Sunday, June 2, 2019

শ্রীশ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং শ্রীশ্রীসারদাজননীর লীলাকাহিনীঃ


শ্রীশ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং শ্রীশ্রীসারদাজননীর লীলাকাহিনীঃ
 আজ জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা অর্থাৎ ফলহারিণী কালীপুজোর বিশেষ তিথি এই পুন্যতিথিতে বনেদীয়ানা' নিবেদন লিখলেন শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী আলোচনায় আজ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং শ্রীশ্রীসারদাজননীর লীলাকাহিনী
 যুগাবতার যখন এলেন, পত্নীবান্ বা সশক্তিক হয়েই এলেন কিন্তু সারদারূপিণী মহাশক্তির এক আশ্চর্য অভিনবত্ব প্রথমত, পঞ্চবর্ষীয়া কন্যাকুমারিকারূপে তিনি ঠাকুরের পাণিগ্রহণ করে দেখালেন যে, স্বরূপত তিনি সেই আদি কৌমারী শক্তি, যিনি একদা অম্ভৃণ ঋষির কন্যারূপে সেই উদাত্ত ঘোষণা করেছিলেন বৈদিক যুগেঃ
"অহং সুবে পিতরমস্য মূর্ধন্
   মম যোনিরপস্বন্তঃ সমুদ্রে
 ততো বিতিষ্ঠে ভুবনানু বিশ্বো-
   তামূং দ্যাং বর্ষ্মণোপস্পৃশামি।।"
-'পিতারও আমি প্রসবিতা'- এক পরম আশ্চর্য উদেঘাষণ সত্যই মায়ের তল পাওয়া যায় না চৈতন্যসমুদ্রে অতলান্ত জলরাশি থেকে তাঁর উদ্ভব কে তাঁর পরিমাপ করবে?-যদিও তিনি ব্যাপ্ত হয়ে আছেন বিশ্বভুবনে, ছড়িয়ে আছেন সুদূর দ্যুলোক পর্যন্ত, ছুঁয়ে আছেন ভুবন থেকে গগন পর্যন্ত
 শক্তিরূপিণী সারদার তাই সবচেয়ে বড় পরিচয় এই মাধুর্যময়ী, মমতাময়ী মাতৃরূপের মধ্যে নিহিত, যা তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেনঃ 'আমি মা, জগতের মা, সকলের মা' 'ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে সকলেই আমার সন্তান' যোগীন-মাকে বলেছিলেন-"তা বাপু, যাই বল, কেউ মা বলে এসে দাঁড়ালে তাকে ফেরাতে পারব না" অহর্নিশ উচ্চারিত হত এই প্রার্থনাঃ 'সব ভালো থাকুক, জগতের মঙ্গল হোক'
 শক্তিরূপিণী এই সারদা যেমন সংগঠনের মূলে ঠাকুরের ভাবধারার বিধাত্রী রূপদাত্রী, তেমনি ঠাকুরের লীলাসঙ্গিনীরূপে পরমা গায়ত্রী, ষোড়শী ভুবনেশ্বরী শক্তির দুই রূপঃ বিদ্যামায়া অবিদ্যামায়া আমরা গায়ত্রীমন্ত্রে আবাহন করি, ধ্যান করি বিদ্যারূপিণী মহামায়ার বরেণ্য ভর্গকে, যিনি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে যথাযথ ভাবে প্রেরণা দিলে তবেই আমরা পৌঁছাতে পারি সেই পরম লক্ষ্যে যুগাবতারের পাশে এবার যখন তিনি দাঁড়ালেন তখন বিদ্যামায়ার ষোড়শকলায় পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে তাঁর লীলাসঙ্গিনী হলেন এখানেই শক্তিরূপিণী সারদার আবির্ভাবের অতুলনীয় একক বৈশিষ্ট্য
 এবার বলা যাক সেই লীলাকাহিনীর কিছু অংশ আজ এই পুণ্যতিথিতে একদিন শ্রীশ্রীমা ঠাকুরের পদসংবাহন করতে করতে জিজ্ঞাসা করলেন, "আমাকে তোমার কি বলিয়া বোধ হয়?" ঠাকুর বললেন তখন,"যে মা মন্দিরে আছেন তিনিই এই শরীরের জন্ম দিয়াছেন সম্প্রতি নহবতে বাস করিতেছেন এবং তিনিই এখন আমার পদসেবা করিতেছেন সাক্ষাৎ আনন্দময়ী বলিয়া তোমাকে সর্বদা সত্য সত্য দেখিতে পাই"
তারপর শ্রীশ্রীজগন্মাতার নিয়োগে তাঁর প্রাণে এক অদ্ভূত বাসনার উদয় হল এবং তিনি কোনরকম দ্বিধা না করে সেই কার্য করলেন সাল ১৮৭৩ জ্যৈষ্ঠমাস অর্ধেকের ওপর হয়ে গেছে আজ অমাবস্যা; ফলহারিণী কালিকাপূজার পুণ্য দিবস ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীশ্রীজগন্মাতাকে পূজার করবার মানসে আজ বিশেষ আয়োজন করেছেন আয়োজন মন্দিরে না হয়ে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী গুপ্তভাবে তাঁর গৃহেই হচ্ছে পূজাকালে দেবীকে বসতে দেবার জন্য আলিম্পনভূষিত একখানি পীঠ পূজকের আসনের দক্ষিণ দিকে স্থাপন করা হয়েছে দেবীর রহস্যপূজার সকল আয়োজন সম্পূর্ণ করতে প্রায় নয়টা বেজে গেল শ্রীশ্রীসারদাজননীকে পূজাকালে উপস্থিত থাকার কথা ঠাকুর আগেই বলেছিলেন তিনিও সেই সময়ে উপস্থিত হলেন ঠাকুরের গৃহে ঠাকুর পূজায় বসলেন ঠাকুর এবার আলিম্পনভূষিত পীঠে শ্রীশ্রীমাকে বসার জন্য ইঙ্গিত করলেন মন্ত্রমুগ্ধার ন্যায় তিনি এখন পূর্বমুখে উপবিষ্ট ঠাকুরের দক্ষিণ দিকে উত্তরাস্যা হয়ে বসলেন সম্মুখস্থ কলসের মন্ত্রপূত জল দিয়ে ঠাকুর বারবার শ্রীশ্রীমাকে যথানিয়মে অভিষিক্তা করলেন তারপর মন্ত্র বলে তিনি এখন প্রার্থনা মন্ত্র উচ্চারণ করলেন, "হে বালে, হে সর্বশক্তির অধীশ্বরী মাতঃ ত্রিপুরাসুন্দরী, সিদ্ধিদ্বার উন্মুক্ত কর, ইঁহার শরীর মনকে পবিত্র করিয়া ইঁহাতে আবির্ভূতা হইয়া সর্বকল্যাণসাধন কর" তারপর শ্রীশ্রীমায়ের অঙ্গে মন্ত্রসকলের দ্বারা ন্যাসপূর্বক ঠাকুর সাক্ষাৎ দেঁবী জ্ঞানে তাঁকে ষোড়শোপচারে পূজা করলেন এবং ভোগ নিবেদন করলেন এবং নিবেদিত বস্তসকল স্বহস্তে তাঁর মুখে প্রদান করলেন বাহ্যজ্ঞানতিরোহিতা হয়ে শ্রীশ্রীমা সমাধিস্থা হলেন ঠাকুরও অর্ধবাহ্যদশায় মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে সম্পূর্ণ সমাধিস্থ হলেন সমাধিস্থ পূজক সমাধিস্থা দেবীর সঙ্গে আত্মস্বরূপে পূর্ণভাবে মিলে গেলেন রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর বহু আগেই শেষ হয়েছে আত্মারাম ঠাকুরের বাহ্যসংজ্ঞার কিছু কিছু লক্ষণ দেখা দিতে থাকল তিনি সাধনার ফল, নিজের জপের মালা প্রভৃতি সর্বস্ব শ্রীশ্রীদেবীপাদপদ্মে চিরকালের নিমিত্ত বিসর্জনপূর্বক মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে তাঁকে প্রণাম করলেনঃ
 "হে সর্বমঙ্গলের মঙ্গলস্বরূপে, হে সর্বকর্মনিষ্পন্নকারিণি, হে শরণদায়িনি ত্রিনয়নি শিবগেহিনি গৌরি, হে নারায়ণি, তোমাকে প্রণাম, তোমাকে প্রণাম করি"
পূজা শেষ হল-মূর্তিমতী বিদ্যারূপিণী মানবীর দেহাবলম্বনে ঈশ্বরীয় উপাসনার দ্বারা ঠাকুরের সাধনার পরিসমাপ্তি হল-তাঁর দেব-মানবত্ব সর্বতোভাবে সম্পূর্ণতা লাভ করল
"যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা
 নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।"
-যা দেবীর সমস্ত ভূতের মধ্যে শক্তিরূপে বিরাজিতা, তাঁকে নমস্কার, তাঁকে নমস্কার, তাঁকেই নমস্কার, বারবার
 স্বামী শিবানন্দ বলতেন-" শুধু রামকৃষ্ণ-অবতারেই নয়, রাম-অবতারে সীতারূপে, কৃষ্ণ-অবতারে রুক্মিনী রাধা রূপে আমাদের মা- এসেছিলেন যুগে যুগে ঠাকুরের সঙ্গে মাকেই আসতে হয়" পুরাণ এবং তন্ত্রাদি গ্রন্থে এই মহাশক্তির নানা রূপ বর্ণিত আছে শ্রীশ্রীচণ্ডীর প্রাধানিক রহস্যে কথিত আছে-
"সর্বস্যাদ্যা মহালক্ষ্মীস্ত্রিগুণা পরমেশ্বরী
 লক্ষ্যালক্ষ্যস্বরূপা সা ব্যাপ্য কৃৎস্নং ব্যবস্থিতা।।"
-অর্থাৎ পরমেশ্বরী মহালক্ষ্মী ত্রিগুণময়ী সকলের আদ্যা প্রকৃতি তিনি সগুণা নির্গুণা এবং জগৎপ্রপঞ্চ ব্যাপ্ত করে আছেন এই মহালক্ষ্মী নানা ভাবে, নানা রূপে নিজেকে প্রকাশিত করেন ইনিই কালী, তারা, ষোড়শী প্রভৃতি মহাবিদ্যা কিন্তু ষোড়শীবিদ্যায় মহালক্ষ্মীর পূর্ণ প্রকাশ সেই জন্যই তিনি শ্রীবিদ্যারূপে কথিতা অধ্যাত্মদৃষ্টির দিক দিয়ে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীশ্রীমায়ের সম্বন্ধে বলেছিলেন-" তিনি সরস্বতী" শ্রীশ্রীমা নিজ সম্বন্ধে বলেছিলেন, তিনি কালী স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন, তিনি জ্যান্ত দুর্গা এবং অন্যত্র বলেছিলেন যে, তিনি "বগলার অবতার" স্বামী অভেদানন্দ তাঁর শ্রীসারদাস্তোত্রে বলেছিলেন, তিনিই পরমাপ্রকৃতি
 তন্ত্রশাস্ত্রে শক্তিসাধনপদ্ধতির দুইটি কুল রয়েছে একটিকে বলা হল কালীকুল, যাহা বঙ্গ প্রভৃতি দেশে দেখা যায় আর অন্যটিকে বলা হয় শ্রীকুল, যাহা দাক্ষিণাত্যে দেখা যায় শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সাধনজীবন আরম্ভ করেন কালীকুলের সাধক হিসাবে এই সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তিনি বিভিন্ন পথের সাধনা করেন আনুমানিক ১৮৬৪-৬৫ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ তোতাপুরীর থেকে সন্ন্যাসগ্রহণ করেন সন্ন্যাসগ্রহণের ফলে তিনি শঙ্করাচার্য-প্রবর্তীত দশনামী সম্প্রদায়ের পুরীসম্প্রদায়ভুক্ত হন এই পুরীসম্প্রদায়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কামাক্ষী দক্ষিণ ভারতের কাঞ্চীপুরমে এই দেবীর মন্দির রয়েছে সেখানে ষোড়শীদেবীর মূর্তি এবং শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত শ্রীযন্ত্র রয়েছে এই ভাবে ঠাকুর কালীকুলের সাধন শেষ করে শ্রীকুলের সাধন পথে অগ্রসর হয়েছিলেন শ্রীশ্রীসারদাজননী পরমাপ্রকৃতি কালী, তারা, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি দেবীগণ পরাশক্তির ভিন্ন ভিন্ন বিভূতি কিন্তু শ্রীবিদ্যা বা ষোড়শীবিদ্যা পরমাশক্তির মুখ্য প্রকাশ দেবীর একটি মন্ত্রের না ত্রিকূট মন্ত্র এই ত্রিকূট মন্ত্রের একটি অংশের নাম বাগভবকূট, অপরটি কামরাজকূট এবং অন্যটি শক্তিকূট এই শক্তিকূট ক্রিয়াকে প্রকাশিত করেছে এবং তাহার অধিষ্ঠাত্রী দেব দুর্গা বা বগলামুখী ত্রিকূট মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী ষোড়শীর এই সকল দেবীই অংশ বা বিভূতি সুতরাং শ্রীশ্রীসারদাজননী এই ষোড়শীর মানববিগ্রহ বলে বিভিন্ন কালে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁকে কালী, সরস্বতী, বগলা, পরমাপ্রকৃতি বলা হয়
 সবশেষে আজ এই পুণ্যতিথিতে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব এবং শ্রীশ্রীসারদাজননীর চরণে প্রণাম জানাই সঙ্গে থাকুন বনেদীয়ানার, ইতিহাসের কথা জানতে
তথ্যঋণঃ
. "শ্রীরামকৃষ্ণ জীবনী"- স্বামী তেজসানন্দ
. "শতরূপে সারদা"- স্বামী লোকেশ্বরানন্দ
. "শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ"- প্রথমভাগ, স্বামী সারদানন্দ
. "শ্রীমা সারদা দেবী"- স্বামী সারদানন্দ
তথ্যসংগ্রহেঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী



No comments:

Post a Comment