Saturday, June 8, 2019

মুর্শিদাবাদে সতীপীঠ কিরীটেশ্বরীঃ-



 আজ বনেদীয়ানা' প্রকাশিত হল মুর্শিদাবাদে সতীপীঠ কিরীটেশ্বরীর ইতিহাস লিখলেন বনেদীয়ানা পরিবারের সদস্য শ্রীমান্ শুভদীপ এই মহাপীঠের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, নাম বিমলা এবং ভৈরব হলেন সংবর্ত ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত 'তন্ত্রচূড়ামণি' গ্রন্থে এই মহাপীঠের কথা উল্লেখ আছে 'পীঠ নির্ণয়' গ্রন্থে বলা হয়েছে-
 "ভুবনেশী সিদ্ধিরূপা
  কিরীটসহ কিরীটতঃ
 দেবতা মিলা নাম্নী
  সংবর্তো ভৈরবস্তথা।।"
রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যগ্রন্থে উল্লেখ আছে,
 "কিরীটকণায় পড়ে কিরীটস্বরূপ
   ভুবনেশী দেবতা ভৈরব সিদ্ধিরূপ।।"
ভারতচন্দ্রের মতে স্থানটির নাম কিরীটকোণা দেবীর নাম ভুবনেশী, ভৈরবের নাম সিদ্ধিরূপ ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে, জায়গাটি অবস্থিত মুর্শিদাবাদে হাজারদুয়ারীর উল্টোদিকে নদী পার হয়ে এলে পড়বে ডাহা পাড়া সেখান থেকে আধক্রোশ দূরে কিরীটকোণা(মতান্তরে কিরীটকণা) গ্রামের নাম বটনগর এই একবিংশ শতাব্দীতেও গ্রামের অবস্থা খুবই সঙ্গিন অর্থনৈতিক ভাবে বিধ্বস্থ মন্দিরটি অবস্থিত কাঁচারাস্তায় বিজলি বাতির চিহ্ন দেখা যায় না ইদানীং মন্দির চত্ত্বরকে ঘিরে কয়েকটি দোকান হয়েছে কিরীটেশ্বরী প্রাঙ্গণে রয়েছে দেবীর নতুন পুরাতন মন্দির পৌরানিক তান্ত্রিক মতে, বিষ্ণুচক্রে কর্তিত হয়ে সতীর মাথায় থাকা কিরীট(মুকুট) এই কিরীটকণা বা কিরীটদেশে পড়েছিল তান্ত্রিক মতে এটি একান্ন সতীপীঠের অন্যতম সতীপীঠ

 মহানীলতন্ত্রে কিরীটতীর্থের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে এই তন্ত্রের পঞ্চম পটলে বলা হয়েছে,
 'কালীঘাটে, গুহ্যকালী কিরীটে মাহশ্বরী
 কিরীটেশ্বরী মহাদেবী লিঙ্গাঘে লিঙ্গবাহিনী।।'
মন্দিরের পুরোহিতের থেকে জানা যায়, মুর্শিদাবাদের সবচেয়ে প্রাচীন স্থান হল এই কিরীটেশ্বরী মন্দির যে সময় দক্ষযজ্ঞ হয়েছিল সেই সময় কিরীটেশ্বরীতে দেবীর 'কিরীট'পড়েছিল অনেকে ভাবেন কিরীট মনে মাথার মুকুট কিন্তু আসলে কিরীট হল "কপালের ওপরে শিরের নীচের সংযোগস্থল" এই অংশটিই এখানে শিলারূপে রক্ষিত আছে প্রাচীনকালে এই শিলা বর্তমান মন্দিরের পাশে পুরানো মন্দিরে রাখা ছিল সেই মন্দির কালের গতিতে ধ্বংস হয় এই মন্দির তখন ছিল জঙ্গলে ভরা এখানে রানী ভবানীর দত্তক পুত্র রাজা রামকৃষ্ণ রায় পাঁচটি নরমুণ্ড এনে পঞ্চমূণ্ডের আসন স্থাপন করে সাধনা শুরু করেছিলেন উদ্দেশ্য ছিল, মায়ের দর্শন লাভ কিন্তু মায়ের দর্শন তিনি না পাওয়ায় রাজা রামকৃষ্ণ দুঃখে, অভিমানে নিজের মৃত্যু কামনা করলেন তখন দেবীর দৈববাণী হল,  তোমার সময়, স্থা, কাল ঠিক হয়নি সময় কাল হলেই তুমি আমার দর্শন পাবে বাবা "বাবা" বলায় রামকৃষ্ণ শান্ত হলেন কিন্তু তখনও তিনি জানেন না, কবে, কোথায় তিনি মায়ের দর্শন পাবেন ফিরে গেলেন বাংলাদেশের নাটোরে সেখানে গিয়ে তিনপক্ষ করতোয়া নদীর ধারে যে পীঠস্থান আছে, সেখানে পঞ্চমূণ্ডের আসন স্থাপন করেন সেখানেই তাঁর মাতৃরূপ দর্শন হয় এবার দেবী রানী ভবানিকে স্বপ্নাদেশ দেন মা তাঁকে বলেন, তুমি এখানে মন্দির তৈরী কে রানীমা কিরীটেশ্বরী মন্দির প্রঙ্গনে এসে দেখলেন মন্দির প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে তিনি ভাবলেন, মা তাকে মন্দির তৈরীর নির্দেশ দিলেন কিন্তু মন্দির তো ধ্বংসের দিকে তিনি ভাবলেন মায়ের আদেশ ছাড়া এই ভিটে ছেড়ে শিলা নিয়ে যাবেন কী করে কিন্তু এই শিলাকে বাঁচাতেই হবে, নাহলে পরবর্তী সময়ে তাঁকে কেউ চিনতে পারবে না তখন তিনি ধ্বংসের হাত থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে পঞ্চমূণ্ডের আসনের থেকে এক ইঞ্চি ওপরে স্থাপন করলেন শিলা ধোওয়া জল থাকত পঞ্চমূণ্ডের কুণ্ডে গর্ভ করে তিনি তার ভেতরে শিলাকে প্রবেশ করিয়ে দিলেন সেখানে সৃষ্টি করিয়ে দিলেন মাতৃরূপ রানী ভবানি একটি মায়ের মূর্তিও দিয়ে গেছেন সেটা ওঁর সময়ে বা ওঁর আগে তা জানা যায় না সেই মূর্তি অষ্টধাতুর, সোনার মুকুট দিয়ে তৈরী পৌষ মাসের চারটি মঙ্গলবার দুপুর একটার পর এই মূর্তির অধিষ্ঠান হয় সেটি একটি গোপন স্থানে সারাবছর থাকে

 শোনা যায়, নবাব মীরজাফর যখন কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তখন মহারাজ নন্দকুমারের পরামর্শে মা কিরীটেশ্বরীর চরণামৃত পান করে রোগমুক্ত হয়েছিলেন মুসলমান রাজাদের সময় স্থানটি তীর্থস্থান হিসাবে পরিচিত ছিল গৌড়ের পাঠান রাজাদের আমলেও দেবীর গৌরব অটুট ছিল জানা যায় চৈতন্যদেবের সমসাময়িক মঙ্গল বৈষ্ণব তাঁর পুর্বপুরুষেরা দেবী কিরীটেশ্বরীর একনিষ্ঠ ভক্তি ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাবরাও দেবী কিরীটেশ্বরীকে সম্মান করতেন "রিয়াজ-উস্-সালতিন" কিরীটকণাকে 'তিরুণ-কণা' বলে উল্লেখ আছে পঞ্চাননের কায়স্থ চারিকায় লেখা আছে,
 "ডিহি কিরীটেশ্বরী মধ্যে কিরীটেশ্বরী গ্রাম
    মহাপীঠ হয় সেই মহামায়ার ধাম।।"

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে দেবীর সেবায়েত ছিলেন জনৈক বৈষ্ণব নাম তাঁর মঙ্গল তিনি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ছিলেন রাজা রাজবল্লভ এখানে দুটি শিবমন্দির তৈরী করেন কথিত আছে, রাজা রাজবল্লভকে নবাব মীরকাশিম যেদিন গঙ্গায় ডুবিয়ে মারেন সেইদিন একটি শিবলিঙ্গ ফেটে যায় আরও শোনা যায়, রাজা রাজবল্লভের ছেলেকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হলে একটি বড় শিবলিঙ্গ আপনা-আপনিই ফেটে যায় দেবী কিরীটেশ্বরীর ভৈরব হিসাবে যে মূর্তি পূজা করা হয় সেটি আসলে বুদ্ধমূর্তি এই মূর্তিটি 'ধ্যান বুদ্ধমূর্তি' নামে পরিচিত অন্যান্য ভৈরব মূর্তির সঙ্গে এর কোন মিল নেই পাল বংশীয়রা বৌদ্ধমতাবলম্বী ছিলেন অনুমান করা যায়, তাদের আমলেই মূর্তিটি স্থাপন করা হয় বঙ্গের সতীপীঠের মধ্যে অন্যতম সতীপীঠ এই কিরীটেশ্বরী

কিভাবে যাবেনঃ শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে মুর্শিদাবাদ ১৯৭ কিলোমিটার মুর্শিদাবাদ থেকে সাহা নগরের খেয়া পারকরে পশ্চিম দিকে হাঁটাপথ বা রিকশোয় ৫কিলোমিটার মন্দির প্রাঙ্গনে বা কাছে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই রাত্রিবাস করতে হলে বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ বা আজিমগঞ্জ শহরে থাকতে হবে
কৃতজ্ঞতাস্বীকার তথ্যঋণঃ শ্রী হিমাংশু চট্টোপাধ্যায় (৫১পীঠ)
চিত্রঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী, সন্দীপ ভট্টাচার্য্য
তথ্যসংগ্রহেঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী



No comments:

Post a Comment