Thursday, August 1, 2019

প্রাচীনত্বে চিত্তেশ্বরী- ঐতিহ্য ও আভিজাত্যে


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ

 আজ প্রকাশিত হল চিতু ডাকাতের চিত্তেশ্বরী দুর্গা মন্দিরের ইতিহাস লিখলেন বনেদীয়ানা পরিবারের সদস্য শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী চলুন দেখা যাক সেই প্রাচীন মন্দিরের ইতিহাস

প্রাচীনত্বে চিত্তেশ্বরী- ঐতিহ্য আভিজাত্যে
 কলকাতার একটি প্রাচীন মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায় সপ্তদশ শতকে রচিত মঙ্গলকাব্যে সেখানে উল্লেখ রয়েছে এই বলে-"চিৎপুরে পূজে রাজা সর্বমঙ্গলা/ নিশি দিশি বাহে ডিঙা নাহি করে হেলা।।" যদিও ওই মঙ্গলকাব্যের মধ্যে এটিকে প্রক্ষিপ্ত বলে গবেষকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা হলেও ইতিহাসে কিন্তু প্রক্ষিপ্ত নয় গ্রাম চিত্তেশ্বরীপুর ওরফে চিত্রপুর বা চিৎপুর
কলকাতা হেরিটেজ হিসাবে এই চিত্তেশ্বরী দুর্গামন্দির স্বীকৃতি পেয়েছে, চিৎপুর অঞ্চলের প্রাচীনতম মন্দির এই চিত্তেশ্বরী উত্তর কলকাতার কাশীপুরের প্রাচীন স্থাপত্যচিত্রের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য এই দুর্গামূর্তি এখানে দেবী মহামায়া, চণ্ডিকা রূপে অসুরদলন করেন এবং অবশ্যই তার বাহন সিংহটিও উপস্থিত এখানে প্রচলিত কথায় শোনা যায় যে প্রথম চিতু ডাকাত এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই মন্দির থেকেই চিৎপুর রোড নামকরণ হয়েছে বঙ্গের প্রাচীন মন্দিরের মধ্যে এই চিৎপুরের চিত্তেশ্বরী দুর্গামন্দির অন্যতম

 চিত্তেশ্বরী মন্দির কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সঠিক সময় না জানা গেলেও অনুমান করা যায় চিতু ডাকাতের সময় এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উল্লেখ্য যে চিতু ডাকাত সেই সময় দুর্ধর্ষ ডাকাত হিসাবে পরিচিত ছিল ভেসে আসা নিমকাঠের গুড়ি দিয়ে তিনি এই মায়ের মূর্তি স্থাপন করেছিলেন এই মূর্তির বৈশিষ্ট্য হল এখানে মা দুর্গা তাঁর পুত্রকন্যা ছাড়াই পূজিতা হন এখানে দুর্গার বাহন সিংহটি ছাড়াও এক ছোট্টো বাঘ দেখতে পাওয়া যায় যা থেকে অনুমান করা যায় সেই সময় বাঘের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্যই চিত্তেশ্বরী দুর্গামূর্তির সাথে বাঘকেও পুজো করা হত
বাদশা আকবরের রাজত্বকালের শেষ, ১৬০৬ সাল থেকে সম্রাট জাহাঙ্গীরের শুরু এই সমসাময়িক সময়ে সুতানুটির উত্তর সীমানার পরেই ছিল ভয়াবহ জঙ্গল আর শ্বাপদেভরা অজচিত্রপুত্র গ্রাম এখানেই তখন বাস করত চিতে ওরফে চিত্তেশ্বর রায় সেকালের বিখ্যাত ভয়ঙ্কর ডাকাত, যার নাম শুনলে ভয়ে কাঁপত গাঁ-গঞ্জের লোক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে একটি গ্রাম ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে চিৎপুরকে তার আগে এখানে ছিল গভীর জঙ্গল একচ্ছত্র রাজত্ব ছিল ডাকাতদের একসময় অঞ্চলের খুবই পরিচিত দাপুটে ডাকাত ছিল চিতে গভীর অরণ্যে প্রতিদিন দেবী দশভুজার পুজো করত ষোড়শোপচারে পুজোর অন্যতম উপচার ছিল মাঝেমধ্যেই নরবলি ডাকাত চিত্তেশ্বরের নামানুসরণ করে দেবী দশভুজা দুর্গার নাম হয় চিত্রেশ্বরী বা চিত্তেশ্বরী গবেষকদের অনুমান, চিৎপুর নামের উৎপত্তিও একই কারণে



হরিসাধন মুখোপাধ্যায়েরকলিকাতা সেকালের একালেরগ্রন্থে উল্লেখ আছে, ‘চিত্তেশ্বরীর মন্দিরেই ডাকাতেরা নরবলি দিত গঙ্গার তীরস্থ বিজন অরণ্যমধ্যে এই মন্দির স্থাপিত ছিল এই চিত্তেশ্বরী এবং কালীঘাটের কালী ব্যতীত আর কোন বিখ্যাত কালী মন্দিরই তখন এদেশে ছিলনা


 তারপর চিতু ডাকাতের মৃত্যুর পর এই দেবী বেশ কিছুকাল জঙ্গলের মধ্যে একাকী- ছিলেন এরপর ওই মন্দির সংলগ্ন অঞ্চলে সাধনা করতে আসেন তান্ত্রিক নৃসিংহ ব্রহ্মচারী সালটি ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দ তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই মন্দির পুনরায় স্থাপন করেন, এবং সাহায্য নেন জমিদার মনোহর ঘোষ মহাশয়ের মনোহর ঘোষ ব্রহ্মচারীকে দেবত্তর এই মন্দির দান করেন মন্দিরের দায়িত্ব দেন ১৬১০ সালে দেবী এখানে দুর্গা, এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে আজও জেগে ওঠে সমগ্র চিৎপুর কাশীপুর অঞ্চল সর্ব ধর্মের মানুষেরা ভিড় করেন এই মন্দিরে পুজোর সময় সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে- নৃসিংহের পর তার শিষ্য রামনৃসিংহ প্রশিষ্য ক্ষেত্র ব্রক্ষ্মচারী মোহন্ত হন ঘটনাচক্রে বিবাহ করতে বাধ্য হন ক্ষেত্র ব্রক্ষ্মচারী তাঁর দুই কন্যা জ্যেষ্ঠা যদুমনির বিবাহ হয় এক অশীতিপর বৃদ্ধের সাথে কনিষ্ঠা কন্যা ক্ষেত্রমণি হালিশহরের  সাবর্ণ রায় চৌধুরী বংশের আনন্দমোহন রায় চৌধুরীর সঙ্গে পরিনীতা হনহ শ্রী রবীন্দ্রকুমার রায় চৌধুরী আনন্দমোহন রায় চৌধুরীর প্রপৌত্র বর্তমান সেবাইত হলেন সাবর্ণ গোত্রীয় কাশীশ্বর রায় চৌধুরী মন্দিরের বর্তমান সেবাইত শ্রী কাশীশ্বর রায় চৌধুরী, তিনি বংশপরম্পরায় মায়ের সেবা করছেন অতীতে এই চিত্তেশ্বরী মন্দিরে নরবলি হত মায়ের সামনে সেকালে ডাকাতরা দেবীকালিকাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নরবলি দিত, এখানে নরবলি হত চিত্তেশ্বরী দুর্গার উদ্দেশ্যে চিতে ডাকাতের দেবী চিত্তেশ্বরীর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি নরবলি হত, ১৮৪৬ সালে রেভারেন্ড লঙ সাহেব তার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন

‘It was then written Chittrapur and was noted for the temple of Chittreswari Dew or the Goddess of Chittru, known among European as the temple of Kali at Chitpore. According to popular and uncontradicted tradition, this was the spot where the largest number of human sacrifices was offered to Goddess in Bengal, before the establishment of the British Government. (Calcutta Review, Vol. III 1846)’
নাটমন্দিরের উত্তর গায়ে লেখা আছে – “শ্রীগিরীশ চন্দ্র দাস শ্রীমতী নিবদামনী দাসী ২১ নং যদুনাথ মিত্রের লেন শ্যামবাজার কলিকাতা

মেঝেতে মার্বেলপাথরে উৎকীর্ণ লিপি : “চরণ রেণু প্রয়াসী ৺যদুনাথ দত্ত তস্য পুত্র ৺নিবারণ চন্দ্র দত্ত তস্যপুত্র শ্রীসুশীল চন্দ্র দত্ত গড়পার কলিকাতা


নাটমন্দিরের দেওয়ালে একটি নিবদ্ধ বোর্ডে লেখা আছে৩৮৮ বৎসর পূর্ব্বে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ অগ্রদ্বীপের ঘোষপাড়ার বাসুদেব ঘোষের বংশধর বর্দ্ধমান মুর্শিদাবাদ জেলার সীমানায় কুলাই গ্রামের জমিদার মনোহর ঘোষ তাহার পত্নী সেওড়াফুলী রাজার কন্যা উভয়ে ইং ১৫৮৬ সালে এই চিত্তেশ্বরী দেবীর মন্দির স্থাপন করিয়া কিছু ভূসম্পত্তিসহ তদীয় সেবাইত মহন্ত নৃসিংহ ব্রহ্মচারিকে দান করেন চিতুডাকাত এই দেবীকে পূজা করিতেন কলিকাতা চিৎপুর রোড এই চিত্তেশ্বরী দেবীর নাম হইতে আখ্যাত উপস্থিত সেবিকা-বিল্বমাতা ব্রহ্মচারিণী ইং ১৯৭৪

 এই চিত্রেশ্বরী দুর্গামন্দিরের কাছে কাশীপুর উদ্যানবাটী সেই উদ্যানবাটী থেকে বেরিয়ে ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেব বিখ্যাত নাট্যকার গিরিশ ঘোষকে বলেছিলেন, গিরিশ প্রণাম কর, এই মা চিত্তেশ্বরী এই মন্দিরের স্থাপত্য মায়ের চিন্ময়ী বিগ্রহ দেখলে ভক্তিতে বিহ্বল হয়ে ওঠেন সবাই যেন এক নির্ভেজাল বনেদী বাড়ির পুজোর আবেশ প্রবেশ করেছে এই মন্দিরে ইতিহাস যেন কথা বলে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে


দেবীমন্দিরটি , খগেন চ্যাটার্জি রোড, কাশীপুরে, গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরির পাশে রাস্তার উপর যে কোনও বাসে বি. টি. রোডে চিড়িয়া মোড়ে নেমে পশ্চিমে কে. সি. রোড ধরে কিছুটা গেলেই দেবীমন্দিরের দেখা মিলবেবর্তমান সেবাইত হলেন সাবর্ণ গোত্রীয় কাশীশ্বর রায় চৌধুরী
[উপাদানঃ ."কলকাতার ইতিবৃত্ত"- প্রাণকৃষ্ণ দত্ত, . "কলকাতার মন্দিরও মসজিদ"- তারাপদ সাঁতরা(পৃষ্ঠা নং- ৩৬-৩৭), . "বঙ্গীয় সাবর্ণ কথা-কালীক্ষেত্র কলিকাতা"-ভাবানী রায় চৌধুরী,৪.হরিসাধন মুখোপাধ্যায়-"কলিকাতা সেকালের ও একালের, ৫. "কালচক্র"-পত্রিকা নভেম্বর,২০১৬]
তথ্যসূত্র সংগ্রহেঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী


No comments:

Post a Comment