"প্রথমে পূজিতা সা চ কৃষ্ণেণ পরমাত্মনা।
বৃন্দাবনে চ সৃষ্ট্যাদৌ গোলোকে রাসমণ্ডলে।।
মধুকৈটভভীতেন ব্রহ্মণা সা দ্বিতীয়তঃ।
ত্রিপুরপ্রেষিতেনৈব তৃতীয়ে ত্রিপুরারিণা।।
ভ্রষ্টশ্রিয়া মহেন্দ্রেণ শাপাদ্দুর্ব্বাসসঃ পুরা।
চতুর্থে পূজিতা দেবী ভক্ত্যা ভগবতী সতী।।
কালান্তরে পূজিতা সা সুরথেন মহাত্মনা।
রাজ্ঞা মেধস শিষ্যেণ মৃণ্ময্যাঞ্চ সরিত্তটে।।"
আজ
কৃষ্ণানবমীতিথি, এবছরের শারদীয়া দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গেল কলকাতা তথা বঙ্গের বহু প্রাচীন বনেদী বাড়ির ঠাকুরদালানে বোধনের মাধ্যমে। বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে সকল দর্শকদের জানাই আগাম শারদ শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন। কৃষ্ণানবমীর এই বিশেষ তিথিতে বনেদীয়ানা পরিবার তিনটি বাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করল। লিপিবদ্ধ করলেন বনেদীয়ানা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শ্রীমান শুভদীপ রায় চৌধুরী। বনেদীয়ানা পরিবার কৃতজ্ঞতাস্বীকার করল এই তিন বাড়ির সদস্যদের কাছে। চলুন দেখা যাক সেই বনেদী বাড়ির ইতিহাস।
"পূজিতা সুরথেনাদৌ দুর্গা দুর্গতিনাশিনী।
তৎপশ্চাদ্রামচন্দ্রেণ রাবণস্য বধাথিনা।।"
-কৃত্যচিন্তামণি গ্রন্থ
শুরু হল বনেদী বাড়ির দেবীর বোধনঃ-আজ কৃষ্ণানবমীতিথি
১. সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার-
সাবর্ণ বাড়ির দুর্গাপুজো শুরু হয়ে গেল আজ আটচালায় দেবীর বোধনের মাধ্যমে। এবছর রায় চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজোর ৪১০তম বর্ষ। কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজোই শুরু হয়েছিল এই বাড়িতে। লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী শুরু করেছিলেন দুর্গাপুজো ১৬১০সালে। আজ কৃষ্ণানবমীতিথি উপলক্ষে বিশেষ পুজোর মাধ্যমে শুরু হল জগত্তারিণির আরাধনা। রায় চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো হয় বিদ্যাপতি রচিত "দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী"মতে। দেবীর গায়ের রঙ শিউলি ফুলের বোঁটার মতন হয়, চালচিত্রে দশমহাবিদ্যা অঙ্কিত হয়। রায় চৌধুরী পরিবারে ৮টি দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়, বড়িশায় ৬টি পুজো হয়- আটচালা বাটী, বড়বাড়ি, মেজবাড়ি, মাঝেরবাড়ি, বেনাকীবাড়ি ও কালিকিঙ্করবাড়ি এবং নিমতাবাড়ি ও বিরাটিবাড়ি। আজ আটচালায় বোধনঘরে দেবীর বোধন শুরু হল, বাকী বাড়িগুলিতে ষষ্ঠীতে বোধন হয়।
জগত্তারিনী দুর্গার একপাশে থাকে শ্রীরামচন্দ্র এবং অন্যদিকে থাকে মহাদেব। তাঁদেরও নিয়মিত পুজো হয়। জন্মাষ্টমীতে দেবীর কাঠামোপুজো হয়। দেবীকে আমিষ ভোগই নিবেদন করা হয় কিন্তু নিমতাবাড়িতে নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়। ভোগে থাকে সাদাভাত, পোলাও, খিচুড়ি, ভাজা, তরকারি, মাছ, চাটনি, পায়েস, মিষ্টান্ন ইত্যাদি থাকে ভোগে। দশমীতে এই বাড়িতে কনকাঞ্জলিপ্রথা আছে। সেই দিন ভোগে পান্তাভাত, ইলিশমাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক, চালতার চাটনি ইত্যাদি দেওয়া হয়। এইভাবে আভিজাত্য, ধারাবাহিকতা এবং বনেদীয়ানায় উজ্জ্বল হয়ে আছে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো। রায় চৌধুরী পরিবারের সকল সদস্যদের জানাই শারদীয়ার অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা।
২. শিবপুর রায় চৌধুরী পরিবার-
হাওড়া অঞ্চলের শিবপুরে ভরদ্বাজ গোত্রীয় রায় চৌধুরী পরিবারে আজ অনুষ্ঠিত হল দেবীর বোধন। রাজরাজেশ্বরীর রূপই বলে দেয় শিবপুরের ঐতিহ্য। শুধুমাত্র শিবপুরের নয় সমগ্র হাওড়া অঞ্চলের বনেদীবাড়ির অন্যতম এই বাড়ির দেবীপ্রতিমা। বড়োবাড়ির মেয়ের খেলার সাথী পদ্মা হয়ে গেলেন মা মহামায়া। হাওড়া জেলার শিবপুরের রায়চৌধুরী বাড়িতে সেই থেকে শুরু হল মা মহামায়ার আরাধনা। বলতে গেলে এই পুজোই হাওড়া জেলার অন্যতম দুর্গাপূজা। আজও রায়চৌধুরী পরিবারের মিলন ক্ষেত্র হয়ে ওঠে এই "সাজার আটচালা"। ১৬৮২সালে এই বংশের পূ্র্বপুরুষ রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী শিবপুর, রামকৃষ্ণপুর 'নিবড়া' নিতাঙ্কুর, চামরাইল, দেবীপাড়া, বাঁকড়া, বেতড়- ইত্যাদি মোট ১১টি গ্রামের মালিকানা পান সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছ থেকে। জমিদার বাড়ির সামনে বিরাট দীঘি খনন করা হয়, পাড়ে প্রতিষ্ঠা হয় শিবমন্দির। জমিদারবাড়ির পিছন বিরাট একটি ফুলের বাগানও তৈরি করেন রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী। এই বাগিচা পরিচিত ছিল 'শখের বাগান'নামে। স্নানান্তে এই বাগান থেকে ফুল তুলে জমিদারমশাই প্রতিদিন মহাদেবের পুজো করতেন। এই বাগানেই জমিদারমশাই প্রতিদিন মহাদেবের পুজো করতেন। এই বাগানেই জমিদারে শিশু কন্যার খেলার জায়গা ছিল। নিত্য সকালে বিকেলে সে এখানেই খেলে বেড়াত। তার খেলার সঙ্গী ছিল তারই মতন আরও এক ছট্টো মেয়ে পদ্ম। কিন্তু সেই শিশু কন্যা কোথা থেকে তার সাথে খেলতে আসত তা জানত না জমিদার কন্যা। খেলা শেষে সে আবার চলে যেত। মেয়ে প্রতিদিনই জমিদার রামব্রহ্মকে তার এই খেলার সাথীটির কথা বলত। গল্প শুনে রামব্রহ্মের ইচ্ছা হল পদ্মকে তিনি একবার দেখবেন। তাকে জমিদার বাড়িতে নিয়ে আসতে বললেন মেয়েকে। কিন্তু পদ্মা কিছুতেই জমিদার বাড়িতে আসতে রাজি হল না। অবাক হলেন রামব্রহ্ম। জমিদারের মেয়ের সঙ্গে খেলা করে অথচ জমিদারবাড়িতে আসতে চায় না। কে এই কন্যা? দেখতে চান তিনি। মেয়ের খেলার ফাঁকে রামব্রহ্ম নিজেই চলে গেলেন বাগানে। কিন্তু না, সেদিন আর বাগানে তাঁকে দেখতে পাওয়া গেল না। কখন সে চলে গেছে জমিদার কন্যা তা জানে না। খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল পায়ের ছাপ। মেয়ে বলল, বাবা দেখা, এই যে আমার বান্ধবীর পায়ের ছাপ। সুতরাং সে এসেছিল তা নিশ্চিত। কিন্তু কোথায় গেল? থাকেই বা কোথায়? খোঁজ শুরু হল। কিন্তু না, জানা গেল পদ্মানামে কর্মচারীদের কোনও মেয়ে নেই। জমিদার রামব্রহ্ম বিহ্বল হয়ে পড়লেন।
সেই রাতে স্বপ্নাদেশ পেলেন পদ্মা আসলে মা মহামায়া। তাঁকে দর্শন করতে হলে আশ্বিন মাসে তাঁর পুজো অর্চনার ব্যবস্থা করতে হবে। সেদিন ছিল ভাদ্র মাসের কৃষ্ণাষ্টমী, পরদিন নবমী। হাতে সময় খুব কম। জমিদার রামব্রহ্ম তাড়াতাড়ি আটচালা তৈরি করে দেবী পুজোর ব্যবস্থা করলেন। সেই শুরু হল রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো। পরবর্তীকালে সেই আটচালা ভেঙে পাকা দুর্গাদালান তৈরি হল। সামনে নাটমন্দির, নহবৎখানা। তুবও এখনও তা সাজার আটচালা নামে পরিচিত। ইংরেজ বিরোধিতা ছিল এই বাড়ির রক্তে। ইংরেজ বিরোধিতা বোঝানোর জন্য এককালে সাদা ছাগ বলি দেওয়া হত। ঢেঁড়া পিটিয়ে নিমন্ত্রণ করা হত। একচালার ডাকের সাজে মাতৃমূর্তির পুজো আজও চলে আসছে।
এই পরিবারে চারটি বলিদান হয়। মহাপুজো বলতে যে অর্থ বোঝায় অর্থাৎ সপ্তমী থেকে নবমীতে হোম হবে সেই মহাযজ্ঞও অনুষ্ঠিত হয়। রায় চৌধুরী পরিবারে প্রতিদিন অন্নভোগ হয় মাছ, মাংস সহযোগে। ভোগের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল দশমীতে দেবীকে পান্তাভাত ও দুরকমের ভাজা দেওয়া হয়। পুজোর রীতি অনুযায়ী সকালে দেবীকে মিছরি মাখন ছানা আমসত্ত্ব সহযোগে বাল্যভোগ দেওয়া হয়। চারদিনই মাছভোগ ও অন্নভোগ দেওয়া হয়। শিবপুর রায় চৌধুরী পরিবারের বিশেষত্ব হল এই বাড়ির নবপত্রিকা পুরুষেরা বরণ করেন সেখানে মহিলাদের কোন ভূমিকা থাকে না। চৌধুরী বাড়ির দেবীর ঘটে কোন সূত্রবেষ্টন হয় না, তা উন্মুক্ত অবস্থাতেই থাকে। শিবপুর রায় চৌধুরী বাড়ির রাজরাজেশ্বরীর মুকুটটি দশমীর বিসর্জনের আগে তাদেরই প্রতিষ্ঠিত মা
চঁণ্ডীর মন্দিরের দেবীকে পরানো হয়, একবছর দেবী চঁণ্ডিকা সেই মুকুট পড়ে থাকেন শিবপুরের রায় চৌধুরী পরিবারের সকল সদস্যদের জন্য রইল শারদীয়ার অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা।
৩. বজবজ বিন্দুকানন চট্টোপাধ্যায় পরিবার-
বজবজ অঞ্চলের চট্টোপাধ্যায় বাড়িতেও আজ দেবীর বোধন শুরু হল, শুরু হল মৃন্ময়ীর আরাধনা। এই বাড়িতে কৃষ্ণানবমীতে বোধনের পর ষষ্ঠীতে অধিবাস হয়। সপ্তমী থেকে দেবীর মূলপূজা শুরু হয় প্রাণপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সপ্তমী, মহাষ্টমী ও মহানবমী এই তিনদিনই হোম ও বলিদানপ্রথা মেনেই দুর্গাপুজো হয় চট্টোপাধ্যায় পরিবারে। সপ্তমী ও মহাষ্টমীতে ফলবলি হয় এবং মহানবমীর দিন ফলবিলর সাথে পশুবলিপ্রথাও পালন করা হয়। এই বাড়ির পুজো সম্পূর্ণ তন্ত্রমতে হয়। মহাষ্টমীর দিন কুমারিপুজো হয়। দশমীর দিন এই বাড়িতে অপরাজিতা পুজোর রীতি রয়েছে, সেই রীতি মেনেই অপরাজিতা পুজো হয়ে থাকে।
মায়ের পুজোর দিনগুলিতে মাছ, মাংস সহযোগে ভোগ নিবেদন হয়। সপ্তমীতে ভোগে থাকে সাদাভাত, ডাল, শুক্তনি, তরকারি, মাছ, চাটনি, পায়েস। মহাষ্টমীর ভোগে থাকে পোলাও, আলুরদম, মাছ, চাটনি, পায়েস। মহানবমীতে বলির মাংস, খিচুড়ি, বিভিন্ন রকমের ভাজা এবং মাছ। দশমীর দিন প্রাচীন রীতি মেনে দধিকর্মা আর সাথে বাড়ির রীতি মেনে পান্তভাত, কচুরশাক ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করা হয়। দশমীর দিন ভোগে মাছ, মাংস থাকে না। চট্টোপাধ্যায় বাড়ির দেবীর সিংহ ঘোড়ার আদলে তৈরি। এই বাড়ির কুলদেবী দক্ষিণাকালিকার আদলে মায়ের বামহাতে খড়গ থাকে। অতীতে দশমীতে নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়া হত, বর্তমানে সেই প্রথা বন্ধ রয়েছে। এই পরিবারে দেবীকে 'কারণ' দেওয়ার রীতি আছে। এই ভাবে বিভিন্ন প্রাচীন রীতিনীতি মেনেই আজও পুজো হয় বজবজ বিন্দুকানন চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে। বাড়ির পুজোর ঐতিহ্য আর ধারাবাহিকতা যেন এখনও অটুট। তাই বিন্দুকানন চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সকল সদস্যদের জন্য রইল বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে শারদীয়ার অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ শ্রী সূর্যশেখর রায় চৌধুরী(শিবপুর বাড়ির সদস্য)
শ্রী গৌতম চট্টোপাধ্যায়( বজবজ চট্টোপাধ্যায় বাড়ির সদস্য)
তথ্য লিপিবদ্ধেঃ- শ্রীমান শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment