Saturday, October 19, 2019

দীপান্বিতায় মাতৃসাধক রামপ্রসাদঃ- হালিশহরে সাধনপীঠ


দীপান্বিতাপর্বঃ৫

 আগামী রবিবার অর্থাৎ ২৭শে অক্টোবর ২০১৯, দীপাবলী শ্যামাপূজায় মেতে উঠবে গোটা কলকাতা সহ বঙ্গ বঙ্গে এমন বহু কালীসাধকের আবির্ভাব ঘটেছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন শ্রীশ্রীঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, শ্রীশ্রীবামাদেব, মাতৃসাধক কমলাকান্ত এবং যিনি তাঁর ভক্তিগীতির মাধ্যমে মায়ের চরণ বন্দনা করেছিলেন, যার গানের ভক্তিরসে গোটা বঙ্গদেশ মেতে উঠেছিল মায়ের নাম তিনি হলেন সাধক রামপ্রসাদ সেন আজ বনেদীয়ানা' সেই মাতৃসাধকের সাধনপীঠ হাভেলিশহর বা কুমারহট্ট আবার বর্তমানে হালিশহরে সেই মন্দির সম্পর্কেই তথ্য পরিবেশিত হবে চলুন দেখা যাক সেই ইতিহাস  
দীপান্বিতায় মাতৃসাধক রামপ্রসাদঃ- হালিশহরে সাধনপীঠ 

হালিশহরের সাধক রামপ্রসাদ ছিলেন ভক্তিগীতি, বিশেষ করে শ্যামাসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ রূপকার, সাধককবিও বটে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার কুমারহট্টে কবিরাজ বংশে তাঁর জন্ম হয় পিতা রামরাম সেন ছিলেন ঔষধ ব্যবসায়ী ছোটোবেলাতে পাঠশালায় পড়াশুনা শেষ করে পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য তিনি সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন তাঁর আয়ুর্বেদ ব্যবসায় আগ্রহ ছিলই না, আগ্রহ ছিল শুধুমাত্র সাহিত্য এবং মাতৃসঙ্গীতের প্রতি পিতা রামরাম সেন তাঁর সাহিত্য-সঙ্গীতে অনুরাগ দেখে তাঁকে ফরাসী ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করেন মাত্র ১৬বছর বয়সে বাংলা, হিন্দি, ফরাসী, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষা শিখে ফেলেছিলেন  

এরপর রামপ্রসাদের আধ্যাত্মিক জীবনই তাঁর কাছে অধিকতর সুখী জীবন বলে মনে হওয়ায় পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁর সাথে সর্বাণীদেবীকে বিবাহ দেন, যখন তাঁর(রামপ্রসাদের) বয়স ২২বছর বিবাহের পর পারিবারিক প্রথানুযায়ী নবদম্পতি কুলগুরু মাধবাচার্যের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন কথিত আছে, দীক্ষাগ্রহণকালে গুরু তার কানে মন্ত্রপ্রদান করলে তিনি দেবী কালীর অনুরক্ত হয়ে পড়েন এক বছর পর তার গুরুর মৃত্যু হয় এরপর রামপ্রসাদ তান্ত্রিক যোগী এবং পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিলেন আগমবাগীশ রামপ্রসাদকে তন্ত্রসাধনা এবং কালীপুজোর শিক্ষা দান করেন 
প্রসঙ্গত সাধক রামপ্রসাদকে আমরা সাধক কবি বলেই বেশি চিনি কিন্তু তিনি মাতৃসাধনার পাশাপাশি বাংলা গানের নতুন ধারার সৃষ্টি করেছিলেন একথাও অস্বীকার করা যায় না তাঁর গানের ভক্তিরসের অভূতপূর্ব আবেদনে শ্মশানবাসিনী দেবী কালী প্রবেশ করলেন বাঙালির ঘরে ঘরে করালবদনা হয়ে উঠলেন আদরিনী শ্যামা তিনি শুধুমাত্র কালীসাধকই নন, তিনি এক সমাজসচেতক কবিও বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর উপার্যনের আশায় তিনি কলকাতায় এসেছিলেন দুর্গাচরণ মিত্রের কাছারিতে চাকুরি করতে আনুমানিক ১৭৩৯ সালে তিনি কাছারিতে যোগ দেন কাছারির কাজ বাদ দিয়ে তিনি ডুবে থাকতেন মায়ের গান লিখতে কাছারির খাতায় তিনি লিখেই ফেললেন-"আমায় দে মা তবিলদারি, আমি নিমকহারাম নই শঙ্করী" গোটা কাছারির খাতা হয়ে উঠল রামপ্রসাদী ভক্তিগীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সেই কথা বুঝতে দেরী হয়নি দুর্গাচরণের তিনি বুঝতেই পেরেছিলেন রামপ্রসাদ এক মহাসাধক 
তৎকালীন সময়ে হালিশহর ছিল সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের জমিদারির অন্তর্গত সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের জমিদাররাই তাঁকে(রামপ্রসাদকে) 'কবিরঞ্জন' উপাধি দিয়েছিলেন কারণ সেই রায় চৌধুরী পরিবারের কুলতিলক রামকৃষ্ণ রায় চৌধুরী ছিলেন সিদ্ধপুরুষ তিনি তৈরি করেছিলেন হালিশহরে সাধনপীঠ রামপ্রসাদ সেনের কবিত্ব সাধনা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হালিশহরের সাবর্ণ বংশীয় জমিদারগন সাধক রামপ্রসাদকে ১৭৫৪ থেকে ১৭৫৮ খ্রীঃ মধ্যে কৃষিযোগ্য জমি, বাস্তুভিটাসহ রামকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর সাধনপীঠ দান করেছিলেন সেই পঞ্চমূণ্ডির আসনে সাধনা করেই রামপ্রসাদ সেন সিদ্ধিলাভ করেন মায়ের দর্শন পান  রামপ্রসাদ সেনকে ১৭৫৪ সালের ২রা এপ্রিল সাবর্ণ বংশীয় দর্পনারায়ণ, শ্রীরাম কালীচরণ ৮বিঘা জমি দান করেছিলেন ১৭৫৮ সালের ১৫ই এপ্রিল রামকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ সুভদ্রাদেবী রামপ্রসাদকে বসবাস করার জন্য জমি সাধনার জন্য সিদ্ধপীঠ দান করেন এছাড়া নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ১৯৫৯ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি ৫১বিঘা জমি দান করেছিলেন রামপ্রসাদকে  রামকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর সেই সাধনপীঠ পঞ্চবটী আজও বর্তমান
এই পঞ্চবটীর সংলগ্ন স্থান রামপ্রসাদের তিরোধানের পর বহুবছর জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পরে থাকে পরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে স্থানটি সংস্কার করা হয় এবং তীর্থক্ষেত্রে তৈরী করা হয় সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের উল্লেখযোগ্য তন্ত্রসাধক রামকৃষ্ণ রায় চৌধুরীর সাধনপীঠ পঞ্চমূণ্ডির আসনের কথা রামপ্রসাদ সেন তাঁর "বিদ্যাসুন্দর" কাব্যে উল্লেখ করেছেন রামপ্রসাদ যে সময়ের সাধক সেই সময় নানা কারণেই ঘটনাবহুল ১৭৩৯-মহাপ্লাবন, ১৭৫২-এর বর্গীহানা, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ ইত্যাদি এমন সময়ে মানুষের সবথেকে বড় আশ্রয় রামপ্রসাদী গান
 রামপ্রসাদ কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও কথা বলেছিলেন রামমোহন রায় সতীদাহপ্রথা রদ করার আগেই রামপ্রসাদ সেন সতীদাহপ্রথার বিরুদ্ধে বলেছিলেন- 'নহে শাস্ত্রসমত্বা সমত্বা সহমৃতা' রামপ্রসাদের মৃত্যুর সময়কাল নিয়ে এক মতপার্থক্য আছে রামপ্রসাদ নাকি ১৭৮১ সালে কালীপুজোর পরদিন কালীমূর্তি নিয়েই গঙ্গাবক্ষে বিলীন হয়েছিলেন কিন্তু এই তথ্য সত্য নয় তাঁর দস্তখৎ থেকে প্রমাণিত হয় ১৭৯৪ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তিনি জীবিত ছিলেন তাঁর তিরোধান ঘটে ১৭৯৪ পরে ডঃ প্রমথনাথ মণ্ডলের গবেষনাতে এই তথ্য স্বীকৃত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর শতবর্ষপূর্তিতে হালিশহরবাসীর চেষ্টায় রামপ্রসাদের সাধনপীঠ পঞ্চমূণ্ডির আসন সংস্কার করা হয় ১৯৫৭ খ্রীঃ এই মন্দিরে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়
 তথ্যসূত্র লিপিবদ্ধেঃ- শ্রীমান শুভদীপ রায় চৌধুরী



No comments:

Post a Comment