দীপান্বিতাপর্বঃ-৮
আর
অপেক্ষার ৪দিন, আগামী ২৭শে অক্টোবর ২০১৯-দীপাবলী কালীপুজোর অমাবস্যার রাত। বাঙালি মেতে উঠবে আলোর আতসবাজিতে এবং দেবী আরাধনায়। আমাদের বনেদীয়ানা'র সকল অনলাইন মাধ্যমে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে কলকাতা তথা বঙ্গের প্রাচীন কালীপূজা নিয়ে এক দীপান্বিতাপর্ব। আজ আরও এক প্রাচীন কালীবন্দনার কথা তুলে ধরবো, আমি শুভদীপ। আজ যে কালীপুজোর কথা বলব তা বহুবছর ধরে প্রাচীন ধারাকে অনুসরণ করে হয়ে আসছে, তা হল শান্তিপুরের চাঁদুনীবাড়ির কালীপুজো।
শান্তিপুর বাংলার এক ঐতিহাসিক স্থান। যেখানে শাক্ত-বৈষ্ণবধারার পাশাপাশি শৈবধারা, অর্থাৎ হিন্দুধর্মের তিনধারার মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায়। বৈষ্ণব ও শাক্তধারার এক অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখা যায় এই ঐতিহ্যমণ্ডিত শান্তিপুরে। এই অঞ্চলেরই এক ঐতিহাসিক পরিবার মুখোপাধ্যায় পরিবার। আজ সেই পরিবারের প্রাচীন চাঁদুনীবাড়ির কালীপুজোর ইতিহাস জানবো দীপাবলীর পর্বে।
দীপান্বিতায় শান্তিপুরের চাঁদুনীবাড়িঃ- কালীপুজো
বহু দূরদূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষ এবং ভক্তবৃন্দ ছুটে আসেন এই শান্তিপুরে বছরে দুইবার, বলাবাহুল্য সবসময়ই শান্তিপুরের ঐতিহ্য বর্তমান তবুও এই দুই সময়েই ভক্তদের ভিড় যেন দেখার মতন। একবার হল শান্তিপুরের রাস-উৎসব আর দীপান্বিতা কালীপুজো। শান্তিপুরের বহু প্রাচীন কালীপূজার মধ্যে সবথেকে আগে যার নাম উঠে আসে তা হল মা আগমেশ্বরীর, মায়ের সেই অপরূপ নয়নভোলানো জ্যোতি দেখতে কত মানুষ যে ভিড় করেন তা সেই সময়ে না পৌঁছালে বোঝাই অসম্ভব। তাছাড়া আরও প্রাচীন প্রাচীন কালীপুজো হয় এই শাক্ত-বৈষ্ণব ক্ষেত্রে। তাদের মধ্যে অন্যতম হল চাঁদুনীবাড়ির কালীপুজো। সেই বাড়ির সদস্য শ্রী সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় জানালেন সেই ইতিহাস ও রীতিনীতির কথা আমাদের।
চাঁদুনী বাড়িতে কালীপুজোর পাশাপাশি প্রাচীন দুর্গাপুজোও অনুষ্ঠিত হয়। সেই শারদীয়া দুর্গাপুজোর ইতিহাস আমরা আগে বর্ণানা করেছি, এখন আমরা এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের কালীপুজোর ইতিহাসই লিপিবদ্ধ করলাম। প্রসঙ্গত কাশীনাথ মুখোপাধ্যায় (সার্বভৌমের) ভাই গোপীনাথ মুখোপাধ্যায় (সার্বভৌম) তন্ত্রসাধনা করতেন। প্রসঙ্গত বলে রাখি কাশীনাথ মুখোপাধ্যায় এবং তাঁর ভাই গোপীনাথ মুখোপাধ্যায় পণ্ডিত ছিলেন তাই তাঁরা "সার্বভৌম"উপাধি পেয়েছিলেন। এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের প্রতিষ্ঠিত বহু প্রাচীন রঘুনাথ জীউ আছেন, সেই রঘুনাথ জীউকে সেবার জন্য একদিন গোপীনাথ সার্বভৌম বাগানে ফুল তোলার সময় এক বালিকা তাঁর কাছে প্রসাদ পাওয়ার কথা বললে তিনি সেই বালিকাকে বলেন পূজার পর তিনি প্রসাদ দেবেন। পূজা শেষ হলে তিনি প্রসাদ দিতে আসলে সেই বালিকাকে আর খুঁজে পাননি। তারপর একদিন রাত্রে
তিনি মায়ের আদেশ পেয়েছিলেন যে,
"তোর বাড়ির অদূরে এক কূর্মপীঠ আছে, সেখানে পঞ্চমূণ্ডির আসনে আমাকে পূজা কর। তুই যে মন্ত্রে আমাকে পূজা করবি, আমি সেই মন্ত্রেই সন্তুষ্ট হবো।" স্বপ্নাদেশ শেষ হলে গোপীনাথ সার্বভৌম স্বপ্নের কথা তাঁর মাকে বলেন। তখন গোপীনাথ সার্বভৌমের মা স্বপ্নাদেশের নির্দেশ মতন মায়ের বিগ্রহ তৈরি করে দেন।
এই মুখোপাধ্যায় বাড়িতে কালীপুজোর আলাদা পুঁথি আছে যেই পুঁথি গোপীনাথ সার্বভৌম লিখেছিলেন সেই পুঁথি দেখেই মায়ের পুজো হয়। মুলত এই চাঁদুনীবাড়ির কালীপুজোয় দেবীঘট থাকলেও মূলপূজা দেবীর যন্ত্রেই অনুষ্ঠিত হয়। কালীপুজোর
দিন সকালে মুখোপাধ্যায় বাড়ির কুলবধূ দেবীর ঘটে জল ভরতে যান সেই ঘটে দেবীর পূজা হয়।
এই
বাড়িতে দুর্গাপুজোর দশমীর দিন বাড়ির ছেলেরা চাঁদুনী মায়ের কাঠামো দুর্গাদালানে নিয়ে আসেন মন্দির থেকে সেই কাঠামোতে বাড়ির সবথেকে বয়ঃজ্যেষ্ঠা তিনি মায়ের কাঠামোতে মাটির প্রলেপ দেন তারপর মায়ের মূর্তি তৈরী শুরু হয়। কালীমন্দিরের সামনে এক নহবতখানা তৈরী করা হয় যেখানে কালীপুজোর অমাবস্যার আগের একাদশীতিথি থেকে সানাই বসানো হয় যারা ৮প্রহরে ৮বার বাজানো হয়। চাঁদুনী মাকে ডাকের সাজ পরানো হয়।কালীপুজোর আগের দিন চাঁদুনীমায়ের কেশসজ্জা বাড়ির ছেলেরা করেন জবাকুসুমতেল দিয়ে।সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল চাঁদুনী মাকে মোমের দুটি মালা পড়ানো হয় একটি লাল এবং একটি বেলগোলাপের , যা মোম দিয়ে তৈরী। চাঁদুনী মায়ের বিগ্রহ বাড়ির দুর্গাদালানেই তৈরী হয় এবং পুজোর দিন বাড়ির ছেলেদের কাঁধে করে তিনি মন্দিরে যান। সমস্ত রকমের স্বর্ণালংকার এবং রৌপালংকার পরানো হয়। যেমন- সোনার কামরাঙার মটরমালা, সোনার বাজুবন্ধ, পুষ্পহার, সীতাহার, মায়ের বুকে সোনার প্রজাপতি থাকে, শাঁখাবাঁধানো, নোয়াবাঁধানো, রতনচুর, হাতপদ্ম, কোমরবন্ধনী ইত্যাদি বিভিন্ন রকমের গহনা পরানো হয়।
চাঁদুনী মাকে দুর্গাদালান থেকে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে খীরের মিষ্টি প্রদান করা হয় এবং রূপোর ছাতায় তিনি মন্দিরে যান এবং পঞ্চমুণ্ডীর আসনে তাঁকে বসানো হয়। চণ্ডীপাঠ হয়, খাঁড়াপূজাও হয়। চাঁদুনী মায়ের পূজা নিশিরাতে হয় এবং বাড়ির বয়ঃজ্যেষ্ঠ সদস্য তিনি মায়ের পূজা করেন। পরিবারের কালীপুজোয় পাঁঠাবলি হয়।এই চাঁদুনীবাড়ির কালীপুজোর পাঁঠাবলিপ্রথা যা বহু প্রাচীন, অনেক ভক্তরা মায়ের কাছে মানত পূরণের জন্য পাঁঠা প্রদান করেন বলিদানের জন্য। নিরামিষ ভোগ প্রদান করা হয়। বিশেষত চাঁদুনী মায়ের জন্য বিশেষ সজ্জাও প্রদান করা হয়। কালীপুজোর সময় বাড়ির গৃহদেবতারা তাঁরাও মন্দিরে উপস্থিত থাকেন। ভোগে থাকে আট রকমের ভাজা, পোলাও, সাদাভাত, খিঁচুড়ি, কলার বড়া,চালতার চাটনি, পায়েস,মিষ্টান্ন, ইত্যাদি। সেইসময় ভিয়েন বসিয়ে গজা, পকান্ন তৈরী করা হয় যা দূরদূরান্তে প্রসাদ হিসাবে যায়।
চাঁদুনী মায়ের গোটা ফলের নৈবেদ্য হয় এবং বারোমাসের যা যা ফল সমস্ত রকমের ফল এবং সবজী মাকে প্রদান করা হয়। পরের দিন মায়ের কাঁধে করে বিসর্জন হয়। বাড়ির মেয়ে শ্বশুরের গৃহে ফিরে যাচ্ছেন বলে বিসর্জনের মাঝরাস্তায় বাজনা বন্ধ করে শোক পালন করা হয়।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী শান্তিপুরের এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের কালীপুজো। বনেদীয়ানা কৃতজ্ঞ সঞ্জয় বাবুর কাছে এই অপরূপ দেবীপূজার বর্ণনা বনেদীয়ানা'কে প্রদান করার জন্য। বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে চাঁদুনীবাড়ির সকল সদস্যদের জন্য রইল আগাম শুভ দীপাবলীর শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- শ্রী সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
তথ্যসূত্র লিপিবদ্ধেঃ-শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment