Wednesday, October 30, 2019

ঐতিহ্যের হৈমন্তীপর্ব- বটকৃষ্ণ পাল বাটী

ঐতিহ্যের হৈমন্তীপর্বঃ-১

 কেমন লেগেছে বনেদীয়ানা'র আগের 'বনেদীবাড়ির দুর্গাপুজোপর্ব' ও 'দীপান্বিতাপর্ব'? কতটা নতুন তথ্য পেলেন আপনারা? কতটা সমৃদ্ধ হলেন?? আমাদের ই-মেল এর মাধ্যমে জানান, আমরা আপনাদের সেই প্রশ্নের বা শুভেচ্ছার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। আজ থেকে শুরু হল বনেদীয়ানা'র জগদ্ধাত্রী পুজো নিয়ে হৈমন্তীপর্ব। কলকাতা, চন্দননগর, কৃষ্ণনগর ছাড়াও বঙ্গের বহু অঞ্চলে এবার ধুমধাম করে পুজো হবে মা জগদ্ধাত্রীর।
 আজ প্রকাশিত হল উত্তর কলকাতার বেনিয়াটোলা স্ট্রিটের বি কে পালের বাড়ির প্রাচীন জগদ্ধাত্রীপুজোর ইতিহাস ও রীতিনীতি, লিখলেন শুভদীপ। সাহায্য করলেন বটকৃষ্ণ পাল বাড়ির সদস্য শ্রী অভিরূপ পাল মহাশয়। চলুন দেখা যাক সেই ইতিহাস।
ঐতিহ্যের হৈমন্তীপর্ব- বটকৃষ্ণ পাল বাটী

 পাল পরিবারের আদি নিবাস হাওড়া শিবপুরে। ১৮৩৫ খ্রীষ্টাব্দে বঁটকৃষ্ণ পাল সেখানে জন্মগ্রহণ করেন। এই প্রথিতযশা পাল মহাশয় ১২বছর বয়সে কলকাতায় মাতুলালয়ে চলে আসেন। তিনি পরবর্তীকালে ব্যবসা শুরু করেন। ক্রমে সেই ব্যবসা বৃহৎ মহীরুহ আকার ধারণ করে। প্রখ্যাত ওষুধ ব্যবসায়ী ও প্রস্তুত কারক হিসাবে তাঁর নাম যশ দিকে দিকে ছড়িয়ে পরে। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'বটকৃষ্ণ পাল এণ্ড কোং'।

 ১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে ৭৭নং বেনিয়াটোলা স্ট্রিটে বটকৃষ্ণ পাল মহাশয় জমি কিনে বৃহৎ বসত বাড়ি নির্মাণ করেন। বাড়িতে এক সুরম্য সুন্দর কারুকার্য খচিত দ্বিপ্রসস্থ ঠাকুরদালান তৈরি করেন। এই ঠাকুরদালানেই ১৩০৭ বঙ্গাব্দে (ইং ১৯০০ খ্রীঃ) মহাসমারহে সাড়ম্বরে তিনি শ্রীশ্রীজগদ্ধাত্রী মাতার পুজো শুরু করেছিলেন। এই পুজো করার আগে বঁটকৃষ্ণ পাল শিবপুরে অঁভয়া দুর্গামাতার পুজো করতেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল শিবপুরের অভয়া মাকে বেনিয়াটোলার বসতবাড়িতে পুজো করার। কিন্তু তাঁর পূর্বপুরুষদের মুখে জানা যায় বঁটকৃষ্ণ পাল এর স্ত্রীকে মা স্বপ্নাদেশে জানান, 'আমি শিবপুরের আদি বাড়িতেই পুজো পেতে চাই' এবং আদেশ করেন বেনিয়াটোলার বাড়িতে মা দুর্গার আর এক রূপ পদ্মাসীনা জগদ্ধাত্রীর পুজো করতে। মায়ের আদেশে বটকৃষ্ণ পাল মহাশয় আজীবন ৭৭ নং বেনিয়াটোলা স্ট্রিট-এর বসতবাড়িতে জগদ্ধাত্রীপুজো করে গেছেন। পরবর্তী প্রজন্মও নিষ্ঠাভাবে সেই ঐতিহ্যকে ধরে রেখে পুজো করে আসছেন। এবছর এই বাড়ির পুজো ১১৯ বছরে পদার্পন করল।

জগদ্ধাত্রী প্রতিমার বিশেষত্ব হল বাহন সিংহের পিঠে মা দু পা মুড়ে বাবু হয়ে বসে আছেন। মায়ের সঙ্গে থাকেন চার সখী। মাকে স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত করা হয়। মায়ের সাজ-সজ্জা আগে ঢাকা থেকে শিল্পী এনে তৈরী করানো হতো, বর্তমানে কলকাতার শিল্পীরাই তৈরি করেন। মায়ের বাহন সিংহের সর্বাঙ্গে আকন্দ তুলোর ছোটো ছোটো আঁশ বের করে আঠা দিয়ে গায়ের লোম হিসাবে লাগানো হয়, যা শৈল্পিক সুষমামন্ডিত। ঠাকুরের পিছনে থাকে ধাতুনির্মিত বাহারি পাতা ও দৃষ্টিনন্দন ফল শোভিত এক অনন্য চালচিত্র। দিনে তিনবার পুজো ছাড়াও হয় সন্ধিপুজো। তাতে আধ মন চালের নৈবেদ্য, গোটা ফল, ১০৮পদ্ম ও প্রদীপ নিবেদন করা হয়। দেবীর নিরঞ্জনের সময় লরিতে চৌকির ওপর চালচিত্র সমেত সখীসহ মাকে অধিষ্ঠিত করা হয়। বিসর্জনের সময় শোভাযাত্রা আরও এক ঐতিহ্য। এই ভাবে প্রাচীন ধারাকে ধরে রেখে আজও পুজো পেয়ে আসছেন মা জগদ্ধাত্রী পাল বাড়িতে।

কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- শ্রী অভিরূপ পাল
তথ্য সংগ্রহেঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী


Friday, October 25, 2019

দীপান্বিতায় সাবর্ণদের কালীপুজোঃ- পশ্চিম মেদিনীপুর, খেপুত


দীপান্বিতাপর্বঃ-১৫
 আগামীকাল দীপান্বিতা কালীপুজো আবার কারো বাড়িতে এবং সর্বোপরি কালীঘাটে আগামীকাল দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো আজ এক প্রাচীন বনেদী বাড়ির কালীপুজোর ইতিহাস প্রকাশ করবে বনেদীয়ানা পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুর থানার অন্তর্গত খেপুত গ্রামের কালীপুজোর ইতিহাস, লিখলেন শুভদীপ চলুন দেখা যাক সেই পুজোর ইতিহাস ঐতিহ্যের কাহিনী

দীপান্বিতায় সাবর্ণদের কালীপুজোঃ- পশ্চিম মেদিনীপুর, খেপুত

সাবর্ণ গোত্রীয় রামদুলাল রায় চৌধুরী ১৭৭২ খ্রীঃ মেদিনীপুর জেলার চিতুয়া গ্রামে জমিদারি লাভ করে রূপনারায়ণ নদের পশ্চিমতীরে খেপুত উত্তরবাড় গ্রামে চলে যান এই এলাকার তখন হুজুরি জমিদার ছিলেন বর্ধমানের মহারাজগণ বর্ধমানের রাজ পরিবারের সহিত বড়িশার জায়গিরদার সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের বরাবরই সুসম্পর্ক ছিল বর্ধমানের রাজপরিবার- বিশেষ করে তিলক চন্দ্রের পর তেজশ্চন্দ্র বা তেজচাঁদা(১৭৭০-১৮৩২) বর্ধমানের রাজা ছলেন

চেতুয়া পরগণা এবং বরদা পরগনার অনিয়মিত রাজস্ব আদায়ের জন্য বিচলিত হয়ে যখন বর্ধমানের রাজপরিবার বিশেষ করে তেজচাঁদ উক্ত এলাকার জন্য ছোটো জমিদারের খোঁজ করছিলেন সেই সময় বড়িশার রামদুলাল রায় চৌধুরীর পূর্বের সুসম্পর্কের ফলে চেতুয়া পরগনার আংশিক জমিদারি লাভ করা কাজে সচেষ্ট হয়েছিলেন কাজে সম্ভবত তাঁর জ্যেঠামশাই সন্তোষ রায় চৌধুরীর হস্তক্ষেপও ছিল এই জমিদারি রামদুলাল বর্ধমানের তেজচাঁদের নিকট সম্ভবত ১৭৭২ সালে গ্রহণ করেন কারণ তেজচাঁদই এই বিশাল ভূখণ্ডের মুখ্য জমিদার ছিলেন

রামদুলাল রায় চৌধুরী চেতুয়ার জমিদারি লাভ করার পর রূপনারায়ণ নদের পশ্চিমতীরে খেপুত উত্তরবাড় মৌজায় বাসস্থান তৈরী করেন মাটির ঠাকুরঘর নির্মাণ করেন সেই সঙ্গে রঘুনাথ জিউ নামক একটি নারায়ণশিলাও তারা খেপুতের বাড়িতে নিয়ে যান


বড়িশাবাড়ির দুর্গাপুজোর কথা স্মরণ করে বিজয়া দশমীর দিন রামদুলাল রায় চৌধুরী কালীমাতার(শ্রীশ্রী মাতা খেপতেশ্বরী- উত্তরবাড়ের প্রাচীন মূর্তি মূর্তিটির প্রস্তর ফলকে খোদিত অষ্টভুজা বরাহমূর্তি মহিষমর্দিনীরূপ পূর্বে দেবীর জন্য একটি মাটির মন্দির ছিল সম্ভবত বর্ধমাের রআ কর্তৃক ১৭৭৯ খ্রীঃ দক্ষিনমুখী আটচালা মন্দিরটি নির্মিত হয় মন্দিরটির দৈর্ঘ্য প্রস্থ যথাক্রমে ২৪ফুট ১০ইঞ্চি এবং ২৩ফুট ৬ইঞ্চি) আমিষ ভোগ দিয়ে দেবীর তৃণমূর্তির পদে মৃত্তিকা লেপন করেন অর্থাৎ বড়িশাবাড়ির দুর্গাপুজোর শেষে খেপুত বাড়ির কালীপুজো শুরু করেছিলেন তিনি

প্রথম সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারে(মেদিনীপুর) সম্ভবত ১৭৯৮ খ্রীঃ কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে প্রথম কালীপুজো শুরু হল খেপুতে প্রায় ৩০০বছরের ধারা এখনও অটুট মেদিনীপুরের খেপুতে
প্রাচীন রীতি মেনেই বংশানুক্রমিক ভাবে ছুতোর, নাপিত, কামার, মালাকার, গয়লা আজও সাবর্ণদের পুজোয় অংশগ্রহণ করেন ছুতোর(কুমোর) আজও সাবর্ণদের ঠাকুর তৈরি করে অন্য কালীঠাকুর তৈরিতে হাত দেন ডাকের গয়নায় সজ্জিত এই প্রাচীন করালবদনা কালী আজও গোটা খেপুত সহ মেদিনীপুর অঞ্চলের মানুষের কাছে জনপ্রিয় সাবর্ণদের ৩০০বছরের পুরানো এই কালীপুজোর ব্যয়ভার বহন করে মূলত "সাবর্ণ রায় চৌধুরী গোষ্ঠী সংসদ" এই বাড়ির অধীনস্থ ইশারা পুকুরের মাছ দিয়েই দেবীকে ভোগ দেওয়া হয় মানতের জন্য প্রচুর সংখ্যায় বলিদানও হয় এই পুজোয় এই বাড়ির দেবী কালিকার গায়ের রঙ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়


বিজয়া দশমীর দিন বিশেষ নিয়মে পুকুর থেকে মাটি তোলা হয় পরদিন থেকেই শুরু হয় প্রতিমা তৈরীর কাজ নিয়ম মেনে পারিবারিক আটচালায় তৈরী হয় প্রতিমা এই রায় চৌধুরী বাড়িতে কালীপুজোয় শুধুমাত্র ভোগ রান্নার সাহায্য করতে পারেন মহিলারা পরিবারের পুরুষ সদস্যরা পুজোর যাবতীয় কাজ করে থাকেন ঘট তোলার আগে প্রথমে মাটির হাঁড়িতে জল ভর্তি করা হয় সেই হাঁড়ি রাখা হয় আটচালাতেই জল-হাঁড়িতে প্রদিপ ভাসিয়ে দেওয়া হয় প্রদীপেও থাকে ছোটো ছোটো ছিদ্র ওই ছিদ্র দিয়ে একসময় জল-ঢুকে প্রদীপ পূর্ণ হলে তা ডুবে যায় জল-হাঁড়িতে চন্দনের টিপ দেওয়া থাকে এক একটি টিপ ২৪মিনিটের সূচক প্রদীপ ডোবা মাত্রই পরিবারের এক পুকুরেই ঘট ডুবিয়ে পুজো শুরু হয় একই কালীপুজো উপলক্ষে বাড়ির মেয়েরা বাজি প্রদর্শনীতে মেতে ওঠেন বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন

এই ভাবে ঐতিহ্য পরম্পরাকে অক্ষুণ্ণ রেখেই প্রাচীন রীতি মেনে পুজো হয়ে আসছে মেদিনীপুরের খেপুত গ্রামে
তথ্যসূত্র সংগ্রহেঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী