দীপান্বিতাপর্বঃ-৭
বহুদিন ধরেই শুরু হয়েছে আমাদের বনেদীয়ানা'য় কালীপুজোর ইতিহাস নিয়ে দীপান্বিতাপর্ব। বহু প্রাচীন কালীমন্দির ও বাড়ির কালীপুজো নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। আজও দুই সিদ্ধেশ্বরী মন্দির নিয়ে রচনা প্রকাশিত হল। একটি শান্তিপুরের প্রাচীন সিদ্ধেশ্বরী মন্দির ও হালিশহরের সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির। লিখলেন শুভদীপ রায় চৌধুরী। চলুন দেখা যাক আলোর উৎসব শুরুর আগে এই দুই প্রাচীন মন্দিরের ইতিহাস।
দীপান্বিতায় দুই সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরঃ- শান্তিপুর ও হালিশহর
শান্তিপুরের সিদ্ধেশ্বরীঃ- শান্তিপুর বৈষ্ণব ও শাক্তদের মেলবন্ধনের পীঠস্থান। বহু প্রাচীন বিগ্রহ ও মন্দির রয়েছে এই শান্তিপুরে। ইতিহাসের সাক্ষী এই শান্তিপুর। নদীয়া জেলার শান্তিপুর একটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান, বিশেষত গঙ্গার তীরবর্তী জনপদ। এছাড়া সবথেকে উল্লেখযোগ্য হল তন্ত্রসিদ্ধ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের প্রাচীন আগমশ্বরী, যে পুজো দেখতে বঙ্গদেশ ছাড়াও ভারতবর্ষ থেকে ভক্ত ছুটে আসে। তেমনই শান্তিপুরের প্রাচীন সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরও এক ঐতিহাসিক স্থান। এই সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির তৈরি করা হয় ১৬০৬ সালে, যা আজ প্রায় ৪০০বছর অতিক্রান্ত। তৎকালীন রাজা ভবানন্দ মজুমদার(কৃষ্ণচন্দ্রের ঠাকুরদাদা), তিনি পার্বতীচরণ মুখোপাধ্যায় অথবা মতান্তরে ফকিরাচাঁদ মুখোপাধ্যায়কে এই মন্দিরের দায়িত্ব তুলে দেন। এই মুখোপাধ্যায় পরিবারের আদি পদবী ওঝ(কৃত্তিবাসের বংশধর)। মন্দিরের বার্ষিক পূজা হয় দীপান্বিতায়। এছাড়া অক্ষয়তৃতীয়া বা বিভিন্ন পূজায় মন্দিরে দর্শনার্থীদের ভীড় দেখবার মতন। শান্তিপুরে যে কটি কালীপূজা হয় এই সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে পুজো দিয়ে শুরু হয়। সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের সামনে নাটমন্দির তৈরি করা হয় পরবর্তীকালে। তৈরি করেছিলেন সরকার পরিবারের সদস্য। আগে সিদ্ধেশ্বরী কালীমূর্তি আগে মাটির ছিল পরবর্তীকালে পাথরের মূর্তি তৈরি করা হয়(১৩৮৭ বঙ্গাব্দে), কাশী থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল এই মূর্তি।
এই
মন্দিরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল দীপান্বিত কালীপুজোয় প্রত্যেক বছর অমাবস্যার রাত ১১.৪০মিনিটে শুরু হয়, শেষ হবে পরের দিন ভোর ৪টে। অতীতে বলিদানপ্রথা হলেও বর্তমানে বন্ধ এই বলিদানপ্রথা। প্রায় ৫০কেজি বা তারও অধিক চালের ভোগ নিবেদন করা হয় দেবী সিদ্ধেশ্বরীকে। মাকে পোলাও, খিচুড়ি, সাদাভাত, পায়েস, লুচি, ভাজা, সুজি, মাছ, তরকারি, চাটনি ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। সাথে দীপাবলীতে হোমও হয়ে থাকে। সেই দিন রাত্রে মাকে রাজবেশে সাজানো হয়। পরের দিন সকালে ভোগ বিতরন করা হয় এবং প্রায় ১০০০খানেক ভক্ত বসে প্রসাদ খায় মায়ের। ঐতিহ্য ও আভিজাত্যে আজও অটুট এই শান্তিপুরের সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির।
হালিশহরের সিদ্ধেশ্বরীঃ- হালিশহর হল শান্তিপুরের মতন শাক্ত, বৈষ্ণব ও শৈবদের পীঠস্থান। সাধক রামপ্রসাদের সাধনপীঠ এই হালিশহরে এছাড়া সাবর্ণদের শ্যামরায়, বুড়োশিব ইত্যাদির জন্য হালিশহর বিখ্যাত আজও আর তাছাড়া রাণী রাসমনির জন্যও হালিশহরবাসী আজও গর্ব অনুভব করে। সেই কুমারহট্ট হালিশহরের ঐতিহ্যপূর্ণ কালীমন্দির সিদ্ধেশ্বরী। কালিকাতলা গঙ্গা স্নানের ঘাটের বা বর্তমান নিগমানন্দ সারস্বত মঠের পশ্চিম দিকে একটি মন্দির নির্মান করা হয়েছিল কালিকাদেবীর মূর্তি প্রায় সাড়ে তিনশত বছর আগে। কালিকাদেবী নামানুসারেই এই অঞ্চলের নাম হয় "কালিকাতলা"।
সাবর্ণ গোত্রীয় বিদ্যাধর রায় চৌধুরী গঙ্গায় স্নান করতে করতে একটি শিলাখণ্ড লাভ করেন সেই শিলাখণ্ড দিয়ে তিনি বুড়োশিব, শ্যামরায় ও সিদ্ধেশ্বরী মূর্তি তৈরি করেন। এই সিদ্ধেশ্বরীর মূর্তি তৈরি করেন এক অন্ধ ভাস্কর, মায়ের আদেশেই। কালোপাথরের সিদ্ধেশ্বরী তৈরি হলেন সেই নয়নভোলানো জ্যোতি, শ্বেতপাথরের শিবের ওপর সিদ্ধেশ্বরী দণ্ডায়মানা। দীপাবলীতে মহাসমারহে এই মন্দিরে কালীপুজো হয়। এই কুমারহট্ট হালিশহরের দরিদ্র গৃহস্থের কন্যা রানি রাসমনি বিবাহের পর এই মন্দিরকে সুন্দর করে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তৎকালীন রক্ষণশীল সমান তাঁকে সেই অনুমতি দেন নি।
সিদ্ধেশ্বরী
দেবীর মূর্তি কুমারহট্ট হালিশহর থেকে বলিদাঘাটায় স্থানান্তরিত হওয়ার সময় ১৯৫৬ সালে মূল্যবান কষ্টিপাথরের কালী কেবল চুরি হয়ে যায় কিন্তু শ্বেতপাথরের শিব আজও বর্তমান এই মন্দিরে। কালীপুজোর দিন বহু ভক্তসমাগম হয়। মায়ের রাজবেশ হয় সেই দিন। পঞ্চব্যঞ্জনে ভোগ নিবেদন হয় এই মন্দিরে। সবমিলিয়ে নিষ্ঠার সাথে ও ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ন রেখে আজও পুজো হয়ে আসছে হালিশহরের সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরের দেবী কালিকা।
তথ্যসূত্র লিপিবদ্ধেঃ- শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
চিত্রঝণঃ- শ্রীমান্ বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও লেখক।
No comments:
Post a Comment