ঐতিহ্যের গোস্বামী বাড়ীঃ- বনেদীয়ানা
আজ পঞ্চম দোলউৎসব, বনেদীয়ানা পরিবার প্রকাশ করল শান্তিপুরের ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক বড় গোস্বামী বাড়ীর দোল উৎসবের কিছু কথা, লিখলেন শুভদীপ। সাহায্য করলেন বড় গোস্বামী বাড়ীর সদস্য শ্রী সত্যনারায়ণ গোস্বামী।
কেমন লাগে বনেদীয়ানা'র উপস্থাপনা?? সামনেই বনেদীয়ানা পরিবার কলকাতা হেরিটেজ ওয়াক্'এর আয়োজন করতে চলেছে, জানতে চান কোথায় এই ওয়াক্ হবে? ই-মেলের মাধ্যমে আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন। যাই হোক, চলুন দেখা যাক সেই পরিবারের দোল উৎসবের কিছু রীতিনীতির কথা।
দোল উৎসবে বড় গোস্বামী বাটীঃ- শান্তিপুর
কলকাতা থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরের শহর শান্তিপুর অনেকের কাছেই এক পরিচিত নাম। শান্তিপুর মানেই শাক্ত-শৈব এবং বৈষ্ণব এই তিন ভাবধারার মেলবন্ধন, তা চোখে পরবেই। ভারতবর্ষে প্রথম গণ আন্দোলনের এবং সমাজ বিপ্লবের পথ প্রদর্শক শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য তাঁর সওয়া একশো বছরের দীর্ঘ জীবনের প্রায় পুরোটাই অতিবাহিত করেছেন এই জনপদে। প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্যদেবের পদধূলিপূত এই শহর। মহাত্মা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী থেকে অগণিত মণীষীর বাসভূমি এই শান্তিপুর। এখানকার রাস, দোল, রঘুনাথের রথযাত্রা, ব্রহ্মাপুজো, অন্নপূর্ণা পুজো, গনেশজননী পুজো এবং সেই সঙ্গে বিশেষ বিশেষ মেলার আয়োজন, যা শান্তিপুরের নিজস্ব সংস্কৃতির উদাহরণ। এই শান্তিপুরের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক বড় গোস্বামী বাড়ী।
শ্রীঅদ্বৈত পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর বড়পুত্র রাঘবেন্দ্র গোস্বামী থেকে এই বাড়ির সৃষ্টি। কথিত আছে ঈশ্বর দর্শনের উদ্দেশ্যে ভারত ভ্রমণে বেড়িয়ে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য নেপালের গণ্ডকী নদী থেকে একটি নারায়ণ শিলা প্রাপ্ত হন। সেই শিলা তিনি শান্তিপুরে নিজ বাড়িতে এনে পুজো করতেন। আচার্যদেবের সেই নারায়ণ শিলা এখনও নিত্য পূজিত হন বড়গোস্বামী বাড়িতে। এই বাড়ির প্রধান দেবতা কষ্টিপাথরের শ্রীরাধারমণ জীউ। এই মূর্তি আগে পুরীতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আমলে দোলগোবিন্দ নামে পূজিত হতেন। পরবর্তীতে বারোভুঁইয়া পরিবারের বসন্ত রায় তাঁকে যশোরে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ১৫৯২ খ্রীঃ মানসিংহ বাংলা আক্রমণ করলে মূর্তির পবিত্রতা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বসন্ত রায়ের পরিবার এই কৃষ্ণমূর্তি তুলে দেন তাঁদের গুরুদেব অদ্বৈতপৌত্র মথুরেশের হাতে। মথুরেশ সেই মূর্তি শান্তিপুরে তাঁর নিজ বাড়ি বড়গোস্বামী বাড়িতে এনে শ্রীরাধারমণ নামে প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে ৪২৬ বছর ধরে শ্রীরাধারমণ পূজিত হচ্ছেন বড়গোস্বামী বাড়িতে। উৎকলীয় ভাস্কর্যের এই অপরূপ কৃষ্ণমূর্তি যেমন নয়নশোভন তেমনই দুঃখমোচন।
পরবর্তীতে শ্রীরাধারমণের সাথে যুক্ত হয়েছেন শ্রীমতী। এছাড়াও এই বাড়িতে রয়েছেন সুপ্রাচীন মদনমোহন-শ্রীমতী মূর্তি রাধাবল্লভ-শ্রীমতী, গোপাল রায়-শ্রীমতী, বিশ্বমোহন-শ্রীমতী মূর্তি। রয়েছেন জগন্নাথ-বলভদ্র-সুভদ্রা এবং রামচন্দ্রের দারুমূর্তি, আর আছেন শান্তিপুরের একমাত্র ষড়ভুজ মহাপ্রভু মূর্তি, শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য, সীতাদেবী ও পুত্র অচ্যুতানন্দের দারুমূর্তি ইত্যাদি।
প্রতিদিন নিয়ম মেনেই এই মন্দিরে সমস্ত দেবদেবীর বিভিন্ন পার্বিক পূজানুষ্ঠান হয়। বড় গোস্বামী বাটীর প্রধান উৎসব হল রাসযাত্রা এবং অদ্বৈত জয়ন্তী। এছাড়া এখানে ফুলদোল, রথযাত্রা, দোল, ঝুলন, কাত্যায়নী পুজো, জন্মাষ্টমী সহ প্রতিটি বৈষ্ণবীয় উৎসব-অনুষ্ঠান মহাসমারহে পালিত হয়। দোল উৎসবকে কেন্দ্র করেও এই বাড়ির সদস্যরা মেতে ওঠেন। এই বড় গোস্বামী বাটীতে তিনটি দোল উৎসব পালিত হয়, দোল পূর্ণিমার দিন দোলযাত্রা, পঞ্চমদোল এবং সপ্তমদোল। দোল পূর্ণিমার দিন শ্রীরাধারমণ জীউ দোলমঞ্চে ওঠেন, দুপুর অবধি বিগ্রহ দোলমঞ্চেই থাকেন। সেই সাথে যেহেতু সেই দিন মহাপ্রভু শ্রীশ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবতিথি তাই বিশেষ উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। সারাদিন ধরে সংকীর্তন হয় গৌরপূর্ণিমা এবং দোল উৎসব উপলক্ষে। আগের দিন চাঁচর পোড়ানোর রীতি রয়েছে গোস্বামী পরিবারে, এই রীতি প্রতিটি দোল উৎসবই পালিত হয় (পঞ্চমদোল,সপ্তমদোল)। গৌর পূর্ণিমা উপলক্ষে বড় গোস্বামী বাটীর ষড়ভুজ মহাপ্রভুর বিশেষ অভিষেক ও পূজাপাঠের ব্যবস্থা করা হয়। আজ পঞ্চমদোল উৎসব, এই উৎসবে অদ্বৈতাচার্যের প্রিয় বিগ্রহ শ্রীশ্রীমদনমোহন জীউ। তাই আজ শ্রীশ্রীমদ জীউ এবং তাঁর শ্রীমতী দোলমঞ্চে উঠেছিলেন, পঞ্চমদোল উৎসব পালিত হল মহাসমারহে।
আগামী ১৬ই মার্চ,২০২০ সপ্তমদোলও পালিত হবে বড়গোস্বামী বাটীতে। এই দিন দোলমঞ্চে সীতানাথ ও সীতাদেবী ওঠেন, নিষ্ঠার সাথে সপ্তমদোল উৎসবও পালিত হবে। ভোগে থাকে সাদাভাত, শুক্তনি, মোচার ঘন্ট, ডাল, বিভিন্ন রকমের ভাজা, এঁচড়ের ডালনা, কুমড়ো-পটল-আলু দিয়ে তরকারি, চাটনি, পায়েস, মিষ্টান্ন ইত্যাদি। এইভাবে তিনটি দোল উৎসবই মহাসমারহে পালিত হয় শান্তিপুরের বড়গোস্বামী বাড়িতে। বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে বড়গোস্বামী বাড়ির সকল সদস্যদের জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- শ্রী সত্যনারায়ণ গোস্বামী
তথ্যসূত্র লিপিবদ্ধেঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment