Monday, June 17, 2019

রাণী রাসমনির দক্ষিণেশ্বরঃ



দক্ষিণেশ্বর মন্দির ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কেন্দ্র, যার রয়েছে রয়েছে দেশের ধর্ম আন্দোলনের ইতিহাসে প্রধান ভূমিকা বাংলার তথা ভারতবর্ষের নবজাগরণের এক ঐতিহাসিক কেন্দ্র এই মন্দির আর এই ধর্মীয় নবজাগরণের উৎসভূমির স্রষ্টা রাণী রাসমনি সমাজকে দেওয়া তাঁর যুগান্তরকারী উপহার সাধক শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ, যে রামকৃষ্ণ এনেছিলেন যুগান্তকারী ধর্মীয় নবজাগরণ সেই সাধককে আবিষ্কার করাই শুধু নয়, তাঁর সাধনার পীঠভূমিও প্রস্তুত করে রেখেছিলেন দূরদ্রষ্টা আধ্যাত্মিক দিব্যদৃষ্টিসম্পন্না রাসমনি
 সাধকের উপাসনার উপযুক্ত করেই যেন প্রকৃত স্থানটি সাজিয়ে রেখেছিলেন একদিকে অনন্ত প্রবাহমানা স্রোতস্বিনী পতিত পাবনী, পাশেই গহন গভীর অরণ্য তারই মাঝে ভূমিটি কচ্ছপাকৃতি এই ভূমিটি বাছলেন তিনি যেন কোনো এক সাধনার পীঠভূমি তৈরির জন্যই আর সেই পীঠভূমিতেই অনেক, অনেক বছর পরে এক বিদেশিনি এসে উপলব্ধি করলেন- তিনি, হ্যাঁ তিনিই হলেন সেই মানুষ যিনি না থাকলে জন্ম হত না এতবড় সাধকের, যিনি এই সাধককে না চিনলে চিনতনা এই দেশ, এই বিশ্বচরাচর
 মার্গারেট অর্থাৎ ভগিনী নিবেদিতা বলেছেনঃ-
"A woman of the people had been, in a sense, the mother of that whole movement of which all the disciples of his Master formed parts. Humanly speaking, without the Temple of Dakshineswar there had been no Ramakrishna, without Ramakrishna, no Vivekananda, and without Vivekananda no Western Mission. The whole story rested on the building, erected on the Ganges side, a few miles above Calcutta, just before the middle of the nineteenth century.And that was the outcome of the devotion of a rich woman of the lower castes a thing that under a purely Hindu government, bound to the maintenance of Brahmin supremacy, would never have been possible, as the Swami himself was not slow to point out."(The Master as I saw Him. p.g-277-78)
শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের জননী যে রাসমনি, তাই বর্ণনা করে গেছেন নিবেদিতা সমগ্র রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের মূলে যে একজন নারী যিনি সাধারণ শ্রেণী থেকে উদ্ভূত নিবেদিতার কথায় দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠিত না হলে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই হতেন না, আর শ্রীরামকৃষ্ণ না হলে বিবেকানন্দও বিবেকানন্দ হতেন না, এবং বিবেকানন্দ না হলে পাশ্চাত্য মিশনও হতে পারত না অর্থাৎ পাশ্চাত্যে হিন্দু ধর্মও প্রচার হতে পারত না নিবেদিতা রাণি রাসমনিকে শুধু রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনের জননী রূপেই বর্ণনা করেননি, তাঁকে 'Women of the people' অর্থাৎ লোকমাতা বলেও বর্ণনা করে গেছেন
  রাণি রাসমনি মন্দির স্থাপনের জন্য বারাণসী সমতুল্য গঙ্গার পশ্চিমদিকে বালী,  উত্তরপাড়া প্রভৃতি অঞ্চলে জমি সংগ্রহের চেষ্টা করেন, কিন্তু অঞ্চলের জমিদাররা রাণি রাসমনির প্রচুর অর্থের বিনিময়েও কোন স্থান বিক্রি করতে অনিচ্ছুক হন কারণ তাঁদের জমিদারির মধ্যে অপরের ব্যায়ে নির্মিত ঘাটে গঙ্গায় স্নান করা, নিজেদের আভিজাত্যের দরুন তারা পছন্দ করেননি অগত্যা রাণী রাসমনি গঙ্গার পূর্বকূল মন্দির নির্মাণের জন্য কেনেন
 কলকাতা থেকে ৫মাইল উত্তরে গঙ্গার পূর্বকূলে উত্তর চব্বিশ পরগনার মধ্যে এই দক্ষিণেশ্বর গ্রাম দক্ষিণেশ্বর নাম তখন জনগনের মধ্যে পরিচিত ছিল না এবং তা জনবহুলও ছিল না মাঝে মাঝে জঙ্গল, বাগান, পুষ্করিণী, কবরস্থান প্রভৃতি ছিল এই অঞ্চলে এখানে তৎকালীন স্থাপিত একমাত্র সরকারি বারুদখানা ম্যাগাজিনের, আর কিছু ইংরেজ স্থানীয় জমিদারদের ঘোড়ার গাড়ি যাতায়াত করত হিন্দুদের সাথে কিছু ইংরেজ মুসলমানের বসতি ছিল ইংরেজদের গির্জা না থাকলেও মুসলমানের "মাজার" বা "দরগা" ছিল বর্তমান দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছেই মোল্লাপাড়ায় একটি মসজিদও ছিল, যেখানে পরবর্তীকালে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব নামাজ পড়তে যেতেন
 বড়িশার প্রখ্যাত জমিদার সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের দুর্গাপ্রসাদ রায় চৌধুরী এবং ভবানীপ্রসাদ রায় চৌধুরী বড়িশা থেকে এসে দক্ষিণেশ্বরে যখন বসবাস শুরু করেন, তখন তাঁরাই এখানকার বনজঙ্গল পরিষ্কার করিয়ে গ্রামটির উন্নতি সাধন করেন বহু লোক এনে তাদের বসতি স্থাপন করান এই বংশের যোগীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপালাভ করেন স্বামী যোগানন্দ নামে পরিচিত হন
 নামটি "দক্ষিণেশ্বর"- তাই এখানে "ভুবনেশ্বর", "তারকেশ্বর"," বক্রেশ্বর" প্রভৃতি স্থানের মতোন কোন শিবের সন্ধান পাওয়া যায় কিনা, সেই নিয়ে গবেষণায় লক্ষ্য করা যায়, বহুকাল আগে দেউলিপোতার জমিদার বানরাজা নাকি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে একটি শিবের সন্ধান পান তার নিত্যসেবার জন্য তিনি মন্দিরও স্থাপন করেন দক্ষিণবঙ্গে শিবটি প্রাপ্ত হওয়ার ফলে নামকরণ হল- 'দক্ষিণেশ্বর' সেখান থেকে গ্রামটির নামও দক্ষিণেশ্বর হয় দক্ষিণেশ্বরের শিবতলা ঘাটের বুড়োশিবকেই সবাই 'দক্ষিণেশ্বর শিব' বলে মনে করেন দক্ষিণ দিকের অধিপতিকে দক্ষিণেশ্বর বা দক্ষিণের ঈশ্বর বলা হয় দক্ষিণেশ্বরের আদি নাম- শোণিতপুর বা সম্বলপুর
 দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির স্থাপনের পর আরও অনেক মঠ-মন্দির স্থাপিত হয় শ্রীরামকৃষ্ণ মহামণ্ডল, সারদা মঠ, যোগদামঠ, হরগৌরী মন্দির, আড়িয়াদহের "গদাধর পাঠবাড়ী"- অবশ্য অনেক প্রাচীন, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে থাকাকালীন যেতেন
 রাণী রাসমনির দলিল থেকে জানা যায়, এখানকার মোট সাড়ে চুয়ান্ন বিঘা স্থানটি ৪২হাজার ৫০০টাকায় কিনেছিলেন-কুঠিবাড়ী সমেত এই কুঠিবাড়ীটিই এই উদ্দানের আদিবাড়ী,যা সামান্য সংস্কার হলেও এখনও প্রায় অপরিবর্তিত আছে
 ১৮৪৭সালে ৬সেপ্টেম্বর "বিল অফ সেল" এর মাধ্যমে জমিটি কেনা হলেও সেটি তখন রেজিস্ট্রি করা হয়নি, কারণ তখন রেজিস্ট্রেশন আইন ছিল না পরে এই আইন বলবৎ হলে ১৮৬১ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি রাণি রাসমনি সম্পাদিত আরেকটি দেবত্তর দলিলের মধ্যে "বিল অফ সেল" এর উল্লেখ করেন, সেই দলিল ১৮৬১সালে ২৭শে আগস্ট আলিপুর রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি হয়, রাণি রাসমনির দেহত্যাগের ৬মাস পর রেজিস্টার ছিলেন তারকনাথ সেন
 রাসমনি যখন জমিটি কেনেন তখন তার চৌহদ্দি ছিল-পূর্বদিকে কাশীনাথ রায় চৌধুরীর জমি,  পশ্চিমদিকে গঙ্গা, উত্তরদিকে সরকারি বারুদখানা এবং দক্ষিণব জেমস হেস্টিংসের কারখানা জমিকেনার পর পূর্বদিকে লোকালয় গড়ে ওঠে- বর্তমানে তার কতকঅংশ রেলওয়ে কোয়ার্টার
 দক্ষিণেশ্বরের জমি কেনার সঙ্গে সঙ্গেই ১৮৪৭-৪৮ সালে, এখানকার যাবতীয় নির্মাণ কাজ শুরু হয়, প্রথমদিকে রাণির প্রধান সহায়ক ছিলেন তার জ্যেষ্ঠ জামাতা রামচন্দ্র দাস পরে রাণি রাসমনির তৃতীয় জামাতা মাথুরমোহন বিশ্বাসের ওপরই কাজের সমুদয় দায়িত্ব ন্যস্ত হয় রাণি রাসমনি যেমন তার জামাতার থেকে সমস্ত কাজের খোঁজ নিতেন তেমনি নিজেও মাঝেমাঝে পরিদর্শন করতেন
মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য জমি কেনার পর মাটি ফেলে তা উঁচু করতে, নদী তীরে বাঁধ দিতে, ঘাট উদ্যান ইত্যাদি তৈরী করতে রানিকে আরো অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়েছিল কিন্তু নদীতে প্রবল বানের কারণে বাঁধ-ঘাো সব ভেঙ্গে গেলে রানি মথুরামোহনের পরামর্শে মন্দির ঘাট নির্মাণের ঠিকাদারি দিলেন ম্যাকিন্টস্ বার্ন কোম্পানীকে ১৮৫০ সালে বার্ণ কোম্পানী এই কাজের দায়িত্ব নিলেন অসাধারণ স্থাপত্য কীর্তির দৃষ্টান্ত এই মন্দিরটি নির্মাণ সংস্থা রাণির মনের মতন করেই তৈরী করেছিল দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির তৈরি হয়েছে নবরত্নের গঠন বৈশিষ্ট্যে এই মন্দির উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তৈরি হয় তখন বঙ্গীয় স্থাপত্য রীতির সঙ্গে ইউরোপীয় স্থাপত্য-রীতির বহুলাংশে মিল ছিল মন্দিরের খিলানগুলো পত্রাকৃতি বা পাতার আকারের রত্নগাত্রে বা চূড়াগুলোর শিল্পকীর্তি অপূর্ব
 গঙ্গার ধারে পোস্তা, বাঁধ প্রভৃতি কাজ হওয়ার পর উত্তর-দক্ষিণ বরাবর গঙ্গার দিকে একই নকসা অনুযায়ী ১২টি শিবমন্দির, চাঁদনি, মন্দিরের পূর্বদিকে-উত্তর-দক্ষিণ বিস্তৃত মাটির টালি বাঁধানো একটি চতুষ্কোণ প্রাঙ্গন তৈরী করা হয় আয়তন যার- ৪৪০ফুট লম্বা ২২০ফুট চওড়া মন্দিরের সমগ্র এলাকার তিনপাশে দালানবাড়ী তৈরী করা হয় মন্দিরের এলাকার বাইরে উত্তর দক্ষিণে একটি করে নহবতখানা নির্মাণ করা হয় মন্দিরের নির্মাণ শুরু হয় ১৮৪৭-৪৮ সালে এবং মন্দির নির্মাণ সমাপ্ত হয় ১৮৫৪সালে
 সমস্ত কাজ সমাপ্ত হলেও রাণি রাসমনির কাজে বাঁধা পড়ল উপযুক্ত দিনে মন্দির প্রতিষ্ঠা দেবীকে অন্নভোগ দেওয়ায় যখন রাণী রাসমনি সচেষ্ট তখনই তিনি কঠিন বাঁধার সম্মুখীন কারণ রাণী জাতিতে শূদ্র হওয়ায় সামাজিক প্রথা অনুযায়ী কোন ব্রাহ্মণ এমনকি রাণীর গুরুদেবও দেবীকে অন্নভোগ দিতে রাজী ছিলেননা তখন কলকাতার ঝামাপুকুর চতুষ্পাঠীর পণ্ডিত রামকুমার চট্টোপাধ্যায় তিনি বিধান পাঠান তিনি বলেন মন্দির প্রতিষ্ঠার আগে কোন ব্রাহ্মণকে মন্দির দান করা যায় ব্রাহ্মণ যদি দেবীকে প্রতিষ্ঠা করে অন্নভোগ দেন তাহলে তা অশাস্ত্রীয় নয় অগত্যা রাণী রাসমনি এই উদার মতাবলম্বী ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকেই কাজ করার জন্য আহ্বান করেন সমস্ত বাঁধা থাকলেও রামকুমার তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামকৃষ্ণকে(গদাধর) নিয়ে রাসমণির ইচ্ছায় বৃহস্পতিবার স্নানযাত্রার দিন ১৮৫৫সালে ৩১শে মে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন
যে-সময়ে এই মন্দিরটি নির্মিত হয় সে-সময়ে বাঙলার মন্দিরের সূত্রধর, শিল্পী সব অবলুপ্তির পথে মূল মন্দিরের স্থাপত্য, মনোমুগ্ধকারী গঠননৈপুণ্য বিন্যাস-লালিত্যের অন্তরালে কোন স্থপতির প্রতিভা সেদিন মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল তার নামধাম জানা যায় না কিন্তু মন্দিরের পরিকল্পনাতে নিকটবর্তী তিনটি মন্দিরের প্রভাব যে সুস্পষ্টরূপে প্রতিফলিত হয়েছিল তা David Macutchi এর The Temples of Calcutta in Bengal: Past & Present & Late Mediaeval Temples of Bengal, পঞ্চানন রায়ের "কলকাতার মন্দির মণ্ডপ" এবং লোকগাথা বা প্রচলকথা থেকে জানা যায় দক্ষিণেশ্বরের নবরত্ন মন্দিরের গঠনশৈলীর সঙ্গে সাদৃশ্য ছিল বাওয়ালীর রামনাথ মণ্ডলের প্রতিষ্ঠিত টালিগঞ্জের রাধাকান্ত মন্দির(১৮০৯সালে প্রতিষ্ঠিত), পাথুরিঘাটার ধনপতি দর্পনারায়ণ ঠাকুরের পুত্র গোপীমোহন ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত মূলাজোড়-শ্যামনগরের ব্রহ্মময়ী মন্দির(১৮০৮সালে প্রতিষ্ঠিত) লোকগাথা প্রচলকথার সূত্রধরে টালিগঞ্জের পশ্চিম পুঁটিয়ারীতে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের নন্দদুলাল রায় চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত মা করুণাময়ী কালী মন্দিরের গঠনশৈলী(১৭৬০সালে প্রতিষ্ঠিত) দ্বাদশ শিবের বারোটি আটচালা মন্দির সহ মা করুণাময়ীর সুউচ্চ নবরত্ন মন্দির স্থাপিত হয়েছিল আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে ১৭৬০সালে লোকগাথায় কথিত আছে ১৮৫০সালে রাণী রাসমনি নবদ্বীপ দর্শন করে ত্রিবেণী সাগর সঙ্গমে পুণ্যস্নান করে আদিগঙ্গা দিয়ে ফেরার পথে নদীর উপকূলে মা করুণাময়ী মন্দিরের অপূর্ব শোভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং মনে মনে সঙ্কল্প করেন তিনিও দক্ষিণেশ্বরের মা জগদীশ্বরী ঠাকুরানীর মন্দিরও এই একই আঙ্গিকে তৈরী করবেন ১৮৫০ সালে ম্যাকিন্টস্ বার্ন কোম্পানী এই তিনটি মন্দিরের শিল্পকলার উন্নততর সংস্কার সমন্বয় ঘটিয়ে দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দিরের নক্সা প্রস্তুত করেছিল 
 প্রতিষ্ঠার দিন রাসমণির আহ্বানে ভট্টপল্লী,মূলাজোর, বিক্রমপুর,চট্টোগ্রাম,শ্রীহট্ট ছাড়াও কাশী, পুরী, মাদ্রাজ, কনৌজ, মিথিলা প্রভৃতির ব্রাহ্মণ উপস্থিত ছিলেন, প্রায় লক্ষাধিক এই ঐতিহাসিক মহোৎসবে রাসমণি "অন্নদান-যজ্ঞ" করেন পূজাদান ছাড়াও "দধি-পুষ্করিণী", "পায়েস-সমুদ্র", "ক্ষীর-হ্রদ", "দুগ্ধ-সাগর", "তৈল-সরোবর", "ঘৃত-কূপ", "লুচি-পাহাড়", "মিষ্টান্ন-স্তূপ" এর বিশাল আয়োজন করেন রাণি রাসমনি প্রায় লক্ষাধিকের ওপর টাকা ব্যায় করেছিলেন
 শাস্ত্রমতে বেদ তন্ত্র-দুই প্রকারের দেববিগ্রহ প্রতিষ্ঠার জন্য রাঢ়ী বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণকে পূজার কাজ দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ন ব্রাহ্মণের তালিকাঃ
.রাণীর গুরুদেব রামসুন্দর চক্রবর্তী, . রাণীর পুরোহিত উমাচরণ ভট্টাচার্য্য,. বৈকুণ্ঠনাথ ন্যায়রত্ন,. চণ্ডীচরণ বিদ্যাভূষণ,. কেশবচন্দ্র তর্কবাগীশ, . ঠাকুরদাস বিদ্যালঙ্কার, . রামকুমার তর্কালঙ্কার, . পীতাম্বর চূড়ামণি, . মধুসূদন তর্কালঙ্কার, ১০. সীতারাম বিদ্যাভূষণ প্রভৃতি
১৮৫৫সালে মন্দির প্রতিষ্ঠার কয়েকদিন পরে ভাদ্রমাসে নন্দোৎসবের দিন পূজক ক্ষেত্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের অনবধানতায় গোবিন্দজীর মূর্তির একটি পা ভেঙে যায় ভগ্নমূর্তি গঙ্গায় নিক্ষেপ করার পরিবর্তে যুবক শ্রীরামকৃষ্ণের ঐতিহাসিক বিধানে ভগ্নমূর্তির পা টি জোড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মাথুরমোহনের অনুরোধে শ্রীরামকৃষ্ণ বিগ্রহের ভগ্নাংশ নিখুঁতভাবে জুড়ে দেন সেই বিগ্রহের পূজা হতে থাকে বিষয়ে আরও একটি মত আছে একমতে রামকৃষ্ণদেবের মেরামত করা বিগ্রহের পূজা কখনো করা হয়নি অপরমতে ১৯৩০সালে ভাঙা পায়ের জোড়া কতকটা খুলে যাওয়ায় নতুন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে পূজা হতে থাকে
 এই মন্দিরের সাথে  রয়েছে এক ঐতিহ্যময় ইতিহাস রাণী রাসমনির জন্ম হয়েছিল সাধক রামপ্রসাদের মহাপ্রয়াণের ১২বছর পর এবং স্বামী বিবেকানন্দের যুগান্তরকারী শিকাগো বক্তৃতার (১১ই সেপ্টেম্বর,১৮৯৩) ঠিক ১০০বছর আগে হালিশহরের কোনায় ২৬শে সেপ্টেম্বর ১৭৯৩সালে রানী রাসমনি জন্মগ্রহণ করেন হালিশহরের গৌরবময় ইতিহাস দেখলে দেখা যায় সেন যুগে বিজয় সেনের এই রাজধানী শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বহু শিব মন্দির পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে হালিশহরে সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের আদিপুরুষ পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে পাঁচুশক্তি খান সুপ্রসিদ্ধ হালিশহর সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন কামদেব বিদ্যাবাচস্পতি ছিলেন সাবর্ণ পরিবারের একজন সুখ্যাত নৈয়ায়িক তাঁর নামে প্রবাদ লোকের মুখে মুখে ফিরতো- "কাম-কমল-গঙ্গেশ, তিন নিয়ে বঙ্গদেশ"এই কাম হলেন কামদেব বিদ্যাবাচস্পতি এই বংশের উচ্চমার্গের তন্ত্রসাধক ছিলেন রামকৃষ্ণ রায় চৌধুরী(১৬৫২) রামপ্রসাদের কাব্যেও তাঁর উল্লেখ আছে তাঁর সাধন ক্ষেত্রে সাধনা করে রামপ্রসাদ সিদ্ধিলাভ করেছিলেন রামকৃষ্ণের অধস্তন বিদ্যাধর রায় চৌধুরী একজন অনন্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষ ছিলেন তিনিই প্রথম হালিশহরে শিব-শ্যামা-শ্যামরায় বিগ্রহ একটি কষ্টিপাথর থেকে নির্মাণ করেছিলেনহহ এইভাবে শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব এই ত্রিধারার এক অপূর্ব মিলন-সূত্রের রচনা করেছিলেন পুণ্যবতী রাণী রাসমনি এই গঠনমূলক জীবনদর্শন হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন অবতারবরিষ্ঠ ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের মর্ত্যলীলার রঙ্গমঞ্চ দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরে এই ত্রিধারার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে তাঁর জীবন দর্শণের এক মহান দিক উন্মোচিত করেছিলেন
[উপাদানঃ]
. শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ- স্বামী সারদানন্দ
. শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাঅভিধান- কালীজীবন দেবশর্মা
. রাণী রাসমনির জীবন বৃতান্ত- নির্মল কুমার রায়
. দক্ষিণেশ্বর মন্দির-গোপালচন্দ্র রায় সম্পাদিত
. রাণী রাসমনি-গোপালচন্দ্র রায়
. রাণী রাসমনি- প্রবোধচন্দ্র সাতরা
. লোকমাতা রাণী রাসমনি- বঙ্কিমচন্দ্র সেন
. বাংলার পারিবারিক ইতিহাস- পণ্ডিত শিবেন্দ্রনারায়ণ শাস্ত্রী
. দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ীর প্রতিষ্ঠা শ্রীরামকৃষ্ণ- স্বামী প্রভানন্দ, শারদীয় সংখ্যা-১৩৯৪
১০. কালীরূপের তাৎপর্য- প্রদীপ রায় চৌধুরী
১১. বঙ্গীয় সাবর্ণ কথা-কালীক্ষেত্র কলিকাতা- ভাবনী রায় চৌধুরী
এবং "রানি রাসমণি"- মালা দত্তরায়
***উল্লিখিত তথ্য এবং চিত্রের সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত বনেদীয়ানা পরিবারের নামে প্রকাশক বা লেখকের অনুমতি ছাড়া এই তথ্য বা চিত্রের কোন রকম কোন প্রতিলিপি করা যাবে না, কোন ফোটোকপি বা কোন রকমের কোন ইলেকট্রিক মাধ্যমে এই তথ্য বিনা অনুমতিতে নেওয়া যাবে না এই শর্ত লঙ্ঘিত হলে বনেদীয়ানা পরিবার উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ***
তথ্যসূত্র সংগ্রহেঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
চিত্রঋণঃ শ্রীমতী অন্বেষা দাস এবং লেখক




No comments:

Post a Comment