ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ
আজ প্রকাশিত হল বাংলাদেশের চট্টোগ্রাম জেলার সিকদার বাড়ির দুর্গোৎসব। লিখলেন বনেদীয়ানা পরিবারের সদস্যা শ্রীমতী দেবযানী বসু। চলুন দেখা যাক সেই বাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাস।
বাংলাদেশের সিকদার বাড়িঃ- চট্টোগ্রাম
শক্তির আরাধনা হল শাক্তধর্ম বা তন্ত্র। প্রাচীন বাংলায় শক্তিসাধনা অনেক রকমের। কোথাও কক্ষে কোথাও মূর্তিতে, কোথাও শিলায়, কোথাও ঘটে আবার কোথাও বা পটে-আদ্যাশক্তি পূজিতা হয়ে আসছেন। এপার হোক বা ওপার বাংলা। কোনায় কোনায় ছড়িয়ে আছে শক্তিসাধনার এমন অনেক উদাহরণ। মৃন্ময়ী মূর্তির অনেক আগে থেকে বাংলায় পটপুজোর চল। কারণ পটশিল্প হল বাংলার ঘরে ঘরে প্রচলিত। এমনই এক পটে আঁকা দুর্গাপুজোর কাহিনী বলব যা দেখা যায় বাংলাদেশের চট্টোগ্রাম জেলার রোসাংগিরি গ্রামে। শক্তিসাধনার জন্য বিখ্যাত এই গ্রাম। দুর্গোৎসব এবং কালীপুজো অনুষ্ঠিত হয় ধুমধাম করে। সবচেয়ে পুরানো পুজো হল সিকদার বাড়ির পুজো। পুরাতন ও নতুন এই দুই বাড়িতেই পুজো হয়। ভরদ্বাজ গোত্রীয় ব্রাহ্মণ শ্রী প্রতাপচন্দ্র নারায়ণ সপ্তদশ শতকের শুরুতে নিজের বাড়ি তৈরি করেন। তিনি তন্ত্রসাধক ছিলেন। তিনি স্থানীয় ভূ-স্বামীর কন্যা রাজেশ্বরীদেবীকে বিবাহ করেন। ধীরে ধীরে প্রচুর জমির স্বত্ব অর্জন করেন, সিকদার পদবী গ্রহণ করেন। একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন হালদা নদীতে এক সুদর্শনা সুবেশা রমণী তার চার পুত্রকন্যা নিয়ে এগিয়ে আসছেন। রমণীটি তারকাছে ঘরের ঠিকানা জানতে চান। এমন স্বপ্ন দেখে প্রতাপচন্দ্র অনুমান করেন দেবী বোধহয় পুজো চান তাঁর গৃহে। সেই পুজোর শুরু। সুসজ্জিত প্রতিমায় মহাস্নান, মহিষ বলি দিয়ে পুজো হয়ে আসছিল। এরপর আসে পরিবর্তন। প্রতাপচন্দ্রের পৌত্র উমাকান্ত বৈষ্ণব ভাবধারায় দীক্ষিত হন ও নিজের পরিবার নিয়ে আলাদা একটি বসতি স্থাপন করেন। এভাবে ভাগ হয়ে যায় পুরানো ও নতুন সিকদার বাড়ি। উমাকান্ত বাড়িতে গোপীনাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। বৈষ্ণব অনুষ্ঠান শুরু করেন। কিন্তু তাঁর পুত্ররা দুর্গোৎসবে উৎসাহী ছিলেন। এই অবস্থায় উমাকান্ত তাঁর গুরুদেবকে চিঠি লেখেন। উত্তর আসে বিনা প্রতিমায়, বিনা বলিতে দুর্গাপুজো করা যেতে পারে। সেই বছর থেকে ঘটে পুজো শুরু হয়।
বর্তমানে নতুন সিকদার বাড়িতে ঘটের সঙ্গে সপরিবার দুর্গার পট বা ছবি যুক্ত হয়। সুন্দর ঠাকুরদালান নির্মিত হয় বিংশ শতকের গোড়ার দিকে। ষষ্ঠীতে আমন্ত্রণ, বোধন ও অধিবাসের মাধ্যমে পুজো শুরু। সপ্তমী, মহাষ্টমী ও মহানবমীতে যথাক্রমে সাত, আট ও নয় রকমের নিরামিষ ভোগ হয়। সপ্তমীর মধ্যরাত্রে কালী মূর্তিতে কালরাত্রির পুজো হয়। বলিদান নেই, শুধুমাত্র সন্ধিপুজোতে একটি চালকুমড়ো বলিদান হয়। তিনদিনই নিমন্ত্রিতরা অন্নপ্রসাদ গ্রহণ করেন। দশমীর দিন সকালে পায়েস ভোগ দেওয়া হয়। তারপর দর্পণ বিসর্জনের মাধ্যমে পুজোর সমাপ্তি ঘটে। পুজোর তিনদিনই অভয়ামঙ্গলের জলসা হয়। সুর করে পাঠ করে বাড়ির মহিলা সহ সকলে।
পুরাতন সিকদার বাড়ির পুজোটি অনেক আগেই সার্বজনীন পুজোতে পরিণত হয়েছে। গ্রামের দুর্গামণ্ডপে এই পুজোটি অনুষ্ঠিত হয়। পশুবলিপ্রথা বন্ধ কিন্তু ফল বলিদান হয়। এখন সিকদারদের পুরানো ভিটায় মহানবমী তিথিতে ঘট বসিয়ে প্রতীকি পুজোর চল আছে। নতুন বাড়ির পুজো আরম্ভ করার আগে পুরোহিত পুরাতন ভিটায় এসে সংক্ষেপে দেবী অর্চনা করে যান।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- শ্রী চয়ন দাস
তথ্য লিপিবদ্ধেঃ- শ্রীমতী দেবযানী বসু
No comments:
Post a Comment