দীপান্বিতাপর্বঃ-১১
শাক্ত ও বৈষ্ণব ধারার পীঠস্থান শান্তিপুর। যেখানে শাক্তমতের সাথে বৈষ্ণবমতের মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায়। বৈষ্ণব ও শাক্তের বিরোধ মেটানোর জন্য এক ঐকান্তিক প্রায়স জড়িয়ে আছে অদ্বৈতভূমির বুকে চার শতক আগে শুরু হওয়া কালীপুজোর সাথে। এই ঐতিহ্যকে সঙ্গী করে শান্তিপুরের মা আগমেশ্বরীকে দেখতে বহু ভক্তগণ ছুটে আসেন কালীপুজোর সময়। আজ দীপান্বিতাপর্বে সেই আগমেশ্বরীকে(শান্তিপুরের) নিয়েই প্রবন্ধ প্রকাশিত হল, লিখলেন শুভদীপ। তথ্য দিয়ে বনেদীয়ানাকে সমৃদ্ধ করলেন শান্তিপুর বড় গোস্বামী পরিবারের সদস্য শ্রী সত্যনারায়ণ গোস্বামী মহাশয়। চলুন দেখা যাক সেই দীর্ঘদিনের ইতিহাস ও রীতিনীতি।
দীপান্বতায় ৪০০বছরেরও প্রাচীন আগমেশ্বরীঃ-শান্তিপুর
আজ থেকে প্রায় আনুমানিক চারশো বছর আগে শুরু হয়েছিল এই আগমেশ্বরী কালীপুজো শান্তিপুরে, শুরু করেছিলেন সার্বভৌম আগমবাগীশ। এই সার্বভৌম আগমবাগীশ ছিলেন পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের প্রপৌত্র। তিনি ছিলেন তন্ত্রসাধক। তাঁরা আগমশাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন বা সেই শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য লাভ করেছিলেন বলে তাদের আগমবাগীশ উপাধি দান করা হয়। সেই সময় শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মধ্যে বিরোধ চলছিল বলেই শোনা যায়, তাই শান্তিপুরের অদ্বৈতাচার্য্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামী তাঁর নিজ কন্যার সাথে বিবাহ দিয়েছিলেন সার্বভৌম আগমবাগীশের। এরফলে জটিলতা আরও বৃদ্ধি পাওয়ায় মথুরেশ গোস্বামী তাঁর কন্যা সহ জামাতাকে নিয়ে চলে আসেন শান্তিপুরে। শান্তিপুরে এসে মথুরেশ গোস্বামী তাঁর বসতবাটী থেকে কিছুটা দূরে একটি পঞ্চমূণ্ডির আসন স্থাপন করে দেন তাঁর জামাতার সাধনের জন্য কারণ যেহেতু শান্তিপুরের গোস্বামীরা প্রত্যক্ষ ভাবে শক্তির উপাসনা করেন না তাই। সেখানেই সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন সার্বভৌম আগমবাগীশ। মায়ের নির্দেশে তিনি গঙ্গা থেকে মাটি নিয়ে এসে মূর্তি নির্মাণ করে পুজো করেন তারপরই মূর্তি বিসর্জন দিয়ে দেন, এই প্রাচীণ প্রথা আজও হয়ে আসছে মা আগমেশ্বরীর পূজায়। বর্তমাণে এই পঞ্চমূণ্ডির আসন সংলগ্ন স্থানটি "আগমেশ্বরীতলা" নামেই পরিচিত। এইভাবে ঐতিহ্যের সাথে ও আধ্যাত্মিকতার এক উজ্জ্বলতম প্রকাশ দেখা যায় শান্তিপুরের আগমেশ্বরীর পূজায়।
শান্তিপুরের আগমেশ্বরীর পূজার সমস্ত রীতিনীতি ও দায়িত্ববহন করেন বড় গোস্বামী পরিবারের সদস্যরাই। দুর্গাপুজোর বিজয়াদশমীর দিন মা আগমেশ্বরীর পাটে সিঁদুর দেওয়া হয় ও পূজা করা হয়। কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার দিন "পাটখিলান" অনুষ্ঠান পালন করা হয় প্রাচীন রীতি মেনেই সঙ্গে পুজোও হয়। এই আগমেশ্বরী মায়ের উচ্চতা প্রায় ১৬-১৮ফুট, মায়ের সেই নয়নভোলানো জ্যোতি যেন গোটা বঙ্গের ভক্তবৃন্দদের মোহিত করে।
পাটখিলান অনুষ্ঠানের পরই শুরু হয়ে যায় মায়ের মৃন্ময়ীরূপ তৈরি করা। কালীপুজোর দিন মায়ের রঙ হয় এবং রাত্রে হয় চক্ষুদাণপর্ব। দীপান্বিতা কালীপুজোর সমস্ত নিময় মেনেই নিষ্ঠার সাথে পুজো হয় মায়ের। তন্ত্র মতে পুজো হয় মা আগমেশ্বরীর। রাত্রি ৯টার সময় বাড়ির সদস্যরা(বড় গোস্বামী পরিবারের) মাকে গহনা পরান, নবসাজে সজ্জিত করেন দেবীকে। তারপর যিনি মৃৎশিল্পী তিনি সারাদিন উপবাস থেকে শুদ্ধবস্ত্র পরে মায়ের চক্ষুদাণ করেন। এরপর বড় গোস্বামী পরিবারের যিনি সম্পাদক আছেন তিনি মাকে সিঁদুর দান করেন, গন্ধদান, আতরদান করে তারপর মায়ের পুজো শুরুহয়। মোটামুটি রাত্রি ১১টা থেকে ১১.৩০মিনিটে মায়ের পুজো শুরু হয় শেষ হয় প্রায় পরের দিন ভোরবেলা।
মা আগমেশ্বরীর জন্য সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোগ প্রদান করা হয়। এই মায়ের কাছে কোন রকমের পশুবলিপ্রথা নেই, শুধুমাত্র একটি আঁখ ও একটি চালকুমড়ো বলিদান হয়। মায়ের জন্য ৩৬রকমের ব্যঞ্জন ভোগ হয়, অর্থাৎ যতরকমের শাকসবজি আছে, সমস্ত রকমই ভোগ হয় রান্না করেন গোস্বামী বাড়ির দীক্ষিত মহিলারাই। ভোগে থাকে তিন রকমের শাক(লালশাক, কচুরশাক, পালংশাক), শুক্তনি, বিভিন্ন রকমের ডাল(বিউলি, মুগ ইত্যাদি), চালকুমড়োর তরকারি, মিষ্টিকুমড়োর তরকারি, কচুরদম, বাঁধাকপির তরকারি, ছানার ডালনা, এঁচড়ের তরকারি, পোলাও, চালতার চাটনি, টম্যাটোর চাটনি, নানান রকমের মিষ্টান্ন ইত্যাদি থাকে। এছাড়া সেই সময় যতরকমের ফল পাওয়া যায় সমস্ত রকমের ফল নিবেদন করা হয় মা আগমেশ্বরীকে।
মা আগমেশ্বরীর যিনি পুজো করে আসেন তিনি বংশপরম্পরায়, বর্তমানে মায়ের পূজা করছেন শ্রী রঘুনাথ ভট্টাচার্য্য মহাশয়। শুধুমাত্র মায়ের ভোগই নয়, আগমেশ্বরী কালীপুজোর পরের দিন ভক্তগণকে ভোগ বিতরণ করা হয়।
যেমন- ১৪ক্যুইন্টাল গোবিন্দভোগ চাল, ১.৫ ক্যুইন্টাল লক্ষ্মীঘি, ১কুইঃ কাজু, ১কুইঃ কিসমিস ও ১৪কেজি গরমমসলা দিয়ে তৈরি হবে পোলাও, তার সাথে থাকবে সমপরিমান আলুরদম ও পায়েস। প্রতিটি ভক্তবৃন্দ কালীপুজোর পরের দিন মা আগমেশ্বরীর ভোগপ্রসাদ গ্রহণ করবেন এ যেন এক মহাসমারহের স্থান। এই ভক্তবৃন্দদের ভোগরান্না করতে আসবেন নবদ্বীপের এক গোস্বামী আশ্রমের প্রতিনিধিরা। বড় গোস্বামী পরিবারের সদস্যরা ভক্তির সাথে মহাধুমধামের মাধ্যমে মায়ের পুজো করেন যা শান্তিপুর তথা বঙ্গের কালীপুজোর ইতিহাসে অনন্য।
যেমন- ১৪ক্যুইন্টাল গোবিন্দভোগ চাল, ১.৫ ক্যুইন্টাল লক্ষ্মীঘি, ১কুইঃ কাজু, ১কুইঃ কিসমিস ও ১৪কেজি গরমমসলা দিয়ে তৈরি হবে পোলাও, তার সাথে থাকবে সমপরিমান আলুরদম ও পায়েস। প্রতিটি ভক্তবৃন্দ কালীপুজোর পরের দিন মা আগমেশ্বরীর ভোগপ্রসাদ গ্রহণ করবেন এ যেন এক মহাসমারহের স্থান। এই ভক্তবৃন্দদের ভোগরান্না করতে আসবেন নবদ্বীপের এক গোস্বামী আশ্রমের প্রতিনিধিরা। বড় গোস্বামী পরিবারের সদস্যরা ভক্তির সাথে মহাধুমধামের মাধ্যমে মায়ের পুজো করেন যা শান্তিপুর তথা বঙ্গের কালীপুজোর ইতিহাসে অনন্য।
মায়ের পুজোর পরের দিন বিসর্জনের শোভাযাত্রা হবে। আগে মা আগমেশ্বরী কাঁধে করে যেতেন এখন সেই প্রথা বন্ধ। এখন মা ট্রলারেই যান, বিসর্জনপর্ব অনুষ্ঠিত হয় শান্তিপুরের মতিগঞ্জের ঘাটে। আবার একটি বছরের অপেক্ষায় সকল মানুষ বসে থাকবেন আবার মা করে আসবেন তার অপেক্ষায়। সকলের দীপবলী খুব ভালো কাটুক, এি কামনা রইল। বনেদীর-বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে শান্তিপুরের বড় গোস্বামী পরিবারের সদস্যদের জন্য রইল আগাম দীপাবলীর শুভেচ্ছা।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- শ্রী সত্যনারায়ণ গোস্বামী
তথ্যসূত্র সংগ্রহেঃ- শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment