণা দিয়ে গেলেন তখন গিরিবালা দেবী বললেন প্রবোধকে, যার সেবার অন্ন সে নিজেই জোগাড় করবেন
 এরপর প্রবোধ বাল্যাবস্থার প্রথমেই তাঁদের গ্রামের কাছেই এক বিদ্যালয়ে শিক্ষার প্রথম পর্ব শুরু করেন কিছুদিন পর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে দাশরথীদেব যোগেশ্বরকে নিজের গুরু পদে বরণ করবেন যদিও তাঁকে পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য "ব্যান্ডেল চার্চ স্কুল" ভর্তি করা হয়েছিল, কিন্তু তাঁর হৃদয় জুড়ে ছিল ভারতীয় সংস্কার এবং শিক্ষা তাই কিছুদিন পরই তিনি সেই স্কুল পরিত্যাগ করেন ভারতীয় সাংস্কৃতিক শিক্ষা বা বৈদিক বিদ্যাভ্যাস করেন তাঁর গুরু দাশরথী দেবের কাছে খুব অল্পসময়েই তিনি বৈদিক শাস্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেছিলেন তারপর তাঁর বিদ্যালাভ সমাপ্ত হলে প্রবোধ তাঁর নিজের বাড়িতে ফিরে আসেন আনুমানিক ১৯১৮ সালে একদিন রাত্রে প্রবোধ যখন ধ্যানমগ্ন তখন তিনি দর্শন করলেন দেবী দুর্গা আর তার সাথে দেবাদিদেব মহাদেবকে

 ছোটোবেলা থেকেই প্রবোধের বিবাহের প্রতি তীব্র উদাসীন মনোভাব ছিল বিবাহে তিনি নৈব নৈব কিন্তু বিধির বিধান তো খণ্ডন করা যায় না, তখন ঠাকুরের সাধনার প্রথম স্তর চলছে, তিনি তখন রয়েছেন তাঁর গুরু দাশরথী দেবের গৃহে সেই গ্রামের এক ছোট্টো মেয়ে এসে দাশরথী দেবকে বললেন, তাঁর এই শিষ্যটিকে বড়ো পছন্দ এবং বিবাহের প্রস্তাবও দিলেন দাশরথীদেব এই প্রস্তাব শুনে খুশি হয়ে প্রবোধকে বললে, প্রবোধ অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং এই বিবাহে তিনি একদমই সম্মতি প্রদানে নাকচ করেন কিন্তু দাশরথী দেব তাঁকে বলেন যে তিনি এই বিবাহে কথা দিয়েছেন, এই বিবাহ তাঁকে করতেই হবে এটাই গুরুদেবের আদেশ এমন অবস্থায় গুরু আদেশ না শুনলে মহাপাতক হবেন তাই তিনি পালিয়ে গেলেন বিবাহ না করার জন্যে এদিকে বিবাহের দিন আগত, সমস্ত আয়োজন প্রায় শেষের পথে কিন্তু পাত্র নিখোঁজ তাই মনের দুঃখে গুরুদেব দাশরথী দেব গেলেন পাত্রীর বাড়িতে সেই দুঃসংবাদ দিতে সেই সংবাদ দিতে গিয়ে গুরুদেব অবাক কারণ ছোট্টো কমলা তাঁকে এসে বললেন, চিন্তা করো না যার বিবাহ সে ঠিক সেই সময়েই আসবে কমলা আরও বললেন, "আমি যে তাঁকে সংসারে বাঁধতে আসিনি, এসেছি তাঁর সাধনার পথ অগ্রসর করতে"
 বিবাহের দিন প্রবোধ উপস্থিত এবং তিনি বিবাহ করতেও সম্মতি জানিয়েছেন এই কথা শুনে গুরুদেব দাশরথী দেবও খুশি হলেন তিনি প্রবোধকে প্রশ্ন করলেন এই পালিয়ে যাওয়ার কারণ কী? তখন উত্তরে প্রবোধ বললেন যে, তিনি এই বিবাহের প্রস্তাব মেনে না নিতে পেরে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং সাধনায় মগ্ন হন তখন তিনি আদেশ পান বিবাহ করার তাই তিনি বিবাহের জন্য প্রত্যাবর্তন করলেন বিবাহের পর সংসার জীবনে মনোনিবেশে চরম অভাব তার মধ্যেও ব্রজনাথের সেবা চলছে সংসারে মন কিন্তু প্রবোধের বসল না, শুধু সাধনায় ডুবতে চায় সে, সে শুধু চায় সংসার থেকে চলে যেতে কিন্তু সংসারের দ্বায়িত্ব তাঁকে রাস্তায় যাওয়া থেকে বিরত করে ক্রমশ......
তথ্যসূত্রঃ শ্রীমান্ কৃষ্ণেন্দু বিশ্বাস


Friday, May 24, 2019

সদগুরু শ্রী শ্রীমৎ অচ্যুতানন্দ সরস্বতী পর্ব-৫


রত্নগর্ভা ভারতভূমি পর্ব
 বনেদীয়ানা' অনেক দিন ধরেই এক বিশেষ পর্ব প্রকাশিত হচ্ছে আজ তার পঞ্চমপর্ব প্রকাশিত হল আলোচনায় গুরুত্বপূর্ন সদস্য শ্রীমান্ শঙ্খ শঙ্খের আলোচনায় আজ- সদগুরু শ্রী শ্রীমৎ অচ্যুতানন্দ সরস্বতী( শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী) পর্ব-


সদগুরু শ্রী শ্রীমৎ অচ্যুতানন্দ সরস্বতী
(শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী)

#চতুর্থ_পর্বের_লিঙ্ক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2360742927495688&id=2300280956875219

#পঞ্চম_পর্ব

এইসময় থেকেই শ্রীমৎ গোস্বামী প্রভু আকাশবৃত্তি অবলম্বন করতে শুরু করেন আশ্রমের দৈনন্দিন যা দান আসতো, সব দিনের দিনই ব্যয় হয়ে যেতো পরেরদিনের জন্য কিছু রাখা যাবেনা, এই ছিলো তাঁর নিয়ম আশ্চর্য্যের বিষয় এটাই যে, সর্বদা শতাধিক শিষ্য পরিবেষ্টিত হয়ে থাকা সত্ত্বেও দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের জন্য কারুর আলাদা করে মাথা ঘামানোর কোনো প্রশ্নই থাকতো না দৈনিক যা অর্থ বা ভাঁড়ারের সামগ্রী আসতো তার থেকে আশ্রমবাসী সকলের জন্য প্রয়োজনীয় অংশটুকু রেখে বাকীটা বিলিয়ে দেওয়া হতো দীনদরিদ্রদের এইভাবে নিত্য বহু আশ্রমিকদের ভার গ্রহণ করেও কখনও একটি কপর্দকের জন্যও কারো কাছে 'চিৎহাত' করেননি কোথা থেকে, কার আনুকূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যয়ভার নির্বাহ 'তো সে-সম্পর্কে কেউই কোনোদিন কোনো সঠিক সুলুকসন্ধান করে উঠতে পারেননি এমনকি পশুপাখি, বৃক্ষাদিও তাঁর দয়ার দান থেকে বঞ্চিত হয়নি তাঁর নিত্য দানলীলায় পূর্ণ হয়েছে পার্থির প্রার্থনা গেণ্ডারিয়া আশ্রমে বাসকালেই গোস্বামী জিউ শয়ন ত্যাগ করেন ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়ম মেনে দৈনিক জপ, তপ, পাঠ, ধ্যান, কীর্তনেই জীবন অতিবাহিত হতে থাকে তাঁর নিত্য পাঠের মধ্যে কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃত, নরোত্তম দাসের প্রার্থনা, মহাভারত, গ্রন্থসাহেব প্রভৃতি রোজ দ্বিপ্রহরে যে আমগাছের নিচে তিনি আসন করতেন, সেই গাছ থেকে প্রায়ই মধুক্ষরণ হতো, চারিদিক অপার্থিব সুগন্ধে ভরে থাকতো বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করার সময়ে তাঁর পরিধেয়বস্ত্রে বা উত্তরীয়বস্ত্রে বিভিন্ন দেবদেবীর চিহ্ন বা বীজমন্ত্র প্রকট হতে দেখা যেতো এবিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি ভগবানের নামসাধনের অসীম মহিমা, ভগবানের অহৈতুকী কৃপার কথা বলতেন ক্রমে গোঁসাইয়ের কাছে জাতিধর্মনির্বিশেষে বহু লোক সাধন পেতে থাকেন তাঁর গুরু শ্রী শ্রীমৎ ব্রহ্মানন্দ পরমহংসদেবের আদেশানুক্রমে আচণ্ডাল, দীনদরিদ্রে ভগবৎকৃপা দান করতে থাকেন সমসাময়িক অন্যান্য মহাত্মাগণ যথাঃ দক্ষিণেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, হরিদ্বারের মহাত্মা ভোলানন্দ গিরি, শ্রীধাম বৃন্দাবনবাসী রামদাস কাঠিয়াবাবা, গোরক্ষপুরের গোরক্ষনাথ জিউ প্রমুখেরা শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে বারংবার "সদ্গুরু" রূপে চিহ্নিত করে গেছেন
'ডন' পত্রিকার সম্পাদক তথা 'ডন' সোসাইটির প্রবর্তক আচার্য্য সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, বাগ্মী বিপিনচন্দ্র পাল, অশ্বিনীকুমার দত্ত, গায়ক রেবতীমোহন সেন, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা শ্রীমতী স্বর্ণকুমারী দেবী প্রমুখেরা গোস্বামী প্রভুর কাছে নামসাধনে দীক্ষিত হয়ে ধর্মজীবনে প্রভূত উন্নতি করেছিলেন বহু মহাপুরুষও তাঁর কাছে নামসাধনে দীক্ষিত হয়ে কৃতার্থ ' তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য মহাত্মা অর্জুনদাস ক্ষ্যাপাচাঁদ এই ত্রিযুগীনারায়ণ নিবাসী মহাত্মা কেবলমাত্র 'সদ্গুরু'- কৃপাপ্রার্থী হওয়ার মানসে সুদীর্ঘকাল কায়াকল্প ধারণ করে জাগতিক শরীরে বেঁচেছিলেন সিদ্ধপুরুষ ময়ূরমুকুট বাবাজী' গোঁসাইয়ের আশ্রয়ে কৃতার্থ ' গোস্বামী প্রভুর বহ্নিশিখাতুল্য শিষ্যশিষ্যাগণের মধ্যে যোগীসম্রাট শ্রীমৎ কুলদানন্দ ব্রহ্মচারী, শ্রী জগবন্ধু মৈত্র, মনোরমা দেবী, শ্রী বরদাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়(শ্রীমৎ কুলদানন্দের অগ্রজ), কিরণচাঁদ দরবেশ জি, যমুনা মাঈ, স্বামী হরিমোহন, শ্রীমৎ মহেশচন্দ্র প্রমুখেরা দিকপালগণ গুরুকৃপায় নামানন্দে বিভোর হয়ে সদ্গুরুর আশ্রয়ে জয়যুক্ত জীবন অতিবাহিত করেছেন
অচিন্ত্যপুরুষ শ্রী বিজয়কৃষ্ণ 'সাধু' নন, তিনি 'সাধ্য' সাধকগণেরও সাধনালব্ধ বস্তু পৃথিবীর সমস্ত প্রেমভাণ্ডারকে যদি পুঞ্জীভূত করা যায়, বিজয়কৃষ্ণের প্রেমভক্তির কাছে তা বিন্দুবৎ!
তাঁর শরীরে প্রকটিত অষ্টসাত্ত্বিকী বিকার, কীর্তনে উদ্দাম নৃত্যকালে মাথায় উত্থিত ফণীর মতো জটাভার, করুণার অনাবিষ্কৃত গভীরতা দেখে সমকালীন মহাত্মাগণ একবাক্যে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীকে 'প্রেমাবতার সদ্গুরু' বলে স্বীকার করে গেছেন অনন্ত ঐশ্বর্য্যশালী ভগবানের প্রধান শক্তিগুলির মধ্যে 'সৃষ্টিস্থিতিলয়' সহ 'মায়ার আবরণীশক্তি'-গুলির অন্যতম হলেন 'সদ্গুরু' নিজ মায়া উন্মোচনকারী করুণাময় ভগবৎকল্পী সত্ত্বা' 'সদ্গুরু'
প্রেমভাবে উন্মত্ত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর একান্ত মনোবাঞ্ছা "অকাতরে ঘরে ঘরে প্রেমভক্তি জাগরণ"-এর কাজ যা তিনি স্বয়ং সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি, শ্রীমদাচার্য্য অদ্বৈতের প্রার্থনায় শান্তিপুরে গোস্বামীকুলে অদ্বৈতেরই দশম উত্তরপুরুষ সদ্গুরু শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী রূপে পুনরাবির্ভূত হয়ে তা তিনি দান করে গেছেন
মহাভারতে শরশয্যায় শায়িতাবস্থায় মহামতি ভিষ্ম ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির'কে 'সদ্গুরু'- চিহ্নিতকরণ সংক্রান্ত যে বিখ্যাত স্তবটি বলেছিলেন তা'হলো,
"ওঁ জটিনে দণ্ডিনে নিত্যং লম্বোদর শরীরিনে
কমণ্ডলু নিসঙ্গ্যায় তস্মৈ ব্রহ্মাত্মনে নমঃ।।"
যুগে যুগে যতজন সদ্গুরু অবতীর্ণ হয়েছেন বা ভবিষ্যতে হবেন, তাঁদের বাহ্যিকরূপ এইপ্রকার হয় অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বরের অবিকৃত হ্লাদিনীশক্তিই সদ্গুরুর প্রকাশ তাই সত্যযুগের ঋভু, দত্তাত্রেয় থেকে শুরু করে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী সকলেরই বাহ্যিক প্রকাশ একরকমের ভবিষ্যতে, কালচক্রে যখন লীলাকাণ্ড বিস্তারের সময় হবে তখনও যতজন সদ্গুরু আসবেন তাঁরাও এই একই রূপে অবতীর্ণ হবেন কারণ এটি ভগবানের অপরিবর্তনীয় প্রকাশমাধ্যম যেকারণে, শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নেপাল বাবুকে বলেছিলেন, "সদ্গুরু' দীক্ষা নিবি? তো যা, সেই বিজয় গোঁসাইয়ের কাছে যা"
১৮৮৮ খ্রীস্টাব্দের ৮ই মার্চ, গেণ্ডারিয়া আশ্রমে গোস্বামী প্রভুর পুত্র শ্রীমান যোগজীবনের সঙ্গে গোঁসাই শিষ্য জগবন্ধু মৈত্রের ভগিনী শ্রীমতী বসন্তকুমারী দেবীর এবং জগবন্ধু মৈত্রের সঙ্গে গোস্বামী প্রভুর কন্যা শ্রীমতী শান্তিসুধা দেবীর শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয় বিবাহের পরে সপরিবার গোঁসাই শান্তিপুরে আসেন শান্তিপুরে থাকাকালীন, সশিষ্য পরিবেষ্টিত গোঁসাই একদিন অদ্বৈতাচার্য্যের সাধনস্থল তথা মহাপ্রভু, নিত্যানন্দ প্রভু অদ্বৈতাচার্য্যের মিলনস্থল, বাবলায় নগরসংকীর্তনে যান বহু স্মৃতিবিজড়িত বাবলায় অলৌকিকভাবে শ্রীমৎ অদ্বৈতের স্বহস্তরচিত কয়েকটি পুঁথি কাষ্ঠপাদুকা আবিষ্কার হয় গোঁসাইয়ের নির্দেশে তা, শ্রীমন্দিরে বিগ্রহের নীচে প্রোথিত করা হয় এখানের স্থানমাহাত্ম্য এমনই যে এখনও অপ্রাকৃত সংকীর্তনধ্বনি শোনা যায়!
১৮৮৯ সালে গুরু ব্রহ্মানন্দ পরমহংসের আদেশে বিজয়কৃষ্ণ শ্রীধাম বৃন্দাবনে একবছর থাকার মানসে সশিষ্য যাত্রা করেন বৃন্দাবনে শ্রী শ্রী দাউজি মন্দিরের ধর্মশালায় তিনি অবস্থান করেছিলেন একবার কথাপ্রসঙ্গে শিষ্যদের বলেছিলেন, "শাস্ত্র শুধু বাঁধাই করা বই নয়, কালি নয়, ছন্দবদ্ধ পংক্তিও নয় এর এক একটি শব্দের এক একটি অক্ষরে এক একটি মহাশক্তিধর বীজ সুপ্ত হয়ে আছে ভক্তিসহকারে স্মরণ-মনন করলে, এক একবারে সামনে প্রকট হয়ে দাঁড়ায়!"
এইসময়ে গোস্বামী প্রভুর অর্ধাঙ্গিনী শ্রী শ্রীমতী যোগমায়া ঠাকুরাণীও তাঁর সাথেই বাস করছিলেন যোগমায়া দেবী ছিলেন জন্মসিদ্ধা, যোগসিদ্ধা এবং গুপ্তসাধিকা ভগবৎকল্পী সদ্গুরু স্বামীর সেবায় দিনপাত করবেন, এই সঙ্কল্পেই তিনি বৃন্দাবন আসেন তিনি দৈনন্দিন কাজকর্মের আড়ালে নিজের সাধনক্রিয়াকে সম্পূর্ণ গোপন করে রাখতেন৷ পাঁচজন সাধারণের চোখে সেসব ধরা না পড়লেও ত্রিকালজ্ঞ মহাত্মাদের নজরে তা মাঝেমধ্যেই প্রকাশ হয়ে যেতো ব্রাহ্মসামজে থাকাকালীন একবার শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের দর্শনলাভের উদ্দেশ্যে গোঁসাইয়ের সাথেই তিনি দক্ষিণেশ্বর যান শ্রীমতী যোগমায়াকে দেখেই পরমহংসদেব বলে ওঠেন, " বিজয়, তুমি কাকে এনেছো! মায়ের(শ্রী ভবতারিণী মাতা) সামনে দাঁড়ালে আমার যা অনুভূতি হয়, একে দেখেও তো তাই' হচ্ছে!"
বৃন্দাবন বাসকালে একদিন হঠাৎই শ্রীমান কুলদানন্দ বৃরহ্মচারীর সাক্ষাৎদর্শন থেকেই অযাচিতভাবে অদৃশ্য হয়ে যান যোগমায়া দেবী সারা বৃন্দাবন তোলপাড় করে খুঁজেও কোথাও তাঁর হদিস পাওয়া যায় না তখন গোঁসাই বলেন, পরমহংস(শ্রীমৎ ব্রহ্মানন্দ)-জি এসে ওকে নিয়ে গেছেন নিত্যসিদ্ধা যোগমায়া দেবী সম্পর্কে গোঁসাই বলেছিলেন, 'বৃন্দাবনে এলে আর ফিরে যাবেনা!'
বেশ কয়েকদিন পরে আবার অযাচিতভাবেই ফিরে আসেন এযাবৎকাল তাঁর লুকিয়ে রাখা যোগবিভূতির দু-একটি নিদর্শন এইসময়ে শিষ্যদের সামনে প্রকট হয়ে যায় সকলেই লক্ষ্য করেন, একটি মাত্র একসের(আনুমানিক ৯০০ গ্রাম) চালের ভাত রান্না করা যায় এমন একটি হাঁড়িতে একবারমাত্র ভাত ঐরকমই একটি 'বোকনা'(কড়াই)-তে একবারেই যতটা ডাল/তরকারি ইত্যাদি ব্যঞ্জন রান্না সম্ভব ততটাই রান্না করে তিন/চারটি মন্দিরে ভোগ পাঠাতেন অতঃ অবশিষ্ট রান্না দাউজির ভোগে নিবেদন করে পরিতোষপূর্বক ত্রিশ/পঁয়ত্রিশজন শিষ্যকে সামনে বসে থেকে ভোজন করাতেন তাঁর কষ্টের কথা চিন্তা করে বা অধিকসময় যাবৎ উপবাসে বারণ করলে বা শতসহস্র আকুতি করলেও কোনোদিন আগে থেকে নিজে খাবার গ্রহণ করতেন না সকলের খাওয়া হয়ে যাবার পরে নিজে যৎসামান্য খেয়ে বাকীটা পশুপাখিদের বিলিয়ে দিতেন এটা অনেকেই লক্ষ্য করেন যে যতক্ষণ পর্যন্ত মাতা ঠাকুরাণী নিজে না অন্নগ্রহণ করেন, ততক্ষণ ভাতের হাঁড়ি বা অন্যান্য তরিতরকারির পাত্র পূর্ণ হয়ে রয়েছে কথাপ্রসঙ্গে বা বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে যখনই তাঁর বিভূতি প্রকাশ পেয়েছে, তিনি তা যথাসম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করে গেছেন
এদিকে একবছর পূর্ণ হওয়ার উপক্রম হতেই গোঁসাই আসন সড়াতে চাইলেন যোগমায়া যেতে চাইলেন না আর-একদিন, আর-দু'দিন ইত্যাদির অছিলায় মাত্র একবেলার ওলাওঠায় ভুগে শ্রী শ্রীমতী যোগমায়া দেবী নশ্বর শরীর ত্যাগ করে জ্ঞানগঞ্জ লাভ করলেন বৃন্দাবনে যমুনাসলীলে সাক্ষাৎ জগন্মাতার ক্ষণজন্মা বিভূতিময়ী যোগমায়ার অস্থিখণ্ড বিসর্জিত হয় এরপরে ভগ্নমনোরথ, শিষ্যগণ দেহাবশেষের বাকী অংশগুলি নিয়ে গুরু গোঁসাইয়ের সাথে গেণ্ডারিয়া আশ্রমে ফিরে আসেন........... ক্রমশ
তথ্যসূত্রঃ শ্রীমান্ শঙ্খ