Saturday, May 18, 2019

সদগুরু  শ্রী শ্রীমৎ অচ্যুতানন্দ সরস্বতী পর্বঃ৩


রত্নগর্ভা ভারতভূমি পর্ব
আমাদের বনেদীয়ানা' যে পর্ব শুরু হয়েছে তার তৃতীয়পর্ব পরিবেশন করা হল, লিখলেন শ্রীমান্ শঙ্খ ভবিষৎএ আমাদের কোন লেখা ব্লগ বা ওয়েব বা পেজ থেকে না বলে তথ্য নিলে আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য থাকব আলোচনায় আজ সদগুরু শ্রী শ্রীমৎ অচ্যুতানন্দ সরস্বতী( শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী)-পর্বঃ৩
সদগুরু  শ্রী শ্রীমৎ অচ্যুতানন্দ সরস্বতী
(শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী)

#দ্বিতীয়_পর্বের_লিঙ্ক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2357183471184967&id=2300280956875219

#তৃতীয়_পর্ব

জ্ঞানতই মায়ের সান্নিধ্যে যে শিক্ষার ধারা বিজয়কৃষ্ণের প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রোথিত হয়েছিলো, তারই প্রতিফলন দেখা যায় পরবর্তীকালে স্বভাবজাত কারণেই পরদুঃখে কাতরতা, ক্ষমাশীলতা, দয়া, করুণা, অহৈতুকী দাক্ষিণ্য এসবই ছিলো পূর্ব সুকৃতির প্রতিফলন ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে বাঙালী তথা ভারতবাসীকে তথাকথিত শিক্ষিত করার অছিলায় ব্রিটিশদের খ্রীস্টান ধর্মপ্রচার রোধের উদ্দেশ্যেই ব্রাহ্মসমাজের অভ্যুত্থান হয় গোস্বামী জি' অক্লান্ত পরিশ্রমে তা পায় পূর্ণ সাফল্য ব্রাহ্মধর্মে একেশ্বরবাদ ছিলো নীতিধর্মের উপরে প্রতিষ্ঠিত, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সঙ্গে তার যোগসূত্র ছিলো ক্ষীণ ক্রমে বিজয়কৃষ্ণ অনুভব করলেন, মন-বাক্য-ক্রিয়ার দ্বারা এখানে থেকে সত্যের অনুসন্ধান সম্ভবপর নয় সত্যলাভের আকাঙ্খা সাময়িকভাবে পূরণ হলেও, তার দীর্ঘস্থায়ী রেশ থাকতো না ধ্যানাবিষ্ট হলে, সাময়িক আনন্দলাভ ছাড়া বিশেষ কোনো অনুভূতিই জাগ্রত হতোনা কারণ সেসবই ছিলো নীতি, যুক্তি এবং তর্কভিত্তিক পন্থা ভক্তি বা বিশ্বাস বা মাধুর্য্যের লেশমাত্র তাতে ছিলোনা
এরই মধ্যে ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজের সদস্যদের মধ্যে এক অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় একদিকে নারীজাগরণ, বাল্যবিবাহ-বহুবিবাহরোধ প্রভৃতি বিভিন্ন উন্মেষমূলক কাজে বিজয়কৃষ্ণ দিবারাত্রি নিষ্পলক নজরদারীতে প্রাণপাত করে চলেছেন, অন্যদিকে সমাজাধ্যক্ষ কেশবচন্দ্র সেন তাঁর নাবালিকা কন্যার বিবাহ স্থির করেন, তৎকালীন কুচবিহারের নাবালক যুবরাজের সঙ্গে; এবং সম্পূর্ণ হিন্দুমতে পুরোহিতদ্বারা লৌকিক দেশীয় আচার-অনুষ্ঠান মেনেই সেই বিবাহকার্য্য সম্পন্ন হয় স্বাভাবিকভাবেই বিজয়কৃষ্ণ কেশবচন্দ্রের মধ্যে বাগবিতণ্ডা শুরু হয় অবশেষে কথার গতিতেই গোস্বামীর কাছে কেশবচন্দ্রের বাহ্যিক বাকচাতুর্য্য বাহুল্যতাসম্পন্ন একেশ্বরবাদে বিশ্বাস এবং আন্তরিক সংস্কারাবদ্ধ মনোবৃত্তি ধরা পড়ে যায় কেশবচন্দ্রের 'মন এবং মুখ'-এর পরস্পর অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক ফাঁস হয়ে যাওয়ায় বিজয়কৃষ্ণ ভারতীয় ব্রাহ্মসমাজ থেকে বেড়িয়ে আসেন এবং ১৮৭৮ খ্রীস্টাব্দের ১৬ই মে, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন কেশবচন্দ্রের ব্রাহ্মসমাজের নাম পাল্টে রাখা হয় 'নববিধান ব্রাহ্মসমাজ'
দীর্ঘকালীন যোগসূত্র ছিন্ন হওয়ার কষ্ট সামাল দেওয়ার জন্য অশান্ত বিজয়কৃষ্ণ কয়েকদিনের একাকিত্ব সাধনের উদ্দেশ্যে চলে আসেন শান্তিপুরের বসতবাড়ীতে কয়েকদিনের চেষ্টায় মানসিক কষ্ট সামলে ফিরে আসেন নিজের স্থাপন করা সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে পুনরায় প্রচারের কাজে আত্মসমর্পণ করেন কর্মের মাধ্যমেই কর্মনাশের উদ্দেশ্যে স্থান থেকে স্থানান্তরে ধ্বনিত হতে থাকে গোস্বামীর পদধ্বনি প্রচারক অবস্থায় দিনের পর দিন অশ্রান্তভাবে বক্তৃতা, সভা করেও মানসিক যন্ত্রণার কোনো উপশমই লক্ষ্য করলেন না এই সময়েই একবার দৈবাৎ বা-গাছড়া(অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত)- প্রচারকালে এক সন্ধ্যায় ধ্যানাবিষ্ট থাকাকালীন অযাচিতভাবে দৈবনির্দেশ পান যে, "কোনোপ্রকার বন্ধন বা গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ থাকলে পূর্ণরূপে সত্যদর্শন সম্ভব নয় সত্যলাভের মূলপন্থাই হলো অন্তর্মুখীতা"
কোলকাতায় ফিরে আসার পরে মীর্জ্জাপুর স্ট্রিটের একবাড়ীতে থাকাকালীন রাত্রে আসনে ধ্যানমগ্নতায় মধ্যেই দেখেন, স্বপার্ষদ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সহসা আবির্ভূত হয়ে বিজয়কৃষ্ণকে দীক্ষাদান করেন এবং পূর্বসূরী শ্রীমদ্বৈতাচার্য্য আদেশ দেন, "তোর ব্রাহ্মসমাজের কাজ সম্পন্ন হয়েছে এবারে তুই মহাপ্রভুর শরনাগতি নে"
আচার্য্যবর গোস্বামীর জীবনে ঘটে গেলো এক আমূল পরিবর্তন তাঁর অন্তর্নিহিত সত্ত্বার নিরাকারবাদ এবং ধ্যানাবিষ্ট দর্শনলাভে সাকারবাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো শুরু হলো, "ঘরের ছেলে, ঘরে ফেরার পালা"
এরপরে শান্তিপুরের বাড়ীতে এক সন্ধ্যায় ছাদে একা থাকার সময়ে হঠাৎই কুলদেবতা শ্যামসুন্দর প্রকট ' সেই অপার্থিব রূপবৈভবের ছটায় মুগ্ধ বিজয়কৃষ্ণ অশ্রুসজল চোখে কৃতাঞ্জলি হওয়ার সাথে সাথেই শ্যামসুন্দর রহস্যের হাসি হেসে বলে ওঠেন, "কেঁদেকেটে, আমাকে ভারি প্রণাম করছিস যে! এদিকে লোককে এতকাল বলে বেড়িয়েছিস, তুই নাকি আমাকে মানিস না!" বিজয়কৃষ্ণের প্রত্যুক্তি, "সবই যদি তুমি আগে থেকেই জানতে, তাহলে এতদিন কালাপাহাড় সাজিয়েই বা রেখেছিলে কেন আমাকে?" এই কথা শুনে ভুবনমোহন হাসি হেসে দীনবন্ধু বলে ওঠেন, "দ্যাখ, ভেঙেওছি আমি আবার গড়েপিঠে তৈরীও করে নেবো আমি যখন ইচ্ছে, তখনই করবো তাতে তোর কি! একছাঁচের জিনিস ভেঙে নতুন ছাঁচে তৈরী করলে আরও কত ভালো দেখতে হয় জানিস!"
ধর্মলাভের তীব্র আকাঙ্খায় প্রকৃত গুরুর সন্ধানে সারা ভারতবর্ষ তোলপাড় করে বিভিন্ন জায়গায় সাধুসঙ্গ করতে শুরু করেন প্রকৃত সত্যবস্তু লাভের আশায় ব্যকুল হয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে যেতে লাগলেন বাউল, কর্তাভজা, কাপালিক, বৌদ্ধ, অঘোরী প্রভৃতি সম্প্রদায়ের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যলাভ করে শুধুমাত্র আচার-অনুষ্ঠানবিহীন, নির্লিপ্ত-অসাম্প্রদায়িক "সত্য"-কে সন্ধান করে গেছেন ১৮৮২ খ্রীস্টাব্দে তিনি দক্ষিণেশ্বরে আসেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে দর্শন করতে 'রাম' 'বিজয়', এই দুই 'কৃষ্ণ'-এর প্রথম সাক্ষাতের পর থেকেই উভয়ের মধ্যে গড়ে ওঠে অনুরাগ, পরম আন্তরিকতা সম্প্রীতির সম্পর্ক ব্রাহ্মসমাজের থেকে সম্পর্ক ক্ষীণ হওয়ার পর থেকে মাঝেমধ্যেই বিজয়কৃষ্ণ আসতেন শ্রীমৎ পরমহংসের সঙ্গমাধুর্য্য আস্বাদনের জন্য বহুবার দক্ষিণেশ্বরের পঞ্চবটী পঞ্চমুণ্ডির আসন দর্শন করে পরম আনন্দ লাভ করেন সাধনানুকূল এই স্থানের টানে বারবার আচার্য্য গোস্বামী এখানে এসেছেন শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর হার্দিক সম্পর্ক এতটাই প্রগাঢ় ছিলো যে, পরমহংসদেব একবার কথায় কথায় বলেছিলেন, "বিজয়'কে দেখলে আমার হৃদপদ্ম যেন অনাবিল আনন্দে বারংবার প্রস্ফুটিত হতে থাকে" উভয়ের নিয়মিত যোগাযোগ থাকাকালীন এক দৈবিক ঘটনার কথা শোনা যায় "একবার রামকৃষ্ণদেব বিজয়কৃষ্ণ আরিয়াদহের শ্রী গদাধর প্রভুর পাটবাড়ী দর্শন করতে যান সময়টি ছিলো দুপুরবেলা সেখানে গদাধরের সাধনস্থল সমাধি দর্শন করে বিজয়কৃষ্ণ ভাবাবেশে লুটাপুটি খেতে থাকেন৷ প্রকৃতিস্থ হওয়ার পরে গর্ভমন্দিরের সামনে সাষ্টাঙ্গ দিতেই আপনা হতেই ভিতর থেকে বন্ধ করা মন্দিরের দরজা আপনা হতেই খুলে যায় এই ঘটনায় রামকৃষ্ণদেব অভিভূত ' পরে পূজারি এসে এই আকস্মিক দৈবলীলা দর্শন করে উভয়ের গলাতেই প্রসাদী মালা পড়িয়ে দেন"
এইসময়ে বিজয়কৃষ্ণ আরও যেসব মহাপুরুষদের সঙ্গলাভ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে মহাত্মা গম্ভীরনাথ জি, নবদ্বীপের চৈতন্যদাস বাবাজী, কালনার সিদ্ধ ভগবান দাস বাবাজীর নাম উল্লেখযোগ্য নবদ্বীপের চৈতন্যদাস বাবাজী বিজয়কৃষ্ণের সাক্ষাৎকারের ঘটনাটি এখানে উল্লেখযোগ্য ব্রাহ্ম-প্রচারক গোস্বামী, পরমভাগবত চৈতন্যদাসকে জিজ্ঞাসা করেন, "বাবাজী, ভক্তি কীভাবে আসে?" এই প্রশ্ন শুনে সাধক চৈতন্যদাস হুঙ্কার দিয়ে বলে ওঠেন, "কী বললে? তুমি কী বললে গোঁসাই? ভক্তি কীভাবে আসে? স্বয়ং ভক্তিরভাণ্ডার অদ্বৈতের দশমপুরুষ হয়ে তুমি কিনা আমার কাছে, ভক্তি কী বস্তু জানতে চাইছো?" এই বলেই সমাধিস্থ ' জ্ঞান ফেরার পরে দৃপ্তকণ্ঠে বাবাজী জানান, "এখন যতই ব্রাহ্মধর্মের প্রচারক রূপে আচার্য্য সেজে ঘুরে বেড়াও; অদূর ভবিষ্যতে তোমার দ্বাদশাঙ্গে তিলক, গলায় তুলসী-রুদ্রাক্ষ, মাথায় জটা, পরনে গেড়ুয়া আর হাতে দণ্ড.... আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি!"
এরপরে তিনি এসে পৌঁছান অবিমুক্ত-ক্ষেত্র কাশীতে সেখানে 'চলমান শিব' শ্রীমৎ ত্রৈলঙ্গস্বামীর সাক্ষাতে পুনরায় গুরুকরণের প্রসঙ্গ এসে পড়ে অস্থির বিজয়কৃষ্ণকে শান্ত করে ত্রৈলঙ্গস্বামী একটি মন্ত্র দে' এবং বলেন যতদিন না গুরুকরণ হচ্ছে, ততদিন এই মন্ত্রেই জপ করতে আকুল বিজয়কৃষ্ণ তাঁর কাছেই দীক্ষা চাওয়ায় তিনি বলেন, "আমি তোর গুরু নই তোর গুরু নির্দিষ্ট আছেন এবং তিনি তোকে দীক্ষা দেওয়ার জন্যই সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছেন"
এরপরে পরমবস্তু লাভের আকুলতায় পাহাড়-পর্বত, প্রকাৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে চতুর্দিকে ব্যকুল হয়ে ছুটে বেড়াতে থাকেন সহসা সরিৎকূল সম্রাজ্ঞী নর্মদা' কথা মনে আসতেই অমরকন্টকে হাজির ' সেখানে নর্মদার তীর বরাবর পরিক্রমার মানসে যাত্রা শুরু করেন জ্যোতির্লিঙ্গ ওঁকারেশ্বরে অযাচিতভাবে এক উচ্চকোটি মহাত্মার সাক্ষাৎ পান এবং তাঁর থেকে প্রত্যক্ষ আদেশ পান যে দীক্ষার সময় হয়ে এসেছে তবে এইস্থানে(নর্মদা তীর্থ) নয় তার(বিজয়কৃষ্ণের) "গাঁটছড়া" বাঁধা আছে যেখানে, সেই "গদাধর পাদপদ্মরঞ্জিত" গয়াধামে মন্ত্রদাতা গুরু তার জন্য শুধু সময়ের অপেক্ষায় বসে আছেন কথাপ্রসঙ্গেই ওঁকারেশ্বরের মহাত্মা, বিজয়কৃষ্ণকে স্মরণ করিয়ে দেন সেই ভাবাবিষ্ট ধ্যানের কথা যখন অদ্বৈতাচার্য্য সরাসরিই বিজয়'কে 'মহাপ্রভুর শরণাগতি' নেওয়ার আদেশ দেন চমকে ওঠেন বিজয়কৃষ্ণ পূর্বনির্ধারিত ভবিষ্যৎ বিস্মরণ সেই ঘটনার নর্মদাশ্রয়ী মহাত্মার মাধ্যমে পুনরুল্লেখে আপ্লুত বিজয়কৃষ্ণ এগিয়ে চলেন পতিতপাবনের চরণচিহ্নবিধৌত গয়াধামের পথে.......... ক্রমশ
তথ্যসূত্রঃ শ্রীমান্ শঙ্খ





No comments:

Post a Comment