ঐতিহ্যের
ইতিহাসপর্বঃ
আজ প্রকাশিত হল
২২৬বছরের প্রাচীন হুগলি জেলার ঘোষ
বাড়ির দুর্গাপূজার ইতিহাস। লিখলেন
বনেদীয়ানা পরিবারের সদস্য শ্রীমান্ শুভদীপ
রায় চৌধুরী। চলুন
দেখা যাক সেই প্রাচীন
ইতিহাসের কিছু অংশ।
আভিজাত্যে হুগলির ঘোষ বাড়িঃ-
২২৬ বছরের বনেদী দুর্গাপুজো
প্রাচীন
রীতিনীতি ও ঐতিহ্য মেনে
২২৬ বছরে পা দিল
হুগলি জেলার খানাকুল থানার
ঘোষবাড়ির পারিবারিক দুর্গাপূজা। ১২০১বঙ্গাব্দ
থেকে দীর্ঘ আটপুরুষ ধরে
ধারাবাহিক ভাবে চলে আসছে
এই পুজো। এই
পরিবারের দুর্গাপুজো শুরু করেন গোপীচরণ
ঘোষ। একচালার
মাতৃপ্রতিমার উচ্চতা প্রায় নয়
ফুট। দেবীর
বোধন হয় দুর্গাপুজোর মহানবমী
তিথির ঠিক আগের নবমীতে। অর্থাৎ
প্রায় ১৫দিন ধরে চলে
এই ঘোষ বাড়ির দেবীবন্দনা,
চলে চণ্ডীপাঠও। ঘোষ
বাড়ির কুলগুরু বংশপরম্পরায় এই পুজো করে
থাকেন। বর্তমানে
পুজো করেন কুলগুরু শ্রী
সমীর কুমার ভট্টাচার্য্য।
এই বাড়ির মৃন্ময়ী
কাত্যায়নীকে তৈরি করেন স্থানীয়
শিল্পীরাই। দেবী
এখানে একচালার ডাকের সাজের অনিন্দ্যসুন্দর
প্রতিমা। পুজোর
চারদিনই দেবী স্বর্ণালঙ্কারে সজ্জিতা
থাকেন। দুর্গাপুজোর
ষষ্ঠীর দিন বোধন হয়,
হয়ে থাকে আমন্ত্রণ ও
অধিবাস পর্ব। ষোড়শোপচারে
পুজো হয় ঘোষ বাড়িতে। ঘোষ
পরিবারে পশুবলিপ্রথাও সেই প্রাচীন কাল
থেকেই চলে আসছে।
এই পরিবারের আরও প্রাচীন কিছু
রীতির মধ্যে অন্যতম হল
ধুনোপোড়া অনুষ্ঠান এবং কুমারিপূজা।
সন্ধিপূজার সময় এই বাড়িতে
সম্পূর্ণ কালো রঙের পাঁঠাবলি
দেওয়া হয়।
এই বংশের আদিপুরুষ
গোঁপীচরণ ঘোষ ছিলেন অতন্ত
ধর্মপরায়ণ মানুষ। দেবদ্বিজে
ভক্তি তাঁর মনকে ক্রমেই
ব্যাকুল করে তুলেছিল।
আত্মীয়পরিজনের সাথে পরামর্শ করে
১২০০বঙ্গাব্দে নিজ বাড়িতে নারায়ণ
শিলা প্রতিষ্ঠা করলেন। তৈরি
হল শ্রীশ্রী শ্রীঁধর জীউের মন্দিরও।
এই মন্দির ইতিহাসের নীরব
সাক্ষী বলা যেতেই পারে। পার্থিব
সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য এবং বংশের
কল্যাণ কামনায় ঠিক পরের
বছর অর্থাৎ ১২০১ বঙ্গাব্দে
গোপীচরণ শুরু করলেন দুর্গাপুজো। একটি
ছোটো আটচালার মন্দির তৈরি করেই
সেখানে শুরু হল কাত্যায়নীর
আরাধনা। বাংলার
১৩১০ বঙ্গাব্দে মন্দির তৈরি হয়। মন্দির
সংলগ্ন আটচালাটিও সেই সময়ের তৈরি। দুর্গামন্দিরের
ঠিক দক্ষিণে দ্বিতল বিশিষ্ট শ্রীশ্রী
শ্রীঁধর জীউ-এর মন্দির। এই
মন্দিরে সিংহাসনে অধিষ্ঠান করছেন ঘোষ বাড়ির
শ্রীঁধর জীউ। ইনি
বংশের গৃহদেবতা। নিত্য
সেবাপূজা হয় এখানে।
এই শ্রীঁধরের সঙ্গে আছেন লক্ষ্মী,
মনসা এবং মঙ্গলচণ্ডীর ঘট। এই
মন্দিরের ঠিক উত্তর দিকে
রয়েছেন শীতলা দেবীর মন্দির। এখানে
মা শীতলা দেবীর ঘটেই
পূজা হয়। এই
তিনটি মন্দিরের চৌহদ্দি প্রায় ৫বিঘা।
প্রতিষ্ঠিত পুকুরের আয়তন প্রায় ১০বিঘা। বর্তমানে
এর আয় পূজায় কিছুটা
সাহায্য প্রদানও করে।
অতীতে
বর্ধমানের মহারাজার দান করা জমির
উপসত্ত্ব থেকেই পুজোর ব্যয়ভার
নির্বাহ হত। এখন
বহু জমি অধিগ্রহণ হওয়ায়
আয় কমে গেছে।
পূর্বের আড়ম্বর বজায় না
থাকলেও নিষ্ঠা দিয়ে এখনও
এই পুজো করে আসছেন
ঘোষ পরিবারের সদস্যরা। প্রীতির
বন্ধন এখনও অটুট।
আগে যখন ঘড়ির
ব্যবহার এত জনপ্রিয় ছিল
না তখন এখানে সন্ধিপূজার
কাজ নির্দিষ্ট সময়ে আরাম্ভ এবং
শেষ করবার জন্য একটি
বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করা
হত। একটি
ছোটো ছিদ্রযুক্ত তাম্রপাত্র অন্য একটি জলপূর্ণ
পাত্রে ভাসিয়ে সময়ের অঙ্গ
নির্ধারণ করা হত।
ওই পাত্রটি কতবার ডুবলে পূজার
কাজ আরাম্ভ হবে তা
গাণিতিক নিয়মে বের করা
হত। সন্ধিপূজা
রাত্রিবেলা হলে ঠিক সূর্যাস্তের
সময় আর সন্ধিপূজা দিনের
বেলা হলে ঠিক সূর্যোদয়ের
সময় তাঁবু ভাসান হত। সেই
ধারা এখনও চলে আসছে। ওই
তামার বাটি বর্ধমান মহারাজার
দান। বর্ধমান
মহারাজার দুর্গাপুজোর অনুকরণে এটি প্রচলিত।
এই তাঁবু ভাসানোর দায়িত্বে
থাকেন আচার্য্য। এই
বাটি একবার ডুবতে সময়
লাগে ২৪মিনিট ২৪সেকেন্ড। এই
জলঘড়ির বাঁধা সময় অনুযায়ী
এটিকে ইংরাজি ঘন্টা ও
মিনিটে পরিবর্তন করে বর্তমান ঘড়ির
সঙ্গে মিলিয়ে সন্ধিপূজার কাজ
করা হয়।
নবমীর দিন ধুনোপোড়া
হয় এই বাড়িতে, হয়
হোমও। এই
ঘোষ বাড়িতে দশমীর দিন
সকালে কুমারিপূজা হয়। এদিন
দুর্গাপুজোর মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের শেষপর্ব। এই
দিন বাড়ির মহিলারা সিঁদুরখেলায়
মেতে ওঠেন। সন্ধ্যায়
মন্দির সংলগ্ন পুকুরে দেবী
বিসর্জন হয়। এখনও
ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতায় অটুট
এই ঘোষ বাড়ির দুর্গাপুজো।
কিভাবে
যাবেনঃ- বলপাই গ্রামে আসতে
হলে হাওড়া হয়ে কিংবা
তারকেশ্বর খানাকুল হয়ে এখানে আসা
যাবে। কলকাতা
থেকে দূরত্ব কমবেশী ৫৫কিলোমিটার। প্রাইভেট
গাড়ীতে এলে ২ঘন্টার মধ্যে
আসা যায় এই গ্রামের
ঠাকুরদালানে।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ-
শ্রী স্বপন কুমার ঘোষ
তথ্যলিপিবদ্ধেঃ-
শ্রীমান শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment