ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ
আজ
প্রকাশিত হল ঝিখিরা ভট্টাচার্য্য বাটীর দুর্গাপুজোর ইতিহাস। লিপিবদ্ধ করলেন বনেদীয়ানা পরিবারের সদস্য শ্রীমান শুভদীপ রায় চৌধুরী। চলুন দেখা যাক সেই বাড়ির ইতিহাস।
আভিজাত্যে ভট্টাচার্য্য বাটীঃ- ঝিখিরা
সময় আনুমানিক ১৪৯৩ সাল। বাংলার সুলতান হুসেন শাহের পর সিংহাসনে বসেছেন নসরৎ শাহ। সমগ্র বাংলায় চলছে মুসলমান শাসন। সুলতানের দুর্বলতার সুযোগে বাংলায় চলছে সাম্প্রদায়িকতার অরাজকতা। যার প্রতিবাদে মুখর শ্রীশ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু। এইসময়ে পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে হাজারে হাজারে অত্যাচারিত শরণার্থীরা চলে আসছেন এপার বাংলায়। এদেরই সঙ্গে এপার বাংলায় চলে এলেন ঢাকার বিক্রমপুর নিবাসী এক ব্রাহ্মণ সন্তান বীরেশ্বর ভট্টাচার্য্য। বর্ধমানের মহারাজা তেজচাঁদ বাহাদুর তাঁকে তেত্রিশ বিঘা ভূমি দান করেন। তাতেই পণ্ডিত বীরেশ্বর ছোটো কুটীর নির্মাণ করে বর্তমান ভট্টাচার্য্য বংশের গোড়াপত্তন করেন। কৃষিকার্য ও পৌরহিত্যের সমন্বয়ে জীবিকানির্বাহ করতেন। বীরেশ্বরের তিন সুযোগ্য পৌত্রের মধ্যে মধ্যম পৌত্র রামশম্ভুই ইং ১৮১৩ সাল নতুন বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। তাঁর পুত্র সীতারামকে বর্ধমানের রাজা দেওয়ান পদে নিযুক্ত করেন। ব্রিটিশ শাসনকালে সীতারাম হ্যারিসন রোড (বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোড) নির্মাণের আংশিক দায়িত্ব পান। এই নির্মাণ কার্যের লভ্যাংশেই তিনি কোঠা বাড়ি, মা দুর্গার মন্দির, দামোদর জীউয়ের মন্দির এবং পিতা রামশম্ভু ও মাতা চাঁপাবতীর নামে জোড়া শিবমন্দির নির্মাণ করেন, যা আজও সযত্নে চির ভাস্বর হয়ে আছে। রামশম্ভুর কনিষ্ঠ সন্তান পণ্ডিত ও মাতৃসাধক দুর্গাপ্রসাদ চূড়ামণি পঞ্চমূণ্ডির আসন নির্মাণ করে ঝিখিরা বারোয়ারি কালী পুজোর প্রচলন করেছিলেন। বর্তমান খাঁ পুকুরের পাশে তাঁর সংস্কৃত শিক্ষার টোল ছিল।
রামশম্ভুর প্রথম সন্তান দানবীর অম্বিকা তুলোট দান করেছিলেন। অম্বিকার ভাই কেনারাম ও খুড়তুতা ভাই সারদাচরণ গ্রামে ইংরাজী শিক্ষার প্রবর্তন করেন। অম্বিকার পুত্র শ্রীশ ও পৌত্র শ্রীপতি কলকাতার ওরিএন্টাল সেমিনারীর শিক্ষক ছিলেন, যেখানে পড়াশুনা করতেন রবীন্দ্রনাথ। সীতারামের পৌত্র ডঃ সত্যচরণ বংশের তথা গ্রামের প্রথম
F.R.C.S চিকিৎসক ছিলেন। সাধক দুর্গাপ্রসাদ চূড়ামণির জ্যেষ্ঠপুত্র দেশহিতৈষী ডঃ বরদাচরণ ঝিখিরা উচ্চ বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। দুর্গাপ্রসাদের কনিষ্ঠপুত্র পণ্ডিত দক্ষিণাচরণ স্মৃতিতীর্থ বঙ্গীয় পণ্ডিত মহামণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন। কলকাতার সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। এই দক্ষিণাচরন স্মৃতিতীর্থ ঝিখিরা হরিভক্তি সভা প্রতিষ্ঠা করেন ১২৮৬ সালে, যা আজও তাঁর কর্মপ্রক্রিয়া সম্পাদন করে চলেছেন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। দক্ষিণাচরণের পুত্র শ্যামাচরন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজীতে M.A. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে স্বর্নপদক লাভ করেন। তিনি অমৃতবাজার পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন। সীতারামের পৌত্র শীতল চন্দ্র স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন।
এই
ভট্টাচার্য্য বংশের বরেণ্য সন্তান, স্থিতধী প্রাজ্ঞ, শ্রী কার্তিকচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, যিনি প্রখর উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন, ভট্টাচার্য্য বাটীর অভিভাবক ছিলেন এবং পুজোর সমস্ত কাজ তিনি নিজে দাঁড়িয়ে পরিচালনা করতেন। সুদীর্ঘ কাল তিনি বাটীর অভিভাবকত্ব করে গেছেন। বাটীর নানাবিধ সংস্কারের কাজ তাঁর সময় থেকেই শুরুহয়। তাঁর কাজের বাস্তব রূপায়ণ তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে এগিয়ে এসেছেন তাঁর সুযোগ্যপুত্র কান্তি ভট্টাচার্য্য, ভাতুষ্পুত্র মাণিক ভট্টাচার্য্য, সমীর ভট্টাচার্য্য, পৌত্র সুব্রত ভট্টাচার্য্য এছাড়া আরও অনেকে। শিশু সাহিত্যিক সুকুমার ভট্টাচার্য্যও এই বংশেরই সন্তান ছিলেন। ডঃ ললিত মোহন, প্রখ্যাত শল্য চিকিৎসক ডঃ নিমাই ভট্টাচার্য্য, শিশু বিশেষজ্ঞ ডঃ তাপস ভট্টাচার্য্য এর মতন বিখ্যাত মানুষ এই বংশেরই বংশধর। ১৯৩৩ সালে দুর্গাপ্রসাদের পৌত্র গোবিন্দ চন্দ্র বাটীতে প্রথম শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রার সূচনা করেন। দামোদর জীউ কখনও বাটীর বাহির হন না। শ্রীশ্রী দুর্গামাতা ঠাকুরানীর জমি দেখাশুনা করতেন গোবিন্দ চন্দ্র ও শান্তিময় ভট্টাচার্য্য। মাতৃপূজায় পূজক দুর্গাপ্রসাদকে সাহায্য করতেন তন্ত্রধারক দক্ষিণাচরণ। বাড়ির বিভিন্ন সদস্যরা দেবীপুজোয় বিভিন্ন দায়িত্ব নিতেন। নিষ্ঠার সাথে ঐতিহ্যকে নিয়ে এই বাড়িতে পুজো হয় দেবীর।
এই বাটীতে একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। প্রকাশি হয় বাটীর বাৎসরিক ক্যালেন্ডার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করে এই পরিবার। কালিকাপুরাণ পদ্ধতিতে, সামবেদীয় মতে মাতৃপূজা হয়্ এটি সকাম পূজা। প্রতিমার বিশেষ বৈশিষ্ট্য কার্তিক ও গনেশের বিপরীত অবস্থান। এই ব্যাপারে ঢাকার প্রতিমাগুলির সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। এর ব্যাখ্যা হল- শাস্ত্রে আছে জ্ঞানাৎ সিদ্ধি। অর্থাৎ কোন বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান না হলে সিদ্ধি হয় না। সুতরাং জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর পাশেই সিদ্ধিদাতা গনেশের অবস্থান। আবার ধনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী লক্ষ্মীর পাশে রাখা হয়েছে কার্তিককে, ধন রক্ষার জন্য। পূজার ব্যয় নির্বাহ হয় শ্রীশ্রীদুর্গামাতা ঠাকুরানীর জমি থেকে আয়, পুকুর থেকে আয় আর বাকি অংশ বংশের সন্তানদের থেকে।
জন্মাষ্টমীর "মাটি তোলা" অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পুজো। এরপর মূর্তি তৈরি হলে পঞ্চমীতে রঙ ও ষষ্ঠীর সকালে মালাকার এসে শোলার সাজে মাকে সাজিয়ে দিয়ে যান। ষষ্ঠীর দিন দেবীর বোধন, অধিবাস ও আমন্ত্রণ পর্ব হয়। পূজার প্রতিষ্ঠাতা রামশম্ভুর নামেই সংকল্প হয়। সপ্তমীর সকালে তিথি অনুযায়ী নবপত্রিকা স্থান হয়। এরপর ঘট স্থাপন, চালের নৈবেদ্য সহকারে ষোড়শোপচারে দেবীর পুজো হয়। সপ্তমী থেকে মহানবমী পর্যন্ত প্রতিদিনই পাঁচ ভাজা, অড়হর ডাল, খিচুড়ি ভোগ হয়।
এছাড়াও ভোগে থাকে ভাত, ঘি, আলুসেদ্ধ, শাখ, ডাল, পাঁচ ভাজা, মোচার ঘন্ট, চালকুমড়োর ঘন্ট, ফুলকপির তরকারি, এঁচড়ের তরকারি, পোনা মাছের ঝাল, ইলিশমাছের চাটনী, পায়েস, পুলিপিঠে, ভাজাপিঠে ইত্যাদিও থাকে। নবমীর ভোগে থাকে মাংসও। সন্ধ্যার ভোগে থাকে লুচি, নারকেল সন্দেশ, তরকারি ইত্যাদি।
বাড়ির দীক্ষিত মহিলারাও ভোগরান্না করে থাকেন। মহাষষ্ঠীর সকালে দেবীর ষোড়শোপচারে পুজো হয়, হয় আরতি, চৌষট্টি যোগিনীর পুজো। সন্ধিপুজোয় রক্ত রঙ্গনের (নয়/এগারো/তেরো হাত) মালাদান করা হয়, ১০৮দীপদান হয়। মহানবমীতে একটি মাত্র ছাগ, আখ, একটি চালকুমড়ো ইত্যাদি বলিদান করা হয়। কুমারি পূজা ও ধুনোপোড়ানোর রীতিও আছে এই পরিবারে।
দশমীর দিন সকালে ষোড়শোপচারে পুজো, আরতি, ভোগ নিবেদনের পর শুরু হয় দেবীবরণ। সন্ধ্যায় মায়ের নিরঞ্জন হয় পার্শবর্তী পুকুরে। আবার একটি বছরের অপেক্ষা। এইভাবে আজও পুজো হয়ে আসে ভট্টাচার্য্য পরিবারে।
ঠিকানাঃ- ঝিকিরা, জয়পুর, হাওড়া-৭১১৪০১
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- ডঃ সুব্রত ভট্টাচার্য্য
তথ্যসুত্র লিপিবদ্ধেঃ- শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment