Friday, May 17, 2019

নলহাটীর নলাটেশ্বরী


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ 
 আজ আলোচনায় নলহাটীর নলাটেশ্বরী' ইতিহাস বনেদীয়ানা' গুরুত্বপূর্ন সদস্য শ্রীমান্ শুভদীপ, নলাটেশ্বরী সতীপীঠের ইতিহাসের কিছু অংশ তুলে ধরলেন


নলহাটীর নলাটেশ্বরী রামপুরহাট
আনুমানিক পাঁচশ বছর আগে, ৯০০ সনের আষাঢ় মাসের শুক্ল নবমী তিথিতে পাইকপাড়া গ্রামে রামশরণ শর্মা নামে জনৈক ব্যবসায়ী তথা সাধককে স্বপ্ন দিয়ে মহামায়া অধিষ্ঠিতা হন নলহাটীতে কলকাতা থেকে নলহাটীর দূরত্ব দু'শো আঠাশ কিলোমিটার রেলস্টেশন থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে একটি টিলার ঢালে পার্বতী মায়ের মন্দির একেই মানুষজন নলাটেশ্বরী মন্দির নামে চিহ্নিত করেন এখানে দেবীর নলা পড়েছিল বলে নাম হয়েছে নলাটেশ্বরী কিছু মানুষের মতে, মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন রামশরণ শর্মা  বাণিজ্য করতে এসে রামশরণ শর্মা মন্দির তৈরীর জন্য স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন
 এই মন্দির একান্ন পীঠের একটি পীঠ হিসাবে চিহ্নিত পীঠ নির্ণয়ের বর্ণনায় চতুশ্চত্বারিংশৎ শক্তিপীঠ হল নলহাটী সেখানে বর্ণিত রয়েছে-
"নলাহাট্যাং নলাপাতো যোগীশো ভৈরবস্তথা
 তত্র সা কালিকা দেবী সর্বসিদ্ধি প্রদায়িকা"
অর্থাৎ নলহাটীতে পড়েছে সতীর নলা দেবীর নাম এখানে- কালী ভৈরবের নাম- যোগীশ
 সংস্কৃত শব্দ 'নলক' যার অর্থ দীর্ঘ অস্থি, বাংলায় তারই ত্রুটিপূর্ণ উচ্চারণ হল নলা অনেকের বিশ্বাস, এখানে পড়েছে দেবীর ললাট কিন্তু শাস্ত্র, পুরাণে রয়েছে এই স্থানে পড়েছিল দেবীর নলা বহু ক্ষেত্রে শোনা যায় যে, সেই স্থানের সাহা জমিদার মন্দিরটি তৈরী করেছিলেন বৈষ্ণব জমিদার রাজা উদয়নারায়ণ মন্দিরের জন্য অনেক জমি দান করেছিলেন পার্বতীর ভৈরব যোগীশের ভিত খোঁড়ার সময় একটি পাথর পাওয়া গিয়েছিল সেখানে আঁকা ছিল নারায়ণের পদচিহ্ন ওই পাথরটিকে মন্দিরে গেঁথে রাখা হয়েছে
 স্থানীয় সমাজসেবী অমিয় কুমার চট্টোপাধ্যায় বললেন, অতীতে মন্দিরের পেছনে দুটি প্রস্রবণ ছিল দেশ-বিদেশ থেকে অনেক মানুষ এখানে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্য আসতেন বেশিরভাগ মানুষ সেই প্রস্রবণের ঠাণ্ডা জল খেতেন পরে সেগুলি বন্ধ হয়ে যায় এখন সেখানে পুকুরের মতো হয়ে আছে এখানে একটি গড় ছিল মন্দিরের পেছনে টিলার মাথায় বর্গী যুদ্ধের পির কেবালা আশা শহিদের মাজার আছে বাংলার শেষ নবাব মীরকাশিমের সঙ্গে ব্রিটিশের যুদ্ধ হয়েছিল উদয়নালার মাঠে, যা টিলার ওপর থেকে দেখা যায় পিরবাবার মাজারের পেছনে একটি নিমগাজ ছিল ওই নিমগাছের মন্দিরের দিকের পাতাগুলি ছিল তিতো আর অপরদিকের পাতাগুলি ছিল মিষ্টি সেই নিমগাছের কথা বললেন অমিয় কুমার চট্টোপাধ্যায়
 ১৯৬৪ সালে মন্দিরের কাছাকাছি জায়গা থেকে প্রস্তরযুগের কিছু টাকা, পয়সা মূর্তি আবিষ্কৃত হয় এখন সেগুলি যাদুঘরে রাখা আছে উল্লেখ করা প্রয়োজন, রামশরণ শর্মার বংশধররা এখনও নলহাটীতে বসবাস করেন তাঁরাই বলেন, এই মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর সম্পর্কে স্বপ্নাদিষ্ট হন রামশরণ শর্মা বামদেব তারাপীঠ থেকে এখানে প্রায়ই আসতেন এবং চারদিন-পাঁচদিন থেকে যেতেন
 ১৯৯৪-৯৫ সালে একসময় দেবীর মাহাত্মকথা শোনা যায় সেইসময়ে মন্দিরের অবস্থা খুবই খারাপ অবস্থা হয়েছিল ছাদ থেকে জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ত মায়ের পুজো হত কোনওরকমে আস্তে আস্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে ১৯৯৬ সালের পর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে নলাটেশ্বরী একান্ন পীঠের অন্যতম এবং মায়ের নলা এখানে পড়েছে নলহাটী নামের নামকরণ নিয়েও দ্বিমত রয়েছে একপক্ষের মতে, রাজা নলের নামে জায়গার নাম নলাটেশ্বরী রাখা হয়েছে আবার অন্যমতে দেবীর অঙ্গ পতনের জন্যই এই জায়গার নাম নলাটেশ্বরী হয়েছে

 এই নলাটেশ্বরী এক ঐতিহাসিক জায়গা লুণ্ঠনকারীদের জায়গা হিসাবে চিহ্নিত বর্গীডাঙ্গা আছে এখানে মাটির তলায় জায়গার সন্ধান পাওয়া গেছে সেখানেই বর্গীরা আশ্রয় নিত একসময় এখানে মুসলমান বর্গীদের মধ্যে যুদ্ধও হয়েছিল নলহাটী নাকি তিনটি রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত মুসলমান রাজত্বের সময় মহাদেব যোগীশকে নলহাটী থেকে সরিয়ে 'হরিওকা'-তে নিয়ে যাওয়া হয় নলহাটী থেকে জায়গাটির দূরত্ব সাড়ে তিন কিলোমিটার
নলহাটীর ব্যবসায়ী-ভক্ত কমল চন্দ্র মসকরা আরও বলছেন, নলহাটীতে রাজপরিবারের বাড়ি এখনও আছে রাজারা যখন মা নলাটেশ্বরীকে প্রণাম করতে যেতেন তখন চারদিক জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল অঞ্ছলটি এতটাই জঙ্গলে ঢাকা ছিল, দর্শনার্থীরা সকাল সকাল মাকে দর্শন করে ফিরে যেতেন মা নলাটেশ্বরী মন্দিরের জন্য রাণী ভবানী তিনশো পঁয়ষট্টি বিঘা জমি দান করেন এখানে মায়ের বাগান আর একটা বাবার বাগান ছিল মায়ের পুজোর জন্য রাণীমা সব ব্যবস্থাই করেছিলেন
তথ্যঋণঃ হিমাংশু চট্টোপাধ্যায় রচিত-"৫১পীঠ"
কিভাবে যাবেনঃ শিয়ালদহ থেকে গৌড় এক্সপ্রেস বা অন্য কোন ট্রেনে রামপুরহাট নেমে সেখান থেকে ২০মিনিটের মধ্যে নলহাটিতে যাওয়া যায় স্টেশন থেকে নলাটেশ্বরী মন্দির রিকশায় যেতে সময় লাগে ১০-১৫ মিনিট
তথ্য লিপিবদ্ধেঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী


No comments:

Post a Comment