জয়তু শ্রীরামকৃষ্ণ।।
আজ
২৯শে ফাল্গুন,১৪২৬ (ইং ১৩ই মার্চ,২০২০) শুক্রবার ভগবান শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের পার্ষদ ও ঈশ্বরকোটি শ্রীমৎ স্বামী যোগানন্দজী মহারাজের ১৬০তম জন্মবর্ষ উৎসব পালিত হচ্ছে ৫,কেদারনাথ ব্যানার্জী রোড, দক্ষিণেশ্বরে।
ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব স্বয়ং যোগানন্দজী মহারাজকে 'ঈশ্বরকোটি'বলে চিহ্নিত করেছিলেন। দক্ষিণেশ্বরের সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের ছেলে যোগীন ছোটো থেকেই শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আসেন, তাঁর অদ্ভুত ভালোবাসায় মুগ্ধ হন ও উচ্চতর জীবনের প্রেরণায় ঘর ছাড়েন। সম্পন্ন ঘরের এই সন্তান নিজের পরবর্তী জীবন সঁপে দেন কঠোর ত্যাগ তপস্যা ও তিতিক্ষায়। ঠাকুরের পার্ষদদের মধ্যে তিনিই প্রথম দেহরক্ষা করেন, মাত্র আটত্রিশ বছর বয়েসে। শ্রীশ্রীসারদাজননীর প্রথম মন্ত্রশিষ্য ছিলেন যোগীন মহারাজ। শ্রীশ্রীমায়ের প্রতি ছিল যোগীন মহারাজের অপার ভক্তিবিশ্বাস। যোগীন মহারাজের শেষশয্যায় স্বামীজী বলেছিলেন, গুরুভাইদের প্রতি একান্ত ভালোবাসায়ঃ- 'যোগীন, তুই বেঁচে ওঠ, আমি মরি।' স্বামী নিরঞ্জনানন্দের কথায়ঃ- 'যোগীন, তুমি আমাদের মাথার মণি।'
স্বামী যোগানন্দ অতি অল্প বয়সেই ঠাকুরের পুণ্য দর্শনলাভ করেছিলেন। "লীলাপ্রসঙ্গে" আছে-"প্রথম আগমনদিবসে ঠাকুর ইঁহাকে দেখিয়া এবং ইঁহার পরিচয় পাইয়া বিশেষ প্রীত হইয়াছিলন এবং বুঝিয়াছিলেন, তাঁহার নিকট ধর্মলাভ করিতে আসবে বলিয়া যেসকল ব্যক্তিকে শ্রীশ্রীজগন্মাতা তাঁহাকে বহুপূর্বে দেখাইয়াছিলেন, যোগীন কেবলমাত্র তাহাদের অন্যতম নহেন, কিন্তু যে ছয়জন বিশেষ ব্যক্তিকে ঈশ্বরকোটি বলিয়া জগদম্বার কৃপায় তিনি জানতে পেরেছিলেন, যোগীন তাঁহাদিগেরও অন্যতম। স্বামীজী বলতেন-"আমাদিগের ভিতর যদি কেউ সর্বতোভাবে কেহ কামজিৎ থাকে তো সে যোগীন।" নিরঞ্জনানন্দের কথায়-"যোগীন,তুমি আমাদের মাথার মণি।" বলা বাহুল্য যে, যিনি উচ্চ প্রশংসার অধিকারী, তিনি অনন্যসাধারণ মহাপুরুষ। বস্তুতঃ সরল, মহাত্যাগী, কঠোর তপস্বী, মাতৃভক্ত ও শুকদেবের ন্যায় পরম পবিত্র যোগানন্দ শুধু রামকৃষ্ণ-সঙ্ঘের কেন, যে-কোনও সমাজ বা কালের "মাথার মণি।"
স্বামী যোগানন্দের পূর্বনাম যোগীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী। দক্ষিণেশ্বরের সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশে ১৮৬১সালের ৩০এ মার্চ(১২৬৭সালের ১৮ই চৈত্র,শনিবার, ফাল্গুনী কৃষ্ণা চতুর্থীতে) ইঁহার জন্ম হয়। পিতা নবীনচন্দ্র রায় চৌধুরী মহাশয় নিষ্ঠাবান ধার্মিক ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং পূজা ও ধ্যানাদিতে অনেক সময় অতিবাহিত করতেন। যোগীনের তখন মাত্র কৈশোর। পিতা আশা পোষণ করেছিলেন যে, যোগীন বড় হয়ে সংসারের ভার গ্রহণ করবে। কিন্তু ঐরূপ কোন লক্ষণ যোগীনের চরিত্রে দেখা যায়নি। বরং বয়স হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভগবানলাভের আকাঙ্ক্ষা তাঁহার মনকে অধিকার করে বসেছিল। তিনি নিজেই বলতেন যে, অতি শৈশবকালে এক অভাবনীয় ভাবনায় তিনি বিভোর থাকতেন।
ক্রমে যোগীনের উপনয়ন হল। এখন তিনি পূজাধ্যানাদির অধিকতর সুযোগ পেয়ে প্রাণে একটা তৃপ্তি অনুভব করতে শুরু করলেন এবং এই ধ্যানাদিতেই নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ঐ সময় তিনি রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি পুস্তক পাঠ করতেন। এতদ্ব্যতীত তাঁহার বাটী প্রায়ই ভাগবতপাঠ ও কীর্ত্তনাদিতে মুখোরিত থাকত এবং এই কারণে যোগীন সবসময় একটা ধর্মভাবে বিভোর থাকতেন।
যথাসময় পিতা নবীনচন্দ্র রায় চৌধুরী তাঁকে আগড়পাড়া মিশনরী বিদ্যালয়ে ভর্তি করেদিলেন। বিদ্যালয়ে পাঠে নিরত থাকলেও যোগীন প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দির সংলগ্ন উদ্যানের কাছেই তাঁর বাড়ি বলে তিনি প্রায়ই আসতেন সেখানে। বিশেষতঃ ধর্মপ্রাণ পিতা পুষ্পচয়ন ও গঙ্গাস্নানাদির জন্য প্রত্যহ রাসমণির দেবালয়ে যাতায়াত করতেন। এইভাবে দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরের সাথে যোগীনের আশৈশব সম্বন্ধ বলাই চলে।
ইতিমধ্যে কেশবচন্দ্র শ্রীরামকৃষ্ণকে কলিকাতার শিক্ষিত সমাজে সুপরিচিত করে দিয়েছেন। কেশবচন্দ্রের প্রবন্ধাদি পড়ে যোগীন শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনে উৎসুক হলেন- কিন্তু পরিচয় দেবে কে? এমন সময় একদিন কালীবাড়ির সামনে ভ্রমণ করতে করতে যোগীনের একটি ফুল নেবার ইচ্ছা হল এবং সামনেি একজন অতি সাধারণ পোষাকে এক ব্যক্তিকে দেখে ভাবলেন, এই ব্যক্তিই নিশ্চয় বাগানের মালী, সুতরাং ফুলটি দেওয়ার জন্য তাকে বললেন যোগীন। সেই ব্যক্তি অম্লানবদনে তুলে দিলেন সেই ফুল।
তারপরে যোগীন দেখলেন একটি ঘরে বসে বহু ভদ্রলোক নিষ্ঠামনে সেই তাঁর দেখা মালীর বাণী বসে শুনছেন, এবং সেই দেখা মালীটি অবিরাম তত্ত্বকথা বলে চলেছেন। এইদেখে তিনি যুগপৎ বিস্ময় ও লজ্জা পেলেন। তাঁর বুঝতে বাকি থাকল না যে, দক্ষিণেশ্বরের লোকেরা যাঁকে "পাগলা বামুন" বলেন এবং কেশবচন্দ্র যাঁকে "পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণ" বলে প্রচার করেন, ইনিই তিনি। যোগীনের তখনই মনে প্রশ্ন মনে এলো যে,"যদি পাগল হবেন, তবে এত লোক কেন?" সেই প্রসঙ্গে জানতে যোগীন আরও এগিয়ে গিয়ে ঘরের দ্বারের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন।
যোগীন মৌনবিস্ময়ে বাইরে রইলেন, এমন সময় ঠাকুর একজনকে নির্দেশ দিলেন,"বাইরে যারা আছে, তাদের ভেতরে নিয়ে এস।" বাইরে তখন যোগীন ছাড়া আর কেউই ছিলনি, তাই যোগীন ভেতরে এসে বসলেন। এরপর যারা দূর থেকে এসেছিলেন তারা চলে গেলে শ্রীরামকৃষ্ণ যোগীনের সামনে এলেন এবং তাঁর পরিচয় জানতে চাইলেন। পরিচয় পেয়ে তিনি আনন্দের সাথে বললেন-"তবে তো তুমি আমাদের চেনা ঘর গো! তোমাদের বাড়িতে আমি তখন কত যেতুম, ভাগবত পুরাণ প্রভৃতি শুনতুম-তোমাদের বাড়ির কর্তারা আমাকে বড় যত্ন করতেন।" তারপর উপস্থিত সকলের সামনে যোগীনের পরিচয় দিয়ে বললেন," এঁরা দক্ষিণেশ্বরের সাবর্ণ চৌধুরী। এঁদের প্রতাপে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়। এঁরা লোকের জাত দিতে নিতে পারতেন। জানা-শোনা হল, বেশ হল-এখানে যাওয়া-আসা করো। মহদ্বংশে জন্ম-তোমার লক্ষণ বেশ সব আছে। বেশ আধার-খুব(ভগবদ্ভক্তি) হবে।"
তথ্যসূত্রঃ "শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা"-প্রথমভাগ(স্বামী গম্ভীরানন্দ)
[প্রসঙ্গত, ঠাকুর বহু আগে থেকেই দক্ষিণেশ্বরের সাবর্ণ পরিবারে আসতেন তখন যোগীন খুবই ছোটো। একদা সাবর্ণ পরিবারের পঞ্চমদোলের দিন ঠাকুর উপস্থিত হলেন সাবর্ণদের বাড়িতে। পরিবারের সদস্যরা দেখলেন ঠাকুরের সমস্ত পায়ে আবির লেগে আছে, তখনও ঠাকুরকে কেউই আবির পায়ে দেয়নি, তবুও এমন ঘটনা দেখে পরিবারের সবাই এসে ঠাকুরের চরণে আবার আবির দিলেন। বহুবার ঠাকুর এই বাড়িতে এসে নিজে রান্না করে খেয়েছেনও। সাবর্ণ বাড়িতে তার প্রিয় খাবার লুচি, ডাল ইত্যাদি।]
উপরের তথ্যসূত্রেঃ পরিবারের সদস্য
আজ
শ্রীমৎ স্বামী যোগানন্দ মহারাজের শুভ ১৬০তম জন্মতিথি উপলক্ষে তাঁর শ্রীচরণে রইল শতকোটি প্রণাম।
জয়তু শ্রীরামকৃষ্ণ। জয়তু শ্রীরামকৃষ্ণ। জয়তু শ্রীরামকৃষ্ণ।
No comments:
Post a Comment