ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ
আজ প্রকাশিত হল দক্ষিণ কলকাতার বেহালা অঞ্চলের রায় বাড়ির দুর্গাপুজোর ইতিহাস। লিখলেন বনেদীয়ানা পরিবারের সদস্যা শ্রীমতী দেবযানী বসু। চলুন দেখা যাক সেই বাড়ির ইতিহাস।
আভিজাত্যে ও ঐতিহ্যে রায় বাড়িঃ- বেহালা
অষ্টাদশ শতকের সময়কাল ভারতের ইতিহাস, দিল্লির মসনদে আসীন মোঘল সম্রাট। এই মোগল সাম্রাজ্যের বাংলা অঞ্চলের রাজধানী ছিল আদি সপ্তগ্রাম। রাজধানীর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন গজেন্দ্রনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। তিনি তাঁর সততা ও কাজের প্রতি নিষ্ঠার জন্য সম্রাটের কাছ থেকে রায়চৌধুরী উপাধিতে ভূষিত হন। পরে রাজধানী পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গজেন্দ্রনারায়ণ প্রথমে হালিশহর ও পরে উত্তর ২৪ পরগনার আড়িয়াদহ নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এখানেই তিনি দুর্গাপুজো ও অন্নপূর্ণা পুজোর প্রচলন করেন। এরপর ১৭৪২ সালে ভারত বর্গি আক্রমণের সম্মুখীন হয়। দেখা যায়, প্রবল রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই সময় রায় পরিবারের একটি শাখা পুরানো বাসভূমি ছেড়ে বেহালা অঞ্চলে পাকাপাকি ভাবে বাস করতে থাকেন। এখানেই ১৭৫৬ সালে তারা মাতৃপূজার আয়োজন করেন যা আজ ২৬৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে ধুমধামের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই বংশেরই কৃতি পুরুষ অম্বিকাচরণ রায় ছিলেন ব্রিটিশ হাইকোর্টের বিচারপতি। আইনবিদ্যায় তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ও পাণ্ডিত্যের কারণে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে 'রায় বাহাদুর' খেতাব পান। বেহালার বিস্তৃত অঞ্চলে পারিবারিক খ্যাতি, প্রতিপত্তি ও সম্মান বাড়িয়েছিলেন বহুল পরিমানে। বেহালায় তাঁর নামাঙ্কিত রাস্তা আজও তাঁর সই সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সেই সঙ্গে পারিবারিক পুজোগুলির আড়ম্বর ও মাহাত্ম্য বৃদ্ধি পায় তাঁর সময়ে। তিনি সম্পত্তির একটি অংশ বাৎসরিক দুর্গাপুজোর জন্য দেবোত্তর করেছিলেন। তাঁর উত্তরসুরিরা পুজোর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন পুরানো প্রথানুযায়ী। তবে তিন চারটি শাখায় বিভক্ত পরিবারের মধ্যে পালা করে পুজো চলে। এছাড়া ৪/১ রায় বাহাদুর রোডের বাড়ির সদস্যরা প্রতিবছরই নিষ্ঠার সাথে ঐতিহ্যকে নিয়ে পুজো করেন দেবী দশভুজার।
অর্ধবৃত্তাকার চালচিত্রের ওপর সেকেলে ধাঁচে দেবী মূর্তি তৈরি হয়। অপরূপ মাতৃঅঙ্গে ঝকঝক করে জরির সাজ। এখানেও দেবীর বাহন সিংহ ঘোড়ার আদলে। পিছনের চালচিত্রে পটচিত্রের মাধ্যমে শিবপুরাণ অঙ্কিত। অতীতের সব নিয়মকানুন মেনে তন্ত্রমতে পুজো হয় এই বাড়িতে। মহালয়া থেকে শুরু হয় চণ্ডীপাঠ। ষষ্ঠীর অধিবাসের পর দুর্গাঘট স্থাপন, দেবীর চক্ষুদান ও প্রাণপ্রতিষ্ঠা। পুজোর তিনদিনই দুইবার করে ভোগ হয় মায়ের। খিচুড়ি ভোগ ও অন্নভোগ। সঙ্গে থাকে আমিষ পদ। সন্ধিপুজোয় সাজানো হয় একটি বিশেষ নৈবেদ্য। একটি প্রকাণ্ড বারকোষে ২৮টি ডাব। চাল, ডাল, মশলা, পান, ছানা, দই, ক্ষীর, বাড়ির তৈরি মিষ্টান্ন। এ বাড়িরও নিয়ম দেবীকে দশমীর দিন পান্তাভাত, কচুর শাক, তেঁতুল গুড় দিয়ে ইলিশের অম্বল খাইয়ে বিদায় দেওয়া। পূর্বে বলিদান হলেও এখন শুধু শশা, চালকুমড়ো, আখ ইত্যাদি বলি হয়। সন্ধ্যায় দেবীবরণের পর কাঁধে করে প্রতিমা নিয়ে বিসর্জন দেওয়া হয় নিজস্ব পুকুরে। শরিকি পুজো হলেও আভিজাত্য এবং বনেদীয়ানায় বেহালার রায় পরিবারের কোন ত্রুটি নেই।
তথ্যসূত্রঃ- শ্রীমতী দেবযানী বসু(সাংবাদিক)
No comments:
Post a Comment