ঐতিহ্যের
ইতিহাসপর্বঃ
আজ প্রকাশিত হল
যোধাবাইয়ের দুর্গাপুজো। লিখলেন
বনেদীয়ানা পরিবারের সদস্যা শ্রীমতী দেবযানী
বসু মহাশয়া। চলুন
দেখা যাক সেই পুজোর
ইতিহাস।
আভিজাত্যে
যোধাবাইয়ের পুজোঃ- দেবযানী বসু
দেশে তখন মোগল
সাম্রাজ্য। সমগ্র
উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও
মধ্য ভারত দিল্লিশ্বরের পদানত। তবু
মনে সুখ নেই সম্রাট
জাহাঙ্গীরের। কারণ
বাংলায় তখনও বারো ভুঁইয়ার
শাসন। এরমধ্যে
এগারোজন সম্রাটের মৌখিক অধীনতা স্বীকার
করলেও তাঁকে শায়েস্তা করতে
পারেননি আজীবন। সেনাপতি
মানসিংহকে ভার দিয়েছিলেন প্রতাপাদিত্যকে
বশে আনার। প্রতাপাদিত্যের
সৈন্যবাহিনী ছিল অপ্রতিরোধ্য।
তার নেপথ্যে ছিলেন সম্রাটের সেনাধ্যক্ষ
এক ব্রাহ্মণ-শংকর চট্টোপাধ্যায়।
তাই বাংলায় মানসিংহ পর্যুদস্ত
হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন।
সম্রাট জাহাঙ্গীর আবারও
মানসিংহকে পাঠান বাংলায়।
মানসিংহ এবার বেছে নিয়েছিলেন
কূটনীতির পথ। প্রতাপাদিত্যের
কোষাধ্যক্ষ ভবানন্দ মজুমদারকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার
করে মানসিংহ জেনে নিলেন প্রতাপাদিত্যের
দুর্গে প্রবেশের গুপ্তপথ। প্রতাপাদিত্যের
আরাধ্যা মা যশোরেশ্বরীকে দর্শনের
অছিলায় জেনে নেন দুর্গের
প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কৃষ্ণনগরের
ভূস্বত্ব ও মহারাজা উপাধির
বিনিময়ে ভবানন্দ রাজপ্রসাদের মানচিত্র মানসিংহের হাতে তুলে দেন। সেনাধ্যক্ষ
শংকরকেও বিশ্বাসঘাতকতার দলে টানতে চেষ্টা
করেন মানসিংহ। কিন্তু
ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
করেন শংকর। এরপর
রাজধানী ধুমঘাট ঘিরে ফেলেন
মানসিংহ। তীব্র
প্রতিরোধ সত্ত্বেও এবার তিনি জয়ী
হন। বন্দি
হন প্রতাপাদিত্য ও সেনাধ্যক্ষ শংকর। দিল্লি
আসার পথে প্রতাপাদিত্যের মৃত্যু
হয়। শংকরকে
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন জাহাঙ্গীর।
এরপর ঘটে নাটকীয়
ঘটনা, সামনেই দেবীপক্ষ।
মহালয়ার পিতৃতর্পণের কাল উপস্থিত।
সেনাপতি শংকর হাজার কাজের
মধ্যেও নদীতে পিতৃতর্পণ করতে
ভোলেননি কখনও। এবারও
সম্রাটের কাছে আর্জি জানালেন
পিতৃপুরুষকে জলদানের জন্য। কিন্তু
জাহাঙ্গীর নাকচ করে দিলেন। ধর্মপ্রাণ
শংকর সংকল্প করলেন অনশনে
প্রাণত্যাগ করবেন। এই
সংবাদে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন রাজমাতা আকবর
মহিষী যোধাবাই। রাজপুত
কন্যা যোধা ছিলেন প্রবল
ধর্মপ্রাণা ও নিষ্ঠাবতী।
মুসলিম ঘরণি হয়েও তিনি
সারাজীবন হিন্দুই ছিলেন। দেশের
ও পরিবারের অমঙ্গল আশঙ্কায় তিনি
শংকরের আবেদন মঞ্জুর করার
আদেশ দিলেন পুত্রকে।
মাতৃআজ্ঞা অমান্য করেননি জাহাঙ্গীর। সৈন্যপরিবেষ্টিত
শংকর যমুনা নদীতে তর্পণ
করলেন। জনতার
মধ্যে থাকা বোরখা পরিহিতা
যোধাবাইও শুনলেন শংকরের মন্ত্রোচ্চারণ। অভিভূত
হয়ে তিনি দেখা করলেন
কারাগারে শংকরের সাথে।
বললেন, স্বপ্নে তিনি দেখেছেন মা
দুর্গার পায়ে তিনি পুষ্পাঞ্জলি
দিচ্ছেন। আমার
ইচ্ছা দেশে ফিরে গিয়ে
তুমি দুর্গাপুজো শুরু কর।
আমি ব্যয়ভার বহন করব।
কিন্তু শংকর জানালেন, আমি
শৈব, শক্তিপূজা করা সম্ভব নয়। তখন
রাজমহিষী বললেন, পুজোর সংকল্প
করবে আমার নামে।
আমি নিজে উপস্থিত হয়ে
আমার স্বপ্নপূরণের পুজো দেখব।
পুত্র জাহাঙ্গীরকে বলে শংকরকে তিনি
মুক্ত করে দিলেন।
সেই শুরু।
উত্তর ২৪পরগণার বারাসাতের দক্ষিণ পাড়ায় শংকরের
পৈতৃক ভিটে "শিবের কোঠীর" দুর্গাপুজোর। আজও
যথাযোগ্য মর্যাদায় সেই পুজো করে
চলেছেন চট্টোপাধ্যায় পরিবার। শংকরের
১০তম অধস্তন পুরুষ কিরণশংকর
চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শোনা গেল
সেই ইতিহাসের বুড়ি ছোঁয়া কাহিনী। ১৬০৭-১৬০৮ সালে শুরু
হয়ে এবছর সেই পুজো
৪১২বছরে পদার্পণ করবে। অনেক
ঝড়ঝাপটা এসেছে কিন্তু নষ্ট
হয়নি পুজোর ধারাবাহিকতা।
কিরণশংকরবাবু আশাবাদী মোগল সম্রাজ্ঞীর অনুরোধে
যে পুজোর শুরু, সেই
পুজো ম্লান হবে না
কোনও দিন। মায়ের
ইচ্ছাতেই চলবে ধার্মিক নারীর
নামাঙ্কিত পুজো।
যাঁর অনুপ্রেরণায় এই পুজো শুরু
সেই যোধাবাই আসতে পারেননি কোনও
দিন। একবার
ধুমধাম করে শংকর পুজো
করছেন তখন এক অশ্বারোহী
এসে শংকরের হাতে এক
পত্র তুলে দেন।
বিষাদে ভরে যায় মন। পত্রলেখিকা
স্বয়ং যোধাবাই। লিখছেন,
বয়সের ভারে এতটাই অশক্ত
হয়ে পড়েছি যে তোমার
পুজোয় আমি উপস্থিত হতে
পারলাম না। দুর্গামায়ের
কাছে আমার একান্ত প্রার্থনা
তোমার দেবী আরাধনা সফল
ও সম্পূর্ণ হোক।
আজও সেই পুজো সেই
ধারাবাহিকতা ও ঐতিহ্যের সাথে
হয়ে আসছে চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে।
তথ্যসূত্র
এবং চিত্রেঃ শ্রীমতী দেবযানী বসু
No comments:
Post a Comment