রত্নগর্ভা
ভারতভূমি পর্ব
আজ প্রকাশিত হল
সদগুরু শ্রী শ্রীমৎ অচ্যুতানন্দ
সরস্বতী(শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী)
পর্ব-২, লিখলেন পরিবারের
গুরুত্বপূর্ন সদস্য শ্রীমান্ শঙ্খ। বনেদীয়ানা'র সাথে থাকুন...
সদ্গুরু
শ্রী শ্রীমৎ অচ্যুতানন্দ সরস্বতী
(শ্রীমৎ
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী)
#প্রথম_পর্বের_লিঙ্ক
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=2356633501239964&id=2300280956875219
#দ্বিতীয়_পর্ব
"পাপে
মলিন মোরা চল চল
ভাই,
পিতার
চরণ ধরে কাঁদিয়ে লুটাই
রে।
বাসনা
করেছি মনে দেখিব তোমায়,
তোমার
করুণা বিনা, না দেখি
উপায় হে।।"
(১৮৭৪
সালের ২৭ আশ্বিন, ব্রাহ্মসমাজগৃহে
গাওয়া প্রথম খোল-করতাল
সহযোগে কীর্তন।
রচয়িতাঃ
শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী)
সংস্কৃত
কলেজে অধ্যয়নকালে শঙ্করভাষ্যের বৈদান্তিক অধ্যায়ের নিয়মতি পাঠ, চর্চা
এবং আলোচনার ফলে বিজয়কৃষ্ণের মনের
পারিবারিক আধ্যাত্মিকতার সরস ভাব সম্পূর্ণ
নষ্ট হয়ে যায়।
মনের এরকম শুষ্ক অবস্থায়
একদিন অন্তর থেকেই পরলোক
চিন্তার আহ্বান পা'ন। এরপর
থেকেই তাঁর মনে পারমার্থিক
শান্তিলাভের জন্য ক্রমে ব্যাকুলতা
জাগ্রত হতে থাকে।
সেইসময়ে অবিভক্ত বঙ্গদেশে রাজা রামমোহন রায়
প্রতিষ্ঠিত 'ব্রাহ্মসমাজ'-এর আচার্য্যপদে অধিষ্ঠিত
ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর
নিষ্ঠা, ত্যাগ ও সত্যরক্ষার
পন্থায় আকৃষ্ট হয়ে বহু
শিক্ষিত জনগণ সেই ভাবধারার
আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।
পদদলিত ভারতবর্ষকে শুধু বাহ্যিক আক্রমণের
দ্বারা বিপর্যস্ত করেই নয়, অভ্যন্তরীণ
সম্প্রীতি ও দেশীয় শিক্ষার
পরিকাঠামোকে ধ্বংস করে ইংরেজি
শিক্ষা ও আদবকায়দায় মোহিত
করা এবং অন্তর্দেশীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতিকেও তিলে তিলে শেষ
করায় বধ্যপরিকর হয়ে ওঠে ব্রিটিশ
শাসকগণ। সঙ্গে
ছিলো পরোক্ষ উপায়ে খ্রীস্টান
ধর্মপ্রচারের পথ সুপ্রশস্ত করার
কৌশল।
তৎকালীন
হিন্দুধর্মের আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব কৃত্রিমতা,
দেববিগ্রহের দোহাই টেনে দেবালয়ে
চাটুকারিতার পৌরোহিত্যবৃত্তি তথা ব্যবসা, ধর্মভীতি
প্রদর্শনে সুকৌশলে অর্থোপার্জন প্রভৃতি দেখে বিজয়কৃষ্ণ মরমে
ক্ষীণ হয়ে আসছিলেন।
মনের ব্যকুলতার পরিসমাপ্তির উপায় খুঁজতে খুঁজতেই
অযাচিতভাবেই এইসময়ে কিছু ব্রাহ্মবন্ধুর
সংস্পর্শে এসে ব্রাহ্মসমাজগৃহে যান। সেখানে
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তৃতা ও ভাবগাম্ভীর্য্যপূর্ণ আলোচনা-পর্যালোচনা
শুনে যারপরনাই আপ্লুত ও মুগ্ধ
হয়ে পড়েন।
এমতাবস্থায়
কয়েকদিনের মধ্যেই গুরুপ্রণামি(শ্রীমৎ
অদ্বৈতাচার্য্যের সময় থেকেই গোস্বামী
বংশে শ্যামসুন্দর তথা অন্যান্য রাধামাধব
বিগ্রহের সেবা ও কুলদীক্ষাদানের
প্রচলন আবহমান ছিলো)-র
উদ্দেশ্যে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের এক শিষ্যের বাড়ীতে
তাঁকে যেতে হয়।
সেখানে, এক সন্ধ্যায় একাকী
পুরশ্চরণাদি ক্রিয়ার সময়ে শিষ্যগৃহের এক
মহিলা এসে তাঁর পদযুগল
জড়িয়ে ধরেন। চরণে
বারংবার প্রণিপাত হয়ে জন্মমৃত্যুআদি ভবচক্রের
হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার
সঠিক পথের সন্ধান জানতে
চান। শিষ্যার
এই আকুতিতে বিজয়কৃষ্ণ নিজেই চমকে ওঠেন। যেন
তাঁর অন্তরেই জাগ্রত হয়, "সেকি!
আমি নিজেই জন্মমৃত্যু তথা
জাগতিক মোহ, মায়াবন্ধন, দুর্বিপাকের
হাত থেকে মুক্ত নই,
তবে অন্যকে মুক্তির পথ
দেখাবো কীভাবে!" তখন আন্তরিক সত্যনিষ্ঠার
জাগ্রত অগ্নিকে শপথ করলেন যে
আর পারিবারিক গুরুবৃত্তীয় কাজে কালপাত করবেন
না এবং যথাসাধ্য নিজস্ব
কর্মক্ষমতায় অর্থোপার্জনে জীবন অতিবাহিত করবেন।
গুরুগিরির
ব্যবসা ও নিশ্চিন্ত জীবনের
আরাম ত্যাগ করে এককাপড়ে
চলে আসেন কোলকাতায়।
হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনায় স্থির
করেন, ডাক্তারি শিক্ষা অর্জন করে
পরিবারের যথোপযুক্ত ভরনপোষণ করবেন। ১৮৬০
খ্রীস্টাব্দে তিনি কোলকাতা মেডিকেল
কলেজের বাংলা বিভাগীয় পাঠক্রমে
ভর্তি হ'ন।
মেডিকেল কলেজে পাঠরত অবস্থায়
উইলিয়াম চিবার্স নামক একজন ব্রিটিশ
ডাক্তার তথা কলেজের অধ্যাপকের
মুখে হিন্দু সংস্কৃতি ও
ধর্মাচরণ সংক্রান্ত কটাক্ষবাক্যে শুনে সকল বাঙালী
ছাত্রদের সমবেত করে বিজয়কৃষ্ণ
'ছাত্রবিদ্রোহ'-এর ঘোষণা করেন। ভারতীয়
ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে এটিই প্রথম ছাত্র
আন্দোলন। অবশেষে,
পণ্ডিতপ্রবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মধ্যস্থতায় আন্দোলনের ব্যপ্তি বিকটতা হ্রাস পেলেও
মেডিকেলের ইংরেজ ছাত্র তথা
অধ্যাপককুলের রোষ বিজয়কৃষ্ণের উপরে
রয়েই গেলো। এরপর
থেকে ক্রমাগত তাঁকে লক্ষ্য করে
একাধিক অহৈতুকী দোষারোপ ও ভিত্তিহীন মিথ্যা
বঞ্চনায় জর্জরিত হয়ে একপ্রকার বাধ্য
হয়েই ডাক্তারি পড়ার ইতি টানতে
হ'লো বিজয়কৃষ্ণকে।
১৮৬১/৬২ সালে ব্রাহ্মসমাজে
আচার্য্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে অযাচিতভাবে দীক্ষা
গ্রহণ করেন এবং নিজে
থেকেই ব্রাহ্মধর্ম প্রচারকের ভূমিকায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর
বংশমর্যাদা, পরিবার, সমাজ, ধর্মাচরণ, নিন্দাস্তুতি
বা অর্থক্লিষ্টতা কোনোকিছুই তাঁকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করতে
সক্ষম হয়নি। এরপরে
১৮৬৪ খ্রীস্টাব্দে তিনি আদি ব্রাহ্মসমাজের
আচার্য্যবর পদে অভিষিক্ত হ'ন এবং প্রচারক
তথা আচার্য্যরূপে অক্লান্তভাবে সংস্কারমুক্ত উদারতায় ব্রহ্মনাম প্রচার করতে থাকেন। বিজয়কৃষ্ণের
আচার্য্যপদে আসা বা যত্রতত্র
ব্রহ্মনাম প্রচারের ঘটনা ব্রাহ্মসমাজের প্রাচীনপন্থী
তথা প্রবীন সদস্যগণ সুনজরে
দেখলেন না। তাঁদের
কর্তৃত্বপ্রিয়তা বা উচ্চনীচ ভেদাভেদ
দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নবীন ব্রাহ্মগণের
সঙ্গে সংঘাত শুরু হয়। গোস্বামী
মহাশয় নীরবে আচার্য্যপদ ত্যাগ
করেন। পরবর্তীতে
১৮৬৯ সালে কেশবচন্দ্র সেনের
নেতৃত্বে ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ গঠিত হয়।
সেখানে বিজয়কৃষ্ণ যোগদান করেন।
এইসময়ে সমাজের দায়িত্বরূপে তাঁকে
বিধবাবিবাহ প্রচার, লোকহীতকর যথাসাধ্য পরিসেবা, বিনা-পারিশ্রমিকে ডাক্তারি
ও নারীশিক্ষায়তনে শিক্ষকের পদে অবতীর্ণ হতে
হয়। রাত্রি
জাগরণে তত্ববোধিনী, তত্বকৌমদী প্রভৃতি পত্রিকায় সংস্কারমুক্ত ধর্মাচরণ ও নীতিবিষয়ক বহু
প্রবন্ধ রচনা করেন।
নারীজাগরণের অন্যতম প্রচারমাধ্যম বামাবোধিনী
পত্রিকায় 'আশাবতী' ছদ্মনামে বহু প্রবন্ধ রচনা
করেন। পরে
সেগুলি "আশাবতীয় উপাখ্যান" নামে সংকলিত ও
সমাদৃত হয়। মানবাত্মা
বিকাশের অন্তর্নিহিত প্রেরণারূপ বহু ব্রাহ্মসংগীত রচনায়
বিজয়কৃষ্ণ এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের
ছাপ রেখে যান।
সেইসময়ে
কোলকাতার নাগরিক জীবনে এক
পালাবদলের কাল চলছে।
'বাবু কালচার'-এর বৃত্ত বহির্ভূত
আরেক নাগরিক সমাজ গড়ে
উঠছে আস্তে আস্তে।
আর তার আঁতুড়ঘর ছিলো
ব্রাহ্মসমাজ।
ব্রাহ্মসমাজে
সংকীর্তনমূলক সংগীত রচনায় গোস্বামী
মশাই এক পুরোধা ব্যক্তি। তাঁরই
অনুপ্রেরণায় ১৮৭৪ সালে সমাজের
উপাসনাগৃহে সর্বপ্রথম খোল-করতাল সহযোগে
ব্রাহ্ম সংকীর্তনের সূচনা হয়।
তাঁর চিন্তাধারা অনুযায়ী ব্রাহ্মদের মধ্যে সংকীর্তনমূলক সংগীত
প্রচারিত হলে যুক্তিবাদ, নীতিবাদ
ও তত্ববাদের সাথে সাথে ভক্তিবাদের
ভাবও সদস্যদের মধ্যে জাগ্রত হবে। ক্রমে
গুরুগম্ভীর ব্রাহ্মকুলের কৌলিন্যে মৃদঙ্গের সরস বোল, পরতে
পরতে ছড়িয়ে পড়ে।
"আপনি
আচরি ধর্ম, জীবেরে শিখায়"
এই মন্ত্রে উজ্জীবিতপ্রাণ বিজয়কৃষ্ণ মাঝেমধ্যেই অর্থাভাবে সম্পূর্ণ সহায়সম্বলহীন দীনহীন অবস্থায় দিনযাপন
করেছেন বহুকাল। কালক্রমে
এই স্ব-আচারী ধর্মমতের
প্রচারকে বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে
কেবলমাত্র সত্যনিষ্ঠার জোড়ে, শারীরিক ক্লেশ
ও জীবনের ঝুঁকি নিয়েও
গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পায়ে
হেঁটে, রোদ-ঝড়-বৃষ্টি-শীত উপেক্ষা করে
ব্রহ্মনামের অপার্থিব মাধুর্য্যকে অসম, বিহার, উত্তরপ্রদেশ
হয়ে সুদূর পাঞ্জাব অব্দি
ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। দুর্দান্ত
বাগ্মিতাসম্পন্ন গোস্বামীর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে অগণিত
সংস্কারবিলাসী জনগণ ছেড়েছেন সাতপুরুষের
তথাকথিত শুষ্ক নিয়মনীতি, ভেদাভেদ
দৃষ্টি। ভোগসুখে
হয়েছে বীতরাগ....... ক্রমশ
তথ্যসূত্রঃ
শ্রীমান্ শঙ্খ
No comments:
Post a Comment