দীপান্বিতাপর্বঃ-১৪
আজ ধনত্রয়োদশী তিথি, অপেক্ষার আর একটি দিন। আগামী রবিবারই আলোর উৎসব। বনেদীয়ানা'র কালীপর্বে আজ
দুই
কালীপুজোর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করলাম আমরা। বঙ্গের বহু প্রাচীন কালীমন্দির এই রায় চৌধুরী পরিবারের তৈরি। চলুন দেখা যাক সেই কালীপুজোর ইতিহাস। একজন হলেন পানিহাটির সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির ও দক্ষিণ কলকাতার লেক কালীবাড়ি।
দীপান্বিতায় দুই জনপ্রিয় কালীপুজোঃ- পানিহাটি ও কলকাতা
পানিহাটি সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরঃ- বঙ্গের প্রতাপশালী জমিদার পরিবারের মধ্যে অন্যতম এই সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবার। ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব এই চৌধুরীদের সম্পর্কে বলেছিলেন-" এঁরা দক্ষিণেশ্বরের সাবর্ণ চৌধুরী। এঁদের প্রতাপে সেকালে বাঘে-গরুতে একসঙ্গে জল খেত। এঁরা লোকের জাত দিতে নিতে পারতেন তবে ভক্তিমানও ছিলেন খুবই, এই বাড়িতে কত যেতুম, ভাগবত পুরাণপাঠ শুনতুম...।" যাই হোক আমরা আজ সেই চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠিত আরও দুইটি কালীপুজোর কথাই আলোচনা করবো।
পানিহাটিতে যেমন রয়েছেন চৈতন্য মহাপ্রভু পূজিত রাঘব পণ্ডিতের শ্রীশ্রীমদনমোহন ও শ্রী রঘুনাথ দাস গোস্বামীর শ্রীশ্রী রাধারমন জউ-রাঘব ভবন বা পাঠবাড়ী, তেমন আছেন জমিদার রায় চৌধুরীদের শ্রীশ্রীরাধাগোবিন্দজী ও সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, যা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব প্রকাশ। এখানে বলাবাহুল্য যে রাঘব পণ্ডিতের সেই প্রাচীন শ্রীশ্রী মদনমোহন হলেন সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহ, যিনি বর্তমানে রাঘবভবনে আছেন। চলুন দেখা যাক সেই দুই প্রাচীন কালীপুজোর কথা। পানিহাটি সিদ্ধেশ্বরী কালী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গৌরীচরণ রায় চৌধুরী, যিনি ছিলেন লর্ড ক্লাইভের সময় নাটোরের রানী ভবানীর দেওয়ান। সেই সময় গৌরীচরণ রায় চৌধুরীর জমিদারি পানিহাটি-দুর্গাপুর যে কিরূপ বিশাল ছিল তার প্রমাণ সরকারী গেজেটের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব। ১৭৯৩ সাল অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে বর্ধমান মহারাজার পরেই পানিহাটির চৌধুরী বাবুরা সবথেকে বেশি রাজস্ব দিতেন। এই গৌরীচরণ রায় চৌধুরীর পুত্র জয়গোপাল রায় চৌধুরী ছিলেন ভক্তমানুষ, দান-ধ্যান ইত্যাদি সেবামূলক কাজে থাকতেন সবসময়। কাশী থেকে ফিরে তিনি বহু মন্দির, রাস্তা, দেবালয় নির্মাণ করেছিলেন। পানিহাটির রাধাগোবিন্দজী, সিদ্ধেশ্বরী কালী গৌরীচরণ প্রতিষ্ঠা করলেও তাঁদের মন্দির নির্মান করেন জয়গোপাল রায় চৌধুরী। শুধু তাই নয় রাসমঞ্চ, স্নানের ঘাট, চারটি আটচালা শিবমন্দির, সদাশিবের মন্দির, সপ্তখিলানের দুর্গাদালান ইত্যাদিও তৈরি করেছিলেন পানিহাটির চৌধুরীরা।
মূলত সিদ্ধেশ্বরী কালী পদ্মাশনে বসা দুই হাতের বিগ্রহ। এনার প্রথমে শিব ছিলেন না, পরবর্তীকালে একদিন চৌধুরী বংশের জমিদার স্নান করতে গিয়ে একটি শিবলিঙ্গ লাভ করেছিলেন তিনিই সদাশিব, যিনি মায়ের মন্দিরের ঠিক পাশেই প্রতিষ্ঠিত আছেন। এই মন্দিরে কালীপুজোর দিন ভক্তসমাগন দেখার মতন। নিশিরাতে মায়ের পুজো হয় প্রাচীন নিয়ম মেনেই। ফলবলির প্রথা আছে। মায়ের জন্য এখানে খিচুড়ি, সাদাভাত, পোলাও, সাত রকমের ভাজা, নানান তরকারি, পায়েস ইত্যাদি ভোগ হয়।
দক্ষিণ কলকাতার লেক কালীবাড়িঃ-
দক্ষিণ কলকাতার কালীবাড়িগুলির মধ্যে খুবই জনপ্রিয় কালীমন্দির হল সাউদার্ণ এভিনিউ'র লেক কালীবাড়ি। শ্রীশ্রী হঁরিপদ চক্রবর্তী ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন করুণাময়ীরূপে মা দক্ষিণাকালীকে। বছরের প্রতিটি দিনই মায়ের নিত্যপূজা হয় ভক্তি ও নিষ্ঠার সাথে। কালীপুজোর দিন ভক্তদের ভিড় যেন দেখার মতন হয় এই কালীবাড়িতে। পুরানো মন্দিরের ঠিক পিছনেই তৈরি হচ্ছে নতুন মায়ের মন্দির। সম্পূর্ণ হলে মায় সেই নতুন মন্দিরে বিরাজ করবেন মা করুণাময়ীরূপে সকল মানুষের জন্য। সর্বজনের জন্যই মায়ের দ্বার উন্মুক্ত। নিময় নিষ্ঠা মেনেই মায়ের পুজো হয়। পশুবলিপ্রথা নেই এখানে তবে ফলবলি হয়। হাজার হাজার মানুষ প্রার্থনা করেন লাল সুতো বেঁধে। ভোগে থাকে খিচুড়ি, সাদাভাত, পোলাও, ভাজা, তরকারি, পায়েস ইত্যাদি নিবেদন করা হয়, অর্থাৎ নিরামিষ ভোগই দেওয়া হয় মাকে। কালীপুজোর দিন এইভাবেই মায়ের পুজো হয়।
তথ্যসূত্র লিপিবদ্ধেঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment