Monday, June 10, 2019

উত্তর কলকাতার ভাগ্যকুল রাজবাড়ি


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ
 আজ প্রকাশিত হল উত্তর কলকাতার ভাগ্যকুল রাজবাড়ির তথ্য, লিখলেন বনেদীয়ানা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যা শ্রীমতী দেবযানী বসু মহাশয়া আলোচনায় আজ ভাগ্যকুল রাজবাড়ি
 উত্তর কলকাতার শোভাবাজার স্ট্রীটে ভাগ্যকুল রাজবাড়ির দুর্গোৎসব পূর্ববঙ্গ থেকে হয়ে আসা এক পরিবারের ঐতিহ্যের কাহিনী পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলার অন্তর্গত পদ্মানদীর উপকূলবর্তী একটি গ্রামের নাম ভাগ্যকুল ভৌগোলিক সীমারেখায় এই গ্রামের পরিধি খুব বিস্তৃত নয়, কিন্তু ভাগ্যকুল রাজ পরিবারের কীর্তিকলাপ অবদান অকাতর দানের জন্য বিখ্যাত একদা রায় পরিবারের পূর্বপুরুষদের বাস ছিল বিক্রমপুর সেখানেই এক সাধারণ পরিবারে জন্ম ভাগ্যকুল রাজবাড়ির প্রথমপুরুষ কৃষ্ণজীবন কুণ্ডু তাঁর আকস্মিক প্রভূত অর্থলাভের কাহিনী রাজা হওয়ার ঘটনা প্রায় অলৌকিক কৃষ্ণজীবন ঢাকার ধনী ব্যবসায়ী জীবন সাহার এস্টেটে চাকরি করতেন তিনি কলকাতায় এসে সস্তায় সোনা আর লবন কিনে পরে চড়া দামে বিক্রি করে প্রচুর লাভ করতেন একবার কৃষ্ণজীবন মনিবের আদেশে কলকাতায় আসেন সোনা কিনতে এসে দেখলেন সোনা ক্রয় করার সুযোগ পেরিয়ে গেছে তখন তিনি মনিবের আদেশ ছাড়াই এক জাহাজ লবন কিনলেন কিন্তু এতে জীবন সাহা বিরক্ত হয়ে বললেন- নিজের ইচ্ছায় লবন ক্রয় করেছ এর লাভ লোকসান সব তোমার মাসখানেকের মধ্যে লবনের দাম বাড়ল, লাভ হল পঞ্চাশ হাজার টাকা জীবন সাহা তাঁর কথা রাখলেন সম্পূর্ণ লাভের টাকা দিয়ে দিলেন কৃষ্ণজীবনকে ব্যবসা শুরু করলেন তিনি বিত্তবান হয়েও কৃষ্ণজীবন ছিলেন অত্যন্ত দানী দয়াবান তাঁর অকাতর দানের কথা শুনে এবং মহত্বের পরিচয় পেয়ে তখনকার নবাব জায়গীর "রায়" উপাধি প্রদান করলেন পত্তন হল জমিদারীর এরমধ্যে কৃষ্ণজীবনের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র রামচন্দ্র কুণ্ডু(রায়) রায় বংশের প্রতিষ্ঠা করেন ৩০০বছর আগে অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভাগ্যকুলে (তখনকার নাম ছিল ভাগারকুল) গড়ে ওঠে বিশাল এক মহলা বাড়ি, দুর্গাদালান, কাছারিবাড়ি ইত্যাদি এইসময় থেকে দুর্গাপুজোও শুরু করেন তাঁরা ১৯৩৫ সালে দাঙ্গা বাঁধল, দেশের তৎকালীন পরিস্থিতিতে ভাগ্যকুলের রায় পরিবার ওদেশ ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়
 কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলের আশেপাশে ভাগ্যকুল রায় বংশের বর্তমান উত্তরসুরিরা থাকেন অনেকগুলি বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দুর্গাপুজো যদিও শোভাবাজার স্ট্রীটের বাড়িতে হয়, তবে পালা হিসাবে পুজো চলে এই পরিবার বৈষ্ণবীয় ভাবধারায় সমৃদ্ধ তাই বৈষ্ণব মতে পুজো হয় ডাকের সাজের অনিন্দ্যসুন্দর প্রতিমা, উচ্চতায় ১০ফুটেরও বেশী পুজোয় পনেরো দিন আগে থেকে চঁণ্ডীর ঘট বসে, শুরু হয় চণ্ডীপাঠও পূর্ববঙ্গীয় রীতিতে এই পরিবারের দুর্গাপ্রতিমার ডানদিকে কার্তিক এবং বামদিকে গনেশ থাকেন প্রতিমার বৈচিত্রের মতন বিজয়া দশমীও পালিত হয় একটু অন্যভাবে দশমীর সকালে দশমীর সকালের প্রথম অনুষ্ঠান 'টাকাযাত্রা' বাড়ির মেয়ে এবং পুরুষরা স্নান করে গরদের লালপেড়ে শাড়ি ধুতি চাদর পরে আসেন দুটো বাটিতে রুপোর টাকা, পদ্মফুল, ধান, দূর্বা, খাগের কলম রাখা হয় তারপর বাড়ির পুরুষরা একটি বাটি নিয়ে কুলদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণ জীুউ' মন্দিরে এবং আর একটি বাটি নিয়ে দুর্গামণ্ডপে আসেন গৃহদেবতা দুর্গামায়ের পায়ে ছুঁইয়ে এই দুটি বাটি যে যার ঘরে নিয়ে যায় ব্যবসায়ী পরিবারের এই বিশেষ রীতি টাকাযাত্রা
 টাকাযাত্রার পর থাকে দেবীর বিসর্জন পর্ব এরপর মায়ের প্রতিবিম্ব দর্শন, তারপর দর্পন বিসর্জন দুপুরে থাকে ইলিশ বিদায় পর্ব দশমীর মেনুতে থাকবে ইলিশের নানান পদ, মাছভাজা ইত্যাদি এইদিন সকলে ইলিশের ভোগ গ্রহণ করবেন এরপর সরস্বতীপুজো পর্যন্ত বাড়িতে ইলিশমাছ ঢুকবে না সন্ধ্যায় মহিলাদের বরণপর্ব শেষ করে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিমা বিসর্জন ফিরে এসে দুর্গামণ্ডপে বেদীর নীচে দেবদেবীর নাম লেখেন বাড়ির পুরুষেরা তারপর পুরোহিত বাড়ির সবার গায়ে ইদুঁরমাটি ছিটিয়ে দেন মহিলারা সেই মাটি সংগ্রহ করে ঘরে রাখে পুঁটলি করে এই বিশ্বাস যে, এই মাটির মতন ঘরের ধন-ঐশ্বর্যও বৃদ্ধি পাবে দশমীর শুভেচ্ছা বিনিময় সেরে ঘরে ফেরার সময় দরজায় জ্যান্ত জোড়া মাগুরমাছ দেখে তবে ঘরে ঢোকেন সবাই বহুকাল ধরে ভাগ্যকুল রায় পরিবারে প্রাচীন রীতি হয়ে আসছে পুরোনো রীতিনীতি, দেবীর পূজায় এবং সেবায় সজাগ দৃষ্টি অন্য বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ করেছে ভাগ্যকুল রাজবাড়ির দুর্গোৎসবকে
তথ্যসূত্র এবং চিত্রেঃ শ্রীমতী দেবযানী বসু(সাংবাদিক)


No comments:

Post a Comment