দীপান্বিতাপর্বঃ-৪
কালীপুজো আগামী ২৭শে অক্টোবর ২০১৯ দীপান্বিতা কালীপুজো। কলকাতা তথা বঙ্গের প্রাচীন কালীমন্দির সহ বনেদীবাড়ির ঠাকুরদালানে কালীপুজো অনুষ্ঠিত হবে। আর কালীপুজোর একসপ্তাহ আগে বনেদীয়ানা পরিবার প্রকাশ করল কলকাতার অন্যতম কালীমন্দিরের ইতিহাস। যে মন্দিরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অপরিসীম। প্রকাশিত হল দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জ মা করুণাময়ী কালীমন্দিরের ইতিহাস। এবছর করুণাময়ী কালীমন্দিরে কালীপূজা ও প্রতিষ্ঠা দিবসের ২৬০তম বর্ষ। চলুন দেখা যাক সেই প্রাচীন মন্দিরের ইতিহাস।
দীপান্বিতায় মা করুণাময়ীঃ- টালিগঞ্জ, কলকাতা
"....সুবর্ণালঙ্কৃততনুঃ সাবর্ণিকুলপূজিতা।
ভবার্ণবতারিত্রী যা নমস্তে করুণাময়ী।।৭
সর্পাভরণবামার্ধ দর্পাদিদোষনাশিনী।
সর্ব্বপাপহরা সাধ্বী নমস্তে করুণাময়ী।।৮.."
টালিগঞ্জের কুঁদঘাট সংলগ্ন মজে যাওয়া প্রাচীন আদিগঙ্গা যা বর্তমানে সাধারণের কাছে 'টালি নালা'নামে পরিচিত, তারই উপকূলে একটি প্রাচীন জনপদ একদিন পুঁটিয়ারী নাম ধারণ করে স্থানীয় মানুষের কাছে আত্মপ্রকাশ করলো। এই সিদ্ধপীঠ মা করুণাময়ী কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাবর্ণ গোত্রীয় কুলতিলক নন্দদুলাল রায় চৌধুরী। প্রসঙ্গত কালীঘাটের কালীমন্দির নির্মাণ করা ছাড়াও সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের অনেক স্বনামধন্য পুরুষেরা বড়িশা, সরশুনা ও বেহালার নানাস্থানে তাঁদের স্মরণীয় কীর্তিস্বরূপ দ্বাদশ শিবমন্দির, রাধাকান্ত মন্দির, চণ্ডীমন্দির, অন্নপূর্ণা মন্দির, জগন্নাথ মন্দির, চণ্ডীমণ্ডপ ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন।
বাংলার অধ্যাত্ম ইতিহাসের পাতা দেখলে দেখা যাবে এই সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারে অনেক বিখ্যাত শক্তিমান সাধকের জন্ম হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে ঈশ্বরকোটি মহাপুরুষ যোগীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণদেবের লীলাপার্ষদের ভূমিকায় থাকার কারণে এই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
এই
বংশের কুলতিলক কেশবরাম রায় চৌধুরীর সময়েই লক্ষ্মীকান্তের বিশাল জায়গীর তাঁর উত্তরসুরিদের মধ্যে আপোষে ভাগ হয়। অতি অল্প বয়সেই কেশবরাম সমগ্র বাংলাদেশে নিজেকে এক সুপ্রশাসক ও দক্ষ ভূস্বামীরূপে প্রতিষ্ঠিত করেন। রাজমহলে অধিষ্ঠিত বাংলার তৎকালীন নবাব তাঁর ভূমি-সংস্কার ও অন্যান্য হিতকর কাজকর্মে খুশী হয়ে ১৬৯৯ সালে এক বিশেষ সনদে তাঁকে নিশান্, খেলাত্, অতিরিক্ত জায়গীর ও স্বতন্ত্র 'রায় চৌধুরী' খেতাব প্রদান করেন। নিজের দক্ষতা ও বিচক্ষণতার বলে অচিরেই হয়ে ওঠেন সমগ্র দক্ষিণবঙ্গের সমাজপতি।
কেশবরাম রায় চৌধুরীর দ্বিতীয়পুত্র কৃষ্ণদেব রায় চৌধুরীর একমাত্র পুত্র নন্দদুলাল জন্ম নেন ১৭২২ সালে। নন্দদুলালের পরপর তিনটি পুত্রসন্তান হয়েছিল, যথাক্রমে- রাঘবেন্দ্র, রামচরণ ও জগন্নাথ। নন্দদুলালের কাকা শিবদেব অর্থাৎ সন্তোষ রায় চৌধুরী বহু অর্থ ব্যয় করে কালীঘাটের মন্দির তৈরি শুরু করেন ও শিবদেবের উত্তরসুরি রাজীবলোচন ১৮০৯ সালে সেই মন্দিরের নির্মান কার্য শেষ করেন। নন্দদুলাল রায় চৌধুরীর তিন পুত্রসন্তানের পর তাঁর একটি কন্যাসন্তানের ইচ্ছা ছিল। তাঁর ইচ্ছা মতন তিন পুত্রসন্তানের পর একটি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। নাম তাঁর করুণাময়ী। কিন্তু মাত্র সাত বছর বয়সে করুণাময়ীর অকালপ্রয়াণ ঘটল। কন্যার মৃত্যুতে নন্দদুলাল মর্মাহত হলেন। জীবনের উথালপাতাল মানসিক বিপর্যয়ে একদিন রাত্রে স্বপ্নে দেখলেন তাঁর মৃত কন্যা করুণাময়ী বলছে-"বাবা তুমি কেঁদো না, আমি তোমায় কোনদিনই ছেড়ে যেতে পারবো না। কাল ভোরে তুমি আদিগঙ্গার ঘাটে যেও, সেখানে একটি কষ্টিপাথর দেখতে পাবে একটি বটগাছের তলায়। সেই পাথর দিয়ে তোমার ইষ্টমূর্তি গড়ে প্রতিষ্ঠা করো। আমি ওই মূর্তির মধ্যেই চিরদিন চিন্ময়ী রূপে বিরাজ করবো।" পরের দিন ভোরবেলা নন্দদুলাল গঙ্গার ঘাটে যাওয়ায় ঠিক একটি কষ্টিপাথর দেখতে পেলেন। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে সেই শিলা তুলে নিয়ে এলেন। তরপর শুভদিনে জনৈক ভক্ত ভাস্করকে দিয়ে নির্মাণ করালেন মায়ের স্বপ্নাদিষ্ট সেই অপূর্ব নয়নাভিরাম করুণাময়ী মূর্তি।
১৭৬০ সালে কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল সেই মূর্তির। নির্মিত হল নবচূড়া সহযোগে মা করুণাময়ীর নবরত্ন মন্দির। কালের বিধ্বংসী স্রোতে ও সংরক্ষণের অভাবে ১৪০বছরের মধ্যেই মা করুণাময়ীর সেই নবরত্ন মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়। সেই প্রাচীন নবরত্ন মন্দির দেখে অভিভূত হয়েছিলেন রাণী রাসমনি এবং মা করুণাময়ীর মন্দিরের আদলেই দক্ষিণেশ্বরের নবরত্ন মন্দির নির্মান করেছিলেন রাসমনি। পুরানো মন্দির ধ্বংস হলেও নন্দদুলালের সেই প্রতিষ্ঠিত করুণাময়ী ও মহাকালের মূর্তি আজও অম্লান রূপে বিরাজমান। নন্দদুলালের দ্বিতীয় পুত্র দুর্গাদাসের পরিবারের তৃতীয় পুরুষ মনিমোহনের আমলেই নবরত্ন মন্দিরের স্থানে একটি আটচালা মন্দির স্থাপিত হয়। তারপরে মনিমোহনের চতুর্থপুত্র অসিত রায় চৌধুরীর আমলে মন্দির সংরক্ষন শুরু হয়। ১৯৮৫ সালে নবকলেবরে মন্দির নির্মিত হয় ও উদ্বোধন হয়। তব বাহ্যিক পরিবর্তনের মাঝেও অপরিবর্তিত অবস্থানে আজও হাস্যময়ী সেই আড়াইশো বছরেরও প্রাচীন নন্দদুলালের আদরিনী সাত বছরের কন্যা করুণাময়ী।
কালীপুজোর দিন বহুভক্তের সমাগম হয়। করুণাময়ী কালীমন্দিরের বৈশিষ্ট্য হল কালীপুজোর দিন এই মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় কুমারীপুজো। সেই দিন করুণাময়ীকে রাজবেশে সাজানো হয় অলংকার দিয়ে। রাত্রে মায়ের জন্য সমস্ত রকমের ভোগের পদ থাকে। ১১রকমের মাছ, ৭রকমের ভাজা, ৭রকমের তরকারি, সাদাভাত, পোলাও, লুচি, ছোলারডাল, দই, মিষ্টি, পায়েস ইত্যাদি নানান রকমের ভোগ দিয়ে মাকে নিবেদন করা হয়। ভক্তি ও মহাসমারহে আজও মায়ের পুজো হয়ে আসছে টালিগঞ্জের করুণাময়ী কালীমন্দিরে। এবছর করুণাময়ী কালীমন্দিরে ২৬০তম বর্ষ। শুক্রবার থেকেই শুরু হয়ে যাবে অনুষ্ঠান। তিনদিন ধরে মায়ের মন্দিরে হবে ভক্তিগীতির আসর সাথে পুজো এবং ভক্তের লাইন তো রয়েছেই। আমরা বনেদীয়ানায় সেই অনুষ্ঠান সূচী তুলে ধরলাম।
তথ্যসূত্র লিপিবদ্ধেঃ- শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment