ঐতিহ্যের কালনাঃ-
আজ প্রকাশিত হল কালনার ঐতিহ্যবাহী মা মহিষমর্দিনী পুজোর ইতিহাস। বনেদীয়ানা পরিবারের নতুন সদস্য শ্রীমান্ অমিক চট্টোপাধ্যায় লিখলেন সেই ইতিহাস। বনেদীয়ানা পরিবার সেই ইতিহাসই তুলে ধরল। চলুন দেখা যাক সেই প্রাচীন ইতিহাস।
প্রাচীনত্বে মহিষমর্দিনীঃ- ঐতিহ্যে এবং আভিজাত্যে
ভাগীরথী নদীর তীরে গড়ে ওঠে অম্বুয়া নগরী যা কালনার প্রাচীন নাম.....অম্বু ঋষির নাম অনুসারে এর নাম দেওয়া হয়.....নবদ্বীপের
সংলগ্ন হওয়ায় বহু প্রাচীন কাল থেকে শাক্ত ও বৈষ্ণব ভাবধারার চর্চাক্ষেত্র গড়ে ওঠে।এছাড়া সেসময় অম্বুয়া নগরীতে পণ্ডিত দের টোলের সাথে সাথেই গড়ে ওঠে ব্যাবসা-বানিজ্য কেন্দ্র ভাগীরথী কে কেন্দ্র করে।১৭৬৪-৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ব্যাবসা-বানিজ্যের সমৃদ্ধ ক্ষেত্র হিসেবে এই স্থানের নাম হয় নয়াগঞ্জ,সেই সমময় নয়াগঞ্জে বানিজ্য করতে আসেন ঈশ্বরীপ্রসাদ পালচৌধুরী নামে একজন ব্যাবসায়ী.....তিনি সৎ ধার্মিক ও দেবীভক্ত ছিলেন.....তিনি ভাগীরথীর তীরে বাস করতে শুরু করেন.....এভাবে কেটে যায়
বেশ কিছু দিন..... এরপর একদিন রাত্রে তিনি স্বপ্নাদেশ পান যে দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া তাকে আদেশ দিচ্ছেন যে তিনি (বর্তমান রানাঘাটের) পালচৌধুরী বাড়িতে পুজিতা কিন্তু সেখানে অনাচারের কারনে তিনি সেই স্থান ত্যাগ করে নয়াগঞ্জের দিকে আসছেন পুজো নিতে।
এর
স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পরের দিন ঈশ্বরীপ্রসাদ পালচৌধুরী মমহাশয় ভোরে যখন গঙ্গাস্নান করে উঠে আসছেন তখনি তিনি দেখেন মায়ের পাটা ভেসে এসে পাড়ে আটকে রয়েছে।তিনি তা তুলে নিয়ে আসেন এবং আসে পাশের সব ব্যাবসাদার দের জানান নবদ্বীপ থেকে পণ্ডিতেরা আসেন এবং হোগলা পাতা ছেয়ে চালা ঘর করে দেবীর পুজো হয়।প্রথমে বেশ কিছু বছর পুজো হয় দুর্গাপূজার সময়.....,কিন্তু পরবর্তি কালে তা সময় পরিবর্তন করে শ্রাবণী পূর্নিমা কেই দেবী পুজোর উপযুক্ত সময় হিসেবে টোলের
পণ্ডিতেরা ঠিক করেন কারন বর্ষা কালে ব্যাবসায়ী দের ব্যাবসায় প্রচুর মন্দা দেখা দেয় তাই তারা এই পণ্ডিতদের বিধান হিসাব এই সময় কেই মহামায়ার আরাধনার সময় হিসেবে বেছে নেয়।
বর্ধমানের মহারাজা তার রাজকোষ থেকে প্রচুর পরিমানের অর্থ দিয়ে দেবীর মন্ডপ ও নহবৎখানা বানিয়ে দেন এবং দেবীর নামে সংলগ্ন ভাগীরথী ঘাট বাধিয়ে দেন ও বেশ অনেক জমি ওজায়গা লিখে দেন।ব্যাবসায়ীরাও তাদের প্রাপ্ত লভ্যাংশ এর কিছু অংশ দেবীপুজোয় দান করেন।দেবী পুজোর মহিমা ছড়িয়ে পড়তে থাকে.....
একদিন রাত্রে এক ব্যাবসায়ী মন্দির সংলগ্ন একটি জায়গায় ঘুমাচ্ছিলেন হঠাৎ তিনি দেখেন এক অপূর্ব সুন্দরী দেবীমূর্তি কমুন্ডলু হাতে মন্দির থেকে বেড়িয়ে গঙ্গাস্নান করে মন্দিরে এসে মিলিয়ে গেলেন.....দেবী খুবই জাগ্রত যে যেমন মানত করেন দেবী তা পূরন করেন..... কোনো কোনোবার দেবীর পূজা তিথিভেদে শ্রাবণী শুক্লা সপ্তমী থেকেও হয়.....দেবীপুজো হয় তন্ত্রক্তো মতে..... দেবী দশভুজা মহিষাসুরমর্দীনী কিন্তু দুপাশে থাকেন জয়া আর বিজয়া,যে তিথিতেই পুজো হোক প্রচলিত কথায় প্রথমদিনকে সপ্তমী দ্বিতীয় দিনকে অষ্টমী এভাবেই বলা হয়.....প্রতিদিন বহুভক্ত ভোর রাত থেকে পুজো দেওয়ার জন্য লাইন দেয় এছাড়া পাশাপাশি প্রতিদিন চলে দণ্ডী কাটা লাইন দিয়ে।নবমীর দিন এসবের পাশে চলে বলিদান ধুনোপোড়ানো
কয়েশো পাঠাবলী হয় নবমী তে।দেবী কয়েকশো কেজি
সোনার গয়না আছে.....এছাড়া রূপোর
গয়না হিরে সব আছে
দেবীকে ভক্তরা গয়না দিয়েই থাকে তাদের মানসিক পূরন হলেই।
দেবীর মূর্তি তৈরী করেন নবদ্বীপের এক কুমোর বংশ পরম্পরায়.....এমনকি যতদিন তারা মূর্তি তৈরী করবে ততদিন তারা হবিষ্যান্ন করে থাকবে শুদ্ধবস্ত্রে। দেবীকে ও জয়া বিজয়া কে পড়ানো হয় বেনারসি শাড়ি।
দেশাচার অনুসারে দেবীর দুপাশে ভর্তি করে দেওয়া হয় ভারী কাসা পেতলের বাসন দান হিসাবে.....যা প্রত্যেকবার নতুন নতুন দেওয়া হয়..... এখনো বর্ধমান রাজপরিবার থেকে পুজো আসে.....বিসর্জনের দিন নবদ্বীপ থেলে রাসের ঠেলা গাড়িতে করে মাকে কালনা পরিক্রমা করানো হয় এবং মা এসে দাঁড়ায় কালনার বিখ্যাত সাহা বাড়ীতে..... সেখানে মাকে বরণ করা হয় এবং তার পর মায়ের সাথে পরিক্রমারত সকলকে মিষ্টি বিতরন করা হয়.....শেষে মাঝরাতে মা আসেন গঙ্গার তীরে আর পুলিশের ঘেরাটোপের নিরাপত্তায় মায়ের গয়না খোলা হয় যা চলে যায় ব্যাঙ্কের লকারে।আর তারপর মাকে নিরঞ্জন করা হয় ভাগীরথীতে
এই
পুজোর চারদিন কালনাবাসী আনন্দে মেতে উঠে মা আসেন আনন্দ দিতে.....পুজোকে কেন্দ্র করে বসে বিশাল মেলা.....কালনা ঘিরে ফেলা হয় পুলিশি নিরাপত্তায়.....শুধু কালনা নয় দূর দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন মাকে দর্শন করতে পুজো দিতে, তাদের মনোবাঞ্ছা মাকে জানাতে....মা মহামায়া তার ভক্তদের ফেরান না.....এই ৫দিন ধরে বহু দুঃখী ভিখারি দুঃস্থ
মানুষ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মায়ের আটচালা সংলগ্ন চালায় আশ্রয় পান....শুধু তাই না একদিন তাদেত জন্য চলে অন্নক্ষেত্র এছাড়া বস্ত্র বিতরন শীতবস্ত্র বিতরন চলে। মা নিজে কিছু নেন না সব তার সন্তানের মধ্যে বিলিয়ে দেন। কোনো গরীবের মেয়ের বিয়ের সামর্থ্য নেই....মায়ের বেনারসী দানের বাসন তাদের দান করা হয়....জাত ধর্ম নির্বিশেষে মা ভক্তকে কৃপা করেন.....এছাড়া পুজোর চারদিন চলে পুতুল নাচ যা কালনার ঐতিহ্য
এছাড়া প্রতিদিন রাত্রে বসে যাত্রাপালার আসর মায়ের মণ্ডপের সামনে আর রাজার তৈরী নহবৎখানায় আজও সানাই বাজে......মা খুবই জাগ্রতা।এইভাবে ঐতিহ্যের সাথে আর ধারাবাহিকতায় পুজো পেয়ে আসছেন কালনার প্রাচীন মহিষমর্দিনী।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- শ্রীমান্ অমিক চট্টোপাধ্যায়
No comments:
Post a Comment