Thursday, May 23, 2019

নীলপর্ব্বতের বগলামুখী পীঠ ও ভুবনেশ্বরী পীঠ


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ 
আজ বনেদীয়ানা' প্রকাশিত হল নীলপর্ব্বতের বগলামুখী পীঠ ভুবনেশ্বরী পীঠ, পরিবারের সদস্য শ্রীমান্ জয়দীপ ভট্টাচার্য্য আলোচনায় আজ নীলপর্ব্বতের বগলামুখী পীঠ ভুবনেশ্বরী পীঠ,গৌহাটি

জগৎপ্রসবিনী মা কামাখ্যার নিবাসস্থল পরমধাম নীলপর্ব্বতআসামের গৌহাটি শহরের উপকন্ঠে পুণ্যতোয়া ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেষে সবুজ প্রকৃতিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীলপর্ব্বতনীলপর্ব্বতে মা কামাখ্যার মন্দির ছাড়াও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আরো অনেক পীঠমন্দির,শিবালয় আশ্রমতেমনি রয়েছে দশমহাবিদ্যার আলাদা আলাদা পীঠমন্দির
কামাখ্যা মন্দিরের সামনে থেকে ভুবনেশ্বরী রোড ধরে পাহাড়ের উঁচুর দিকে কিছুটা গেলেই ডানদিকে রয়েছে শ্রীশ্রী বগলামুখী মায়ের পীঠমন্দিরের ফটকফটক দিয়ে ঢুকে পাহাড়ি পথ ধরে অনেকটা নীচে নেমে মায়ের মন্দির চোখে পরেসেখান থেকে আবার কিছুটা উপরে উঠে একটি ছোট্ট গুহায় প্রবেশ করতে হয়গুহর এক কোণে বিশালাকার এক পাথরের তলায় একটি খোপে সিদ্ধিদাতা গণেশের পীঠকোন বিগ্রহ বা পট নেই এখানে,শুধু খোপের ভিতর সিঁদুরে রাঙানো একটি প্রস্তরখণ্ড,আর তার সামনে জ্বলছে একটি প্রদীপএটাই শ্রীগণেশের পীঠস্থানবগলা মায়ের পুজোর আগে এখানে পুজো দেওয়ার রীতিগুহা শেষ হতেই আবারো উপরে উঠতে হয় অনেকটা,সেখানেই মূলমন্দিরের প্রবেশদ্বারের বামদিকে রয়েছে যজ্ঞঘর প্রদীপ প্রজ্বলনের যায়গাপ্রবেশদ্বার দিয়ে মন্দিরে ঢুকেই  বড় একটা প্রকোষ্ঠের একদিকে আরেকটি বিশালাকার পাথরের খোপে একটি কুণ্ডে মা বগলামুখীর পীঠশিলা,এখানেও কোন বিগ্রহ নেইপীঠশিলায় ত্রিশূলের আকৃতি একটি ধাতব বস্তু গাঁথা,এতেই পুজো হয় মায়েরভক্তরা ইচ্ছা করলে হলুদ ফুলের মালা,হলুদ বস্ত্র ত্রিশূলে পড়িয়ে মায়ের নামে অর্পণ করতে পারেকুণ্ডের একদিক খানিকটা নীচু,ঐখানেই পাহাড়ের পাথর চুঁয়ে আসা শীতল জল জমে থাকেমায়ের পীঠশিলায় সিঁদুর অর্পণ করার পর পীঠশিলা ছুঁয়ে প্রণাম করে কুণ্ড থেকে জল নিয়ে মায়ের চরণামৃত হিসাবে সেবন করার রীতিমা কামাখ্যার মতো মা বগলামুখীর এই পীঠমন্দিরও গৌহাটিবাসীর কাছে অতিপবিত্র,প্রায়শই ভীড় থাকে এই মন্দিরেওএই প্রকোষ্ঠের পাশেই আরেকটি অপেক্ষাকৃত বড় একটি প্রকোষ্ঠের একপাশের সম্পূর্ণটা জুড়ে একটা বিশালাকার পাথর,যেনো পর্ব্বতগর্ভ থেকে মুখ বের করে রেখেছেএই পাথরের পাদদেশে অনেকে গ্রহপূজা করানকথিত আছে মঙ্গলবারে এইখানে প্রথমে বগলামুখী পূজা করে তারপর গ্রহপূজা করালে মঙ্গলগ্রহের দোষ দূর হয়

আগে এখানে কোন মন্দির,ঘর,যজ্ঞঘর,সিঁড়ি কিছুই ছিলো নাখোলা আকাশের তলে পাহাড়ের ঢালে বসে এই পীঠশিলায় মায়ের পুজো করতে হতোমন্দিরে আসার সিঁড়িপথও ছিলো না,পাহাড় বেয়ে আসতে হতোবহুদিন আগে দারভাঙার মহারাজা পীঠশিলার কুণ্ডের চারপাশে ইটের দেওয়ালের উপর টিনের চাল দিয়ে দেনতারপর একসময় গৌহাটির এক ব্যবসায়ী মহাবীর শর্মা ছাদ দেওয়া পাঁকামন্দির নির্মাণ করানগ্রহপূজার প্রকোষ্ঠ,মন্দিরে আসার সিঁড়িপথও তিনিই তৈরী করিয়ে দেন
কিন্তু কখন আর কিভাবে এই বগলা পীঠে পূজা শুরু হলো তা কেওই জানেন নামন্দিরের পূজারি পাণ্ডা সুশীল শর্মাও এবিষয়ে অজ্ঞাত
বগলামুখী মায়ের মন্দিরের ফটক থেকে পাণ্ডা পাড়ার ভিতর দিয়ে ভুবনেশ্বরী রোড ধরে নীলপর্ব্বতের উপরের দিকে প্রায় ১৪০ ফুট উঁচুতে পর্ব্বতের একেবারে শিখরে রয়েছে শ্রীশ্রী ভুবনেশ্বরী দেবীর পীঠমন্দিরনীলপর্ব্বতের অন্যান্য মন্দির থেকে তুলনামূলক ভাবে অনেকটা নির্জন স্থানে পর্ব্বতের একেবারে চূড়ায় অবস্থিত মায়ের মন্দিরমায়ের নামে নীলপর্ব্বতের শিখরের নামও ভুবনেশ্বরী শিখরভুবনেশ্বরী মন্দিরের ফটক থেকে চোখে পরে সমস্ত গৌহাটি শহর,যেনো ছবিতে আঁকাশহরের বুক চিরে চলে গেছে ব্রহ্মপুত্রব্রহ্মপুত্রের বুকে দাঁড়ানো ভস্মাচল পাহাড়ও দেখা যায় এখান থেকে
মন্দিরের প্রধান ফটক থেকে ২৫/২৬ খানা সিঁড়ি বেয়ে আরো উপরে উঠে মা ভুবনেশ্বরীর নাটমন্দিরনাটমন্দিরের একদিকে একটি বেলবৃক্ষের বাঁধানো তলায় যজ্ঞকুণ্ডের সামনে প্রায় ফুটের একটি শ্বেতপাথরের নারীমূর্তিকিন্তু মূর্তিটির দুইদিকে একই রকম ভাবে খোদাই করা নারীঅবয়ব,কোন পৃষ্ঠদেশ নেই

এই বেলবৃক্ষের নীচেই ভক্তেরা মায়ের উদ্দেশ্যে ধূপদীপ প্রজ্বলন করেন,অনেকে মানতের সুতো বাঁধেন
তবে নারীমূর্তিটি কার বা কোথা থেকে এলো তা সবার অজানা
নাটমন্দিরের সামনের দিকে মায়ের গর্ভগৃহগর্ভগৃহের দ্বার থেকে অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে প্রায় / ফুট নীচে নেমে মন্দিরের সংকীর্ণ গর্ভগৃহে মা ভুবনেশ্বরীর পীঠশিলার কুণ্ডের ধারে পৌঁছানো যায়গর্ভগৃহে আলো বলতে কেবল টিমটিম করে জ্বলতে থাকা একটি প্রদীপশিখা

প্রদীপের ক্ষীণ আলো,ধূপের গন্ধ,মন্ত্রোচ্চারণের গম্ভীর ধ্বনি; ঠিক যেনো আদিযুগের কোন তান্ত্রিকের গুহা
গর্ভগৃহে ছোট্ট একটি কুণ্ডে মা ভুবনেশ্বরীর পীঠশিলা লালবস্ত্র রক্তজবায় আবৃত,এই মন্দিরেও কোন বিগ্রহ নেই,পীঠশিলাতেই পুজো হয় মায়েরভক্তরা চাইলে মায়ের পীঠশিলা ছুঁয়েও প্রণাম করতে পারেআসামের লোকবিশ্বাস এই পীঠে মায়ের পুজো দিয়ে পীঠশিলা স্পর্শ করলে আত্মা পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তিলাভ করেমা ভুবনেশ্বরীর মন্দির প্রথম নির্মিত হয় ৭ম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে,গর্ভগৃহের মেঝে দেখে বিশেষজ্ঞদের এই মতামত,কিন্তু কালের গ্রাসে একসময় এই মন্দির ভেঙে পরেতবে পুরোনো মন্দিরটি ৭ম শতাব্দীতে কে নির্মাণ করিয়েছিলেন তা এখনো ধোঁয়াশার চাদরে মোড়াঅনেককাল পরে একসময় টিনের চালাঘর নির্মিত হয় পুরোনো মন্দিরের ভিতের উপরেইতারও পরে গৌহাটি নিবাসী এক ব্যবসায়ী বেনারসিলাল শরাফ নতুন পাঁকা মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন,সেটিও পুরোনো ভিতের উপরেই,এটিই বর্তমানে মায়ের গর্ভমন্দিরএছাড়া ভুবনেশ্বরী মন্দিরের পাঁকাপোক্ত কোন ইতিহাস তেমন জানা যায় নামন্দিরের পূজারি পাণ্ডাও এই বিষয়ে বিশেষ কিছুই জানেন না
কামাখ্যা মন্দির নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও নীলপর্ব্বতের অন্যান্য মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে কেও তেমন আগ্রহী নন আশা করি অতিসত্বর গবেষকদের সজাগ দৃষ্টি  পরবে এইদিকেও
তথ্যসূত্রঃ শ্রীমান্ জয়দীপ ভট্টাচার্য্য



No comments:

Post a Comment