ভারতের
স্বাধীনতাঃ-
"এই বাংলার মাটিতে
মাগো জন্ম আমায় দিও।
এই আকাশ নদী
পাহাড়, আমার বড় প্রিয়।।"
আজ স্বাধীনতা দিবস, ১৯৪৭ সালের
১৫ই আগস্ট ভারতের যে
পরাধীনতার বাঁধনছাড়া রূপ ফুটে উঠেছিল
আজ তা বহুবছর অতিক্রান্ত। ভারতবর্ষ
আজ স্বাধীন, কিন্তু এই স্বাধীনতা
যাঁদের জন্য আমরা পেলাম
তাঁদের শ্রীচরণে আজ শুধু নয়
প্রতিটি দিনই প্রণাম জানানো
উচিত। তাই
আজকের এই শুভদিনে বনেদীয়ানা
সম্মান জানাবে দুই মহীয়সী
নারীকে। যাঁদের
অবদান ভারতের স্বাধীনতায় অপরিসীম। যাঁদের
দেশের প্রতি ভালোবাসা, আজ
আমাদের নতুন সূর্য দেখতে
সাহায্য করেছে। আজ
সেই দুই মহিলা বিপ্লবীর
জীবনের সংক্ষিপ্ত ঘটনা আলোচনার মাধ্যমে
বনেদীয়ানা সম্মান জানাবে ভারতমাতার
চরণে। প্রনাম
জানাবে সমস্ত বিপ্লবীদের যাঁদের
জন্য আজ ভারতবর্ষ স্বাধীন। চলুন
দেখা যাক সেই বিপ্লবীবর্গের
সংক্ষিপ্ত কিছু তথ্য।লিখলেন বনেদীয়ানা পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
ভারতের
অহংকারঃ- বিপ্লবী শাঁন্তি ঘোষ এবং বিপ্লবী
সুঁনীতি চৌধুরী
শান্তিঘোষ,
জন্ম-১৯১৬সালের ২২শে নভেম্বর।
পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ, ছিলেন কুমিল্লা
কলেজের অধ্যাপক এবং মাতা সলিলাবালা
ঘোষ। তিনি
অবিভক্ত বঙ্গদেশের এক অন্যতম বিপ্লবী
ছিলেন। ছোটো
থেকেই বেড়ে উঠেছিলেন বৈপ্লবিক
পরিবেশের মধ্য দিয়ে, তাই
তাঁর রক্তে ছিল এক
অগ্নি তেজ। বিদ্যালয়ে
পড়াশুনা করতে করতেই তিনি
জড়িয়ে পরলেন ব্রিটিশ বিরোধী
সশস্ত্র সংগ্রামে। গান্ধীজীর
ডাকে সারা ভারতবর্ষ জুড়ে
আইন অমান্য আন্দোলনের সময়
কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা গার্লস স্কুলের প্রফুল্লনন্দিনী
ব্রহ্মের সংস্পর্শে এসে "যুগান্তর" দলে যোগদান করেন। শান্তি
ঘোষ এবং সুনীতি চৌধুরী
ছিলেন দুই সহপাঠী।
এই দুই জনই ছাত্রী
ছিলেন সেই ফয়জুন্নেসা বালিকা
বিদ্যালয়ের। দুইজনেই
ছিলেন কিশোরী। এদের
পথিকৃৎ ছিলেন- স্বর্ণকুমারী দেবী,
সরলা দেবী, আশালতা সেন,
সরোজিনী নাইডু, ননী বালা
দেবী, ইন্দুমতী দেবী, সাবিত্রী দেবী
ছাড়াও আরও অনেকে।
সাল ১৯৩১, প্রায়
৮৮বছর অতিক্রান্ত। দুই
সহপাঠীই তখন ছাত্রী, বয়স
তাঁদের মাত্র ১৪বছর।
বিদ্যালয়ে তাঁরা তৈরি করেন
"ছাত্রীসংঘ"। সুনীতি
চৌধুরী তার অধিনায়কত্ব।
এই ছাত্রীসংঘ থেকেই সুনীতি চৌধুরী
এবং শান্তি ঘোষ শিখেছিলেন
লাঠি চালানো, ছোরা চালানো ইত্যাদি
নানা রকমের বিদ্যা।
সবথেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা
স্টিভেন্সকে গুলি করে হত্যা
করার দায়িত্বটি পড়েছিল তাঁদের ওপর। সেই
দিন ১৪ই ডিসেম্বর, ১৯৩১
সাল। সময়
সকাল ১০টা। স্বাভাবিক
ভাবেই শহরের সমস্ত কাজ
চলছিল। এইদিকে
দুইজনই তেজস্বিনী বিপ্লবী। শান্তি
এবং সুনীতির বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হয়ে ১২ই
ডিসেম্বর। বিদ্যালয়ে
অনুষ্ঠান আছে বলে বাড়ি
থেকে বেড়িয়ে পরেছিল তাঁরা। তাদের
ছিল চাদর জড়িয়ে ছদ্মবেশ,
সেই চাদরের তলায় রাখা
ছিল জন স্টিভেন্সকে হত্যা
করবার সেই রিভলবার।
শাঁন্তি ঘোষের কাছে ছিল
.৪৫ ক্যালিবারের রিভলবার এবং সুঁনীতির কাছে
.২২ ক্যালিবারের। স্টিভেন্সের
বাংলোতে ঢোকার কৌশল একটাই
তা হল- কুমিল্লার সাঁতার
প্রদর্শনীর অনুমতিপত্র। তাঁরা
তাই বিনা বাঁধায় প্রবেশ
করেছিল সেখানে।
বলাবাহুল্য যে সেই সময়
দেশে ঘটে চলেছে বিভিন্ন
তরুণ-তরুণীর বৈপ্লবিক কার্যকলাপ। সরকারি
পদাধিকারী ইংরেজদের ওপর হানা আবার
কখনও তাদের হত্যার পরিকল্পনা-
এ ঘটনা লেগেই ছিল। শান্তি
ঘোষ এবং সুনীতি চৌধুরী
বললেন- "আমরাই বা থেকে
থাকবো কেন?" সেই জন্য তাঁরা
সেই সুযোগে হত্যা করল
কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জন
স্টিভেন্সকে, যাতে ব্রিটিশ সরকারের
ওপর চরম
আঘাত হানা যায়।
তাঁরা সেই পরিকল্পনায় সফলও
হয়েছিলেন। কারণ
তাঁরা অনুমতিপত্র চাইতে গেলে তাঁদেরকে
ম্যাজিস্ট্রেটের অতিথি কক্ষে নিয়ে
যাওয়া হয়। তখন
জন স্টিভেন্সকে প্রোগ্রামের ব্যাপারে কথা বলতে বলে
তাকে বিষয়টি পড়তে দেয়। যখন
জন স্টিভেন্সের নজর সেই পত্রে,
তখন শান্তি ঘোষ এবং
সুনীতি চৌধুরী রিভলবার বার
করে তাকে গুলি করেন। সুনীতির
প্রথম গুলিই স্টিভেন্সের মাথায়
বিদ্ধ করে। সাথে
সাথে তার শরীরে শান্তি
ঘোষ গুলি করে। তখন
তাঁদেরকে গ্রেফতার করা হয় এবং
হত্যা মামলা করা হলেও
তাঁদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকায়
তাদের বেশী দিন জেলে
থাকতে হয়নি । সারা
দেশে ছড়িয়ে পরে শান্তি
এবং সুনীতির নাম।
শান্তি
ঘোষ এবং সুনীতি চৌধুরীকে
গ্রেফতার করে শারীরিক নির্যাতন
এবং যৌন হয়রানি করা
হয়। কী
অমানবিক! এমনই ছিল ব্রিটিশ
সাম্রাজ্য, যেখানে ভারতীয়রা বন্দী
ছিল, বন্দী ছিল ভারতমাতা। তাই
সেই সময় শান্তি ঘোষ
এবং সুনীতি চৌধুরী এই
উদ্দ্যোগকে বলাই যায়-
""কারার
ঐ লৌহ কপাট, ভেঙে
ফেল কররে লোপাট....."
সাত বছর জেল
খাটার পর শান্তি ও
সুনীতি, ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশদের
সাথে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তি পান।
বাংলার অহংকার তাঁরা।
তারপর শান্তি ঘোষ কলকাতার
বেঙ্গলী উইমেন্স কলেজে পড়াশুনা করেন
ও বাম রাজনীতিত জড়িয়ে
পরেন। পরে
কংগ্রেসে যোগদান করেন।
১৯৫২-৬২ ও ১৯৬৭-৬৮, তিনি পশ্চিমবঙ্গ
রাজ্যসভার সদস্য এবং ১৯৬৩-৬৪ বিধানসভার সদস্য
ছিলেন। ১৯৪২
সালে প্রফেসর চিত্তরঞ্জন দাসকে বিবাহ করেন। ১৯৮৯
সালে ৭৩ বছর রয়সে
পরলোকগমন করেন তিনি।
সুনীতি চৌধুরী লেখাপড়াকেই অবলম্বন
করেছিলেন। কলকাতায়
গিয়ে এমবিবিএস করে গরীব দুঃখীদের
বিনামূল্য চিকিৎসা করেন, যেটির মধ্যেও
দেশপ্রেম ছিল। ১৯৪৭
সালে ট্রেড ইউনিয়নের নেতা
প্রদ্যোৎ ঘোষকে বিবাহ করেন। ১৯৯৪
সালে ৭৭ বছর বয়সে
পরলোকগমন করেন।
উল্লেখ্য ১৯৩১ সালের মে
মাসে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র
বসু ত্রিপুরায় "Tripura
Students Conference" এর
প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন। সেখানে
তিনি শান্তি ঘোষ, সুনীতি
চৌধুরী এবং অন্যান্য মেয়েদের
সাথে নিয়ে বলেন-
-আমরা
মেয়েরা সরাসরি বিপ্লবী আন্দোলনে
অংশগ্রহণ করতে চাই।
আপনার মতামত?
- আমি
মেয়েদের সামনের সারিতে দেখতে
চাই।
নেতাজী
সুভাষ চন্দ্র বসু তখন
তাঁদের লিখে দেন-
"তোমাদের
সম্মান রক্ষার্থে তোমরা হাতে অস্ত্র
তুলে নাও। হে
মা।"
আজ এই স্বাধীনতার দিনে
"বনেদীর-বনেদীয়ানা", পরিবার স্মরণ করল
সেই দুই মহান মহীয়সী
নারীকে। যাঁদের
অবদান ভারতের স্বাধীনতায় অপরিসীম। আমরা
আজকের দিনে একটা কথাই
বলতে পারি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের
ভাষায়-
"সঙ্কোচের
বিহ্বলতা নিজের অপমান,
সঙ্কটের কল্পনাতে হয়ো না ম্রিয়মাণ।
মুক্ত
করো ভয়, আপনা মাঝে
শক্তি ধরো, নিজেরে করো
জয়।..."
তথ্যসূত্র
সংগ্রহেঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment