Tuesday, October 15, 2019

দীপান্বিতায় হংসেশ্বরী কালীঃ- বাঁশবেড়িয়ায়


দীপান্বিতাপর্ব-
আজ থেকে শুরু হল দীপান্বিতাপর্ব আলোচনা বনেদীয়ানা পরিবারে শুরু হল আলোর উৎসবের সাথে সাথে ইতিহাসের সন্ধান আজ লিখলেন বনেদীয়ানা পরিবারের সদস্যা শ্রীমতী দেবযানী বসু- হংসেশ্বরী কালীমন্দিরের ইতিহাস 
দীপান্বিতায় হংসেশ্বরী কালীঃ- বাঁশবেড়িয়ায়


 দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে বাংলায় কালী সাধনার জোয়ার দেখা যায় দেশে যত কালীমন্দির রয়েছে তার প্রায় সবই শিবের বক্ষের ওপর দণ্ডায়মানা কালীমূর্তি ডান পা শিবের বক্ষে থাকলে দক্ষিণাকালী আর বাম পা থাকলে তিনি হয়েছেন বামাকালী কিন্তু বাংলায় ধর্মের বিচিত্রতায় উপবিষ্টা বা বসে থাকা অবস্থায় কালীমূর্তিও দেখা যায় এইরকম দুটি কালীমূর্তির কথা বলা হল অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে বাংলার হুগলি জেলায় বাঁশবেড়িয়া রাজবাড়ির অন্দরমহল রাজপরিবারে জন্মেছে এক সর্বসুলক্ষণযুক্ত শিশুসন্তান এই শিশুই পরবর্তীকালে পরিচিত হন বাঁশবেড়িয়ার রাজা নৃসিংহদেব নামে অথচ কারও মনে সুখ নেই কারণ তার পিতা রাজা গোবিন্দ দেবরায় 'দিন আগেই প্রয়াত হয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে নবাব আলিবর্দী খাঁ স্টেট অধিগ্রহণ করেন তৎকালীন যুগে ১৩লক্ষ টাকার বিশাল জমিদারি সম্পত্তি ছিল বাঁশবেড়িয়া রাজপরিবারের ইতিমধ্যে নবাবি রাজত্বের শেষ হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে আসে স্টেট রাজত্ব বিলেতে স্টেট অব কাউন্সিলে আবেদন করা হয় সম্পত্তি ফেরত পাওয়ার জন্য কিন্তু এই আবেদন করার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন ছিল সেই মুহূর্তে তা ছিল না রাজকোষে তখন মনোকষ্টে রাজা নৃসিংহ দেবরায় চলে যান কাশীধামে সেখানে সাধুসঙ্গ, সাধনভজনে নিজেকে নিযুক্ত করেন কাশীতেই তিনি সিদ্ধিলাভ করেন এবং হংসেশ্বরী দেবীমূর্তির পরিকল্পনা করেন কাকতালীয়ভাবে এইসময় বাঁশবেড়িয়ার রাজবাড়ি থেকে খবর যায় বিলেতে আবেদন করার প্রয়োজনীয় টাকার জোগাড় হয়েছে ফিরে আসেন নৃসিংহ দেবরায় সম্পত্তি রাজত্ব ফিরে পান শুরু করেন কুলদেবী হংসেশ্বরী মায়ের মন্দির
এই মন্দির মূর্তির পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে নৃসিংহদেবের ভারতীয় শাস্ত্রের অতি প্রাচীন শত-চক্র-বেদের তান্ত্রিক মতের ওপর প্রতিষ্ঠিত মন্দিরও মূর্তি আত্মাকে উপলব্ধি করতে গেলে যে দুটি ধাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তারই সর্বশেষ স্তরে উৎপত্তি হয় কুলকুণ্ডলিনী শক্তি সেই কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে মূর্তিতে জাগরিতা করেছেন রাজা নৃসিংহদেব ১৮০১ সালে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় মন্দিরের ১৮০২ সালের মাধ্যে মন্দিরের একতলা সম্পূর্ণ করে হংসেশ্বরী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন নৌকায় কাশীর নিকটস্থ চুনার থেকে পাথর নিয়ে এসে মন্দির তৈরি করেন স্থপতি ছিলেন একজন মুসলিম কাশী থেকে এসেছিলেন তিনি কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রাজা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না মন্দির ১৮০২ সালেই মৃত্যু হয় তাঁর নৃসিংহদেবের দুই স্ত্রী ছিলেন প্রথমা স্ত্রী রানি ভবানন্দময়ী রাজার সঙ্গে সহমরণে যান দ্বিতীয়া স্ত্রী রানি শঙ্করী ছিলেন মহীয়সী নারী তিনিই অসম্পূর্ণ মন্দির সম্পূর্ণ করেন ১৮১৪ সালে ২৭. মিটার উচ্চ এই মন্দির ৫টি তলায় বিভক্ত ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাস চিত্রিণী এই পাঁচটি নাড়ির প্রতীক এটি কারুকার্যখচিত ১৩টি চূড়া মন্দিরে শোভা বাড়িয়েছে বহুগুণ প্রতিটি চূড়ার নীচে রয়েছে একটি কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ আত্মদর্শনর জন্য যেসব ধাপ পেরোতে হয় তারই পূর্ণরূপ এই মন্দির হংসেশ্বরী মায়ের মূর্তি রয়েছে মন্দিরের ঠিক মাঝে, তার উপরের চূড়াতে রয়েছে শ্বেত শিবলিঙ্গ মন্দিরটি ঈষৎ গোলাপি রঙের, সামনে বিরাট বাঁধানো চত্বর গর্ভগৃহের সামনে একটি সুগভীর ফোয়ারা এই ফোয়ারাটিতে একসময় জল আসত গঙ্গা থেকে এখন অবশ্য ফোয়ারাটি শুকনো গর্ভগৃহে হংসেশ্বরী মায়ের অপরূপ মূর্তি বেদী থেকে শুরু করে মূর্তি-সবটাই তন্ত্রসাধনা করে উপলব্ধি করেছিলেন নৃসিংহদেব তাই এমন মন্দির মূর্তি দ্বিতীয়টি দেখা যায় না বাংলাতে হংসেশ্বরী মূর্তিটি নিমকাঠের, চতুর্ভূজা, নীলবর্ণা, বস্ত্রপরিহিতা, শান্তিরূপিণী উপরের বাম হাতে কৃপাণ, নীচের হাতে নরমূণ্ড ডানদিকের দুটি হাতে অভয় বরদানমুদ্রা ত্রিকালদর্শী শ্বেতশুভ্র পাথরের মহাকাল শুয়ে আছেন উত্তর-দক্ষিণে তাঁর হৃদপিণ্ড থেকে উথ্থিত পদ্মের ওপর মা হংসেশ্বরী ডান পা শিবের বুকে ঝুলিয়ে, বাম পা ভাঁজ করে আসীনা মায়ের পিছনে রয়েছে কল্পতরু বৃক্ষ যে বেদীতে মায়ের অধিষ্ঠান সেটি দ্বিস্তরী নীচের অংশ নীল সহস্রদল পদ্ম, ওপরের স্তর গোলাপি অষ্টদল পদ্ম বেদীর ভেতরে রয়েছে পঞ্চমূণ্ডির আসন এক হাজার শালগ্রাম শিলা 'হংস'মানে সদাশিব, আত্মা জ্ঞান তার যিনি ঈশ্বরী তিনিই হংসেশ্বরী তিনি পরমাশক্তি, ব্রহ্মস্বরূপিণী 

সারা বছর মায়ের শান্তরূপ পূজিতা হলেও কার্তিকী অমাবস্যার রাতে কালীপূজাতে মায়ের কিন্তু ভিন্নরূপ ঐদিন দক্ষিণাকালীর মন্ত্রে পূজা হয় হংসেশ্বরীর দেবীকে কালীরূপে সাজানো হয় অভিনবভাবে খুলে নেওয়া হয় গায়ের বস্ত্র সোনার জিবসহ একটি মুখোশ পরানো হয় দেবীকে তাতে থাকে স্বর্ণমুকুট, এলোকেশ ঘন, দীর্ঘ কৃষ্ণকুন্তলে ঢাকা থাকে মায়ের অঙ্গ গায়ে পরানো হয় অলংকার হংসেশ্বরী মন্দিরে আগে ছাগ, মহিষ বলির প্রথা ছিল এখন তা বন্ধ হলেও কালীপুজোর রাতে বলিদান হয় মায়ের ভোগে থাকে আমিষান্ন, মাছের ভোগ এছাড়া স্নানযাত্রার দিন মায়ের প্রতিষ্ঠা দিবস তাই ঐদিনও পুজো হয় মহাসমারহে 
বর্তমানে এই হংসেশ্বরী মন্দির তার লাগোয়া বিষ্ণুমন্দির স্বয়ংভবা মন্দির আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে রয়েছে কিন্তু দেবীর নিত্যপূজা হয় নিয়মনিষ্ঠা মেনেই বছরের বড় পুজো, উৎসব ছাড়াও প্রতিদিন দলে দলে দর্শনার্থী আসেন মন্দিরে পূজা দেন, বলি মানত করেন মায়ের অপরূপ রূপ চোখ ভরিয়ে দেন, মন তৃপ্ত করে
তথ্যসূত্র লিপিবদ্ধেঃ- শ্রীমতী দেবযানী বসু



No comments:

Post a Comment