Monday, June 17, 2019

নীলাদ্রৌ চ জগন্নাথ সাক্ষাত দক্ষিণাকালিকাঃ



 আজ পুণ্যতিথি স্নানযাত্রা, এই পুণ্যতিথিতে বনেদীয়ানা' নিবেদন শ্রী জগন্নাথদেবের মন্দিরের ইতিহাস বর্ণনা লিখলেন পরিবারের গুরুত্বপূর্ন সদস্য শ্রীমান্ সূর্যশেখর রায় চৌধুরী
 ভগবান জগন্নাথকে পৃথিবীর সমস্ত ধর্মপ্রাণ ভক্তই জীবন্ত বিগ্রহ বলে ভক্তিপুণ্যভাবে প্রণাম করেন কালের গতি বয়ে গিয়ে প্রায় দুই সহস্র বৎসর পার করেও তাঁর মহিমা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে সর্বস্বরূপেই তাঁর প্রকাশ বনেদীয়ানা' পরিবারের পক্ষথেকে তাঁর শ্রীচরণে প্রণাম জানাই
 মহারাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত সর্বক্ষণ চাইতেন তাঁর ইষ্ট শ্রীবিষ্ণুকে আপন করে নিতে প্রতি মুহূর্তেই যেন সেই আশাই রাখতেন এই সময় তিনি জানতে পেরেছিলেন তাঁরই রাজ্যে যারা বসবাস করছেন, তাদের আরাদ্ধ দেবতা স্বয়ং ভগবান শ্রীবিষ্ণুর দিব্যরূপ সেখানে তিনি নাকে স্বয়ং অধিষ্ঠান করেন কিন্তু সেই স্থান নাকি সর্বত্র বর্ণিত নয়, তাই রাজা তাঁর হাজার প্রচেষ্টা থাকলেও তিনি সেই দেবতার পুজোর স্থানের সন্ধান পেলেন না ইতিমধ্যেই তিনি জানতে পারলেন সেই রূপবিগ্রহের নাম "শ্রী নীলমাধব" তখন তিনি তাঁর এক সভাসদকে পাঠালেন, এবং আদেশ দিলেন এই বিগ্রহের সন্ধান করতে, কোন স্থানে আছেন সেই নীলমাধব শেষপর্যন্ত সভাসদ সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি সবর সর্দারের কন্যাকে বিবাহ করবেন, বিবাহের পর তাঁর স্ত্রীকে বললেন যে তার পিতা যে নীলমাধবের দর্শন করতে যান, তাঁকেও যেন একবার দর্শন করতে নিয়ে যান কন্যাও তেমন তাঁর পিতাকে রাজি করালেন ভগবান নীলমাধব দর্শন করাবেন তাঁর স্বামীকে কিন্তু শর্ত হল তাঁকে চোখ বেঁধে যেতে হবে, সর্দারও তেমন তাঁর জামাতাকে চোখ বেঁধে নিয়ে চললেন, সভাসদও ছল করে সমস্ত রাস্তায় শর্ষের বীজ ছড়িয়ে দিলেন অবশেষে তাঁরা পৌঁছালেন সেই গুপ্ত গুহাতে ভগবান নীলমাধবের দর্শনে সভাসদের চোখ খুলে দিতেই তিনি বিগ্রহ দর্শন করে চমকে উঠলেন, যেন স্বয়ং ভগবান দণ্ডায়মান বিশাল সেই মূর্তি তিনি পরদিনই রাজধানীর উদ্দ্যেশ্যে বেড়িয়ে পরলেন রাজাকে গিয়ে সমস্ত ঘটনা জানালেন, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সৈন্য নিয়ে এলেন সেই গুহার কাছে সেই গুহাতে কিছুই দেখতে পেলেন না তাঁর মন ভেঙে গেল তারপর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ভগবানকে ডাকলেন,  যেন তাঁর ওপর তিনি কৃপা করেন এবং দর্শন দেন
  সেইসময় তিনি এক স্বপ্নাদেশ পেলেন যে, তাঁর রাজ্যে সমুদ্রে এক কাঠের খণ্ড পাবেন সেই খণ্ড দিয়ে তিনি তাঁর ইষ্টদেবতা নীলমাধবের মূর্তি নির্মাণ করবেন বহুচেষ্টা করেও সেই কাঠ কেউ একটুও দাগ কাটতে পারলেন না, রাজা তখন এমন এক বৃদ্ধকে পেলেন (ছদ্মবেশে বিশ্বকর্মা স্বয়ং), সেই বৃদ্ধ রাজাকে বললেন তিনি একাই এই বিগ্রহ নির্মাণ করবেন তবে তিনি এক শর্ত দিলেন তা হল তিনি নির্দিষ্ট সময়ে গর্ভমন্দিরের দ্বার খুলে দেবেন তার আগে রাজা যেন সেই মন্দিরের বিগ্রহের রূপ দর্শন না করেন
 সময় যত লাগলো রাজার ধৈর্য যেন টলমল হতে শুরু করল কিন্তু গর্ভমন্দির থেকে কোন শব্দ আসা বন্ধ হয়ে গেল রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন, তাঁর রানীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটায় তিনি রাজাকে বাধ্য করলেন গর্ভমন্দিরের দ্বার খুলে দেখতে রাজাও ঠিক তেমনটাই করলেন, কিন্তু একি?
 রাজা এবং রানী হতভম্বের মতোন দাঁড়িয়ে রইলেন তাঁরা দেখলেন বৃদ্ধ শিল্পী কাঠের অসম্পূর্ণ তিনটি অবয়ব রেখে দিয়ে গেছেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ভেঙে পরলেন যে তাঁর ইষ্টদেবতা এমন হাত পা বিহীন অসম্পূর্ণ!!! তখন তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হলেন যে সেই বিগ্রহই স্বয়ং ভগবান নীলমাধবের আর ঈশ্বরীক লীলা বসত তিনি এমন রূপ ধারন করে ভক্তের পূজা গ্রহন করতে এসেছেন
 ভগবান জগন্নাথের মহাস্থান এক উল্লেখযোগ্য প্রথা তিনটি বিগ্রহকে স্নানবেদীতে বসিয়ে বিশেষ স্নানের ব্যবস্থা করা হয় এই একটি তিথিতেই তিনবিগ্রহকে স্থান করানো হয় বিভিন্ন রকমের তেল, ফলের রস, ফুলের রস ১০৮ সোনার কলসের জল ১০৮ রূপোর কলসের জল, দুধ, হলুদ, চন্দন ইত্যাদি
 প্রথা অনুযায়ী এরপর রথযাত্রার আগে পর্যন্ত জগন্নাথের জ্বর হয় এই সময় সাধারণের জন্য মন্দির দেবতা দর্শন বন্ধ থাকে ঠিক রথযাত্রার আগের রাতে প্রভুর রাজবেশ হয় এই দিনগুলিতে ভগবানের বিশেষ পরিচর্যা চলে
 ভগবান জগন্নাথ, বলরাম জীউ মাতা শুভদ্রার অবয়ব নিমকাঠ দ্বারা নির্মিত এই অসম্পূর্ণ বিগ্রহই বেদীতে বসেন, এবং নিত্যসেবা গ্রহণ করেন যে বেদীতে বসেন সেই বেদীকে "রত্নবেদী" বলা হয় এই বেদী সহস্রাধিক শালগ্রামশিলা দ্বারা নির্মিত পুরান মতে যে যে স্থানে রত্নবেদী অবস্থান করছে সেই স্থান স্বয়ং বৈকুণ্ঠধাম
 তবে কাঠের মূর্তি বা দারুবিগ্রহ হওয়ার কারণে প্রভুর বিগ্রহ নির্দিষ্ট সময় অন্তর পুনঃনির্মাণ করা হয়, কখনো ২৬বছর আবার কখনো ৩০বছর অন্তর স্বপ্নাদেশ আজও পায় মন্দিরের প্রধান উড়িষ্যার দ্বৈতাপতি সম্প্রদায়, যাঁদের বলা হয় স্বয়ং ভগবান বিশ্বকর্মার বংশধর সেই বংশের বর্তমান প্রবীন সদস্য আদেশ পেয়ে বিশেষ লক্ষণ চিহ্নযুক্ত নিমকাঠ সংগ্রহ করেন সদস্যদের সাথে নিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করেন ভগবানের জগন্নাথদেবের অপার লীলা যে বছর নবকলেবরে নির্মান হয় সেই বছরই স্নানযাত্রা রথের মধ্যে মলমাস পরে, তারফলে স্নানযাত্রা রথ নির্দিষ্ট সময়ের থেকে আরও একমাস বেড়ে যায় অর্থাৎ প্রায় ৪২ দিন কখনও আবার ৪৫দিন ভগবানের মূর্তি প্রস্তুত হলে নবকলেবরে ব্রহ্ম পরিবর্তন বা প্রতিস্থাপন করা হয় এবং পুরোনো কলেবরকে মন্দিরের পিছনে সমাধিস্থ করা হয় তখন পুনরায় নবকলেবরে ভগবানের পূজার্চনা চলতে থাকে
 প্রভু জগন্নাথ এখানে বিভিন্ন রূপে পূজিত, কখন শ্রীবিষ্ণু, কখনও দুর্গা, কখনও শিব, কখন আবার কালী, আবার ভৈরব রূপে আবার কখনো মা ষোড়শী রূপে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে এক সতীপীঠ অবস্থান করছেন মা "বিমলা" তাঁর ভৈরব রূপে জগন্নাথ এর পূজা হয়ে থাকে বছরে দুইবার মায়ের মন্দিরে পশুবলিপ্রথা রয়েছে এবং সেখানে প্রভু জগন্নাথ বলরামের প্রতীকী মূর্তি উপস্থিত থাকেন মায়ের সাথে প্রভু জগন্নাথও বলির মাংস গ্রহণ করেন মা বিমলাকে নিবেদন করা হয় তারপর তা জগন্নাথকে নিবেদন করা হয় শারদীয়া দুর্গাপুজোর মহানবমী বাসন্তী দুর্গাপুজোর নবমীতিথিতে এখানে মা শুভদ্রা মহাগৌরী রূপে বিরাজ করছেন অতীতে মা বিমলার মন্দিরে বহু পশুবলি হত কিন্তু নীলাচলে চৈতন্য মহাপ্রভুর আগমনে সেই পশুবলির সংখ্যা কমেছে। বলাবাহুল্য যে মা বিমলা প্রসাদ গ্রহণ না করলে জগন্নাথের প্রসাদ মহাপ্রসাদে রুপান্তরিত হয়না। জগন্নাথের পর মা বিমলাকে নিবেদন করা হয়, মা গ্রহণ করলে তবেই সেই প্রসাদ মহাপ্রসাদে রুপান্তরিতহয়।

নিলাদ্রৌ শুভধামধো শতদলকমলে রত্নসিংহাসনং
সর্ববালঙ্করযুক্তং নবঘনরুচীরং সংযুক্তচাপগ্রয়ন
ভদ্রায়াং বামভাগে রথচরণধূতং ব্রহ্মারুদেন্দবন্দাং
দেবানাং সারযুক্তং সুমনপরিবৃতং ব্রহ্মাদারু নমানি।।
পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আরও একটি বিশেষ তিথি হল চন্দনযাত্রা এই যাত্রা বৈশাখের শুক্লপক্ষ অক্ষয়তৃতীয়া থেকে একাদশ নিবাস পর্যন্ত হয়, এই যাত্রাতে ভগবানের প্রতিনিধি মদনমোহন মূর্তি প্রতিদিন চন্দন পুকুরে গিয়ে নৌকাতে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেব আপন যন্ত্রী লোকনাথ আদি মহাদেব এর সহিত বেড়িয়ে চন্দনপুকুরের মধ্যে যে মন্দির আছে সেখানে চন্দন লাগিয়ে জলক্রীড়া করেন যাত্রার সময় নৃত্য-গীতাদি হয় এবং সকল ভক্তগণ চন্দনপুকুরের চন্দন লাগানো বস্ত্র ব্যবহার করেন এবং ওই দিন থেকে জগন্নাথের রথ তৈরী শুরু হয় প্রতিবছর দোলযাত্রার দিন দোলখেলা হয় পুরীতে শ্রীজগন্নাথদেবের দোলযাত্রার দিন মদনমোহন দেবের ঝুলন যাত্রা হয় ভক্তগণ সেই সময় মদনমোহনের উদ্দেশ্যে ফল দান করেন
এবার শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের মন্দির মাহাত্ম্যই আলোচনা করা হবে এখানে ১২০টি মন্দির আছে জগন্নাথে সর্বপ্রধান মন্দিরের গুরুভাগ ১৬২ ফুট উঁচু ইহা বিষ্ণুচক্র ধ্বজা দ্বারা সুশোভিত উৎকলের রাজা গজপতি অনঙ্গ ভীমদেবের অধিকারকালে ১১১৬শকাব্দে জগন্নাথদেবের প্রধান মন্দির নির্মিত হয় মন্দিরের নির্মাণকালে ৩০-৪০ লক্ষমুদ্রা ব্যায় হয় অনঙ্গভীমদেব পুরুষোত্তমক্ষেত্রে বহু সংখ্যক মন্দির নির্মাণ করেছিলেন মন্দিরের মধ্যে ২০জন নর্ত্তকী আছেন তারি ভোগের সময় অন্যসময়ে কীর্ত্তন করেছিলেন শিখ সম্রাট রঞ্জিত সিংহ মন্দিরে কোহিনূর হীরে দিয়েছিলেন ইহার মূল্য ,৫০০০০০০ অর্থাৎ তিন কোটি পঞ্চাশ লক্ষ টাকা এই কোহিনূর এখন ইংল্যান্ডের রাজার কাছে আছে
তরুণ স্তম্ভঃ- এটি মন্দিরের সংহদ্বারের সম্মুখে সুবিশাল অঙ্গন মধ্যে কৃষ্ণ প্রস্তর নির্মিত দ্বাবিংশ হস্ত উঁচু একটি স্তম্ভ, এটি একটি পাথর কেটে খোদাই করা হয়েছে
গরুড় স্তম্ভঃ- এটি ভোগ-মন্দিরে অবস্থিত মন্দিরে প্রবেশ করে প্রথমে তাকে প্রণাম আলিঙ্গন করতে হয়
কপালমোচন শিবঃ- রুদ্রদেব ব্রহ্মার মুণ্ড ছেদন করে ব্রহ্মাণ্ড মধ্যে কোথাও সেই ব্রহ্মকপাল রাখবার উপযুক্ত স্থান না পেয়ে অবশেষে পুরুষোত্তম শঙ্খের দ্বিতীয়াবর্ত্ত স্থানে রেখে দিলেন অদ্যবধি সেই ব্রহ্মকপাল কপালমোচন শিব অবস্থিত আছে এনাকে দর্শন করলে ব্রহ্মহত্যার পাশ নাশ হয়
এবার আমরা শ্রীজগন্নাথদেবের রথ মাহাত্ম্যের কথাও আলোচনা করবো জগন্নাথ, বলভদ্র, সুভদ্রা প্রত্যেকের জন্যই তিনটে করে রথ প্রতিবছর নতুন করে নির্মান করা হয় রথযাত্রার সময় জগন্নাথ তাঁর ভ্রাতা ভগ্নীকে রথারোহণে মন্দির থেকে একমাইল দূরে উদ্যান গৃহমন্দিরে আনা হয় রথের প্রথম দি বহু সংখ্যক ভক্তের সাহায্যে রজ্জু বন্ধনে জগন্নাথ বলরামকে রথে রথারুঢ় করা হয় ভগ্নী সুভদ্রাদেবীকে পাণ্ডাগণ কোলে করে রথে নিয়ে আসেন রথ ৩৫ ফুট প্রস্থ ৪৮ ফুট উঁচু এবং এর ৭ফুট ব্যাস বিশিষ্ট ১৬ খানি চাকা আছে ৪২০০ লোক কর্ত্তিক রাজার উপস্থিতিতে রথ টানা হয় এবং শ্রীমূর্তিকে ৭দিন পরে আবার মন্দিরে পুনরায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়
 তাই সবশেষে একটাই তথ্য বলার যে জগন্নাথদেবের কাহিনী একটি পর্বে শেষ করা প্রায় অসম্ভব তাই সমগ্র দর্শকের বোঝার জন্য সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করা হল
জয় জগন্নাথ।।
***উল্লিখিত তথ্য এবং চিত্রের সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত বনেদীয়ানা পরিবারের নামে প্রকাশক বা লেখকের অনুমতি ছাড়া এই তথ্য বা চিত্রের কোন রকম কোন প্রতিলিপি করা যাবে না, কোন ফোটোকপি বা কোন রকমের কোন ইলেকট্রিক মাধ্যমে এই তথ্য বিনা অনুমতিতে নেওয়া যাবে না এই শর্ত লঙ্ঘিত হলে বনেদীয়ানা পরিবার উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ***
তথ্যসূত্র সংগ্রহেঃ শ্রীমান্ সূর্যশেখর রায় চৌধুরী
Picture Courtesy- Internet



No comments:

Post a Comment