ঐতিহ্যের
ইতিহাসপর্বঃ
আজ প্রকাশিত হল দক্ষিণ কলকাতার
ভবানীপুর দে পরিবারের দেবীপূজার
ইতিহাস। ইতিহাস
সংগ্রহ করলেন পরিবারের সদস্য
শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী। দে
পরিবারের সদস্য শ্রী দেবরাজ
দে মহাশয়কে অনেক অভিনন্দন ও
শারদ শুভেচ্ছা জানাই।
১৫০ বছরের ইতিহাস সম্বলিত
ভবানীপুর দে বাড়িতে ইংরেজ-অসুর দমনকারীনি দেবী
দুর্গার আরাধনা :-
ভবানীপুর
দে বাড়ির দুর্গা পুজোর
ইতিহাস জানতে হলে আমাদের
পিছিয়ে যেতে হবে ১৫০
বছর আগে, অষ্টাদশ শতকে।
ইতিহাস
বই এর পাতা থেকে
ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে কম
বেশি সবাই পড়েছি।
আজ আপনারা জানবেন সেই
সময়ে শুরু হওয়া ঐতিহ্যবাহী
একটি বনেদি পরিবারের দুর্গা
পুজোর কথা। যা
গোরা সাহেব বিরোধী কার্যকলাপের
ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে আজও বিরাজমান।
ভবানীপুর
দে পরিবারের পুজোর সূচনা করেছিলেন
শ্রী রামলাল দে মহাশয়। তিনি
জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে,
গোবরডাঙ্গায়। পরবর্তী
কালে ব্যবসায়িক সূত্রে তিনি দক্ষিণ
কলকাতার ভবানীপুরে আসেন এবং স্থায়ী
ভাবে বসবাস শুরু করেন। ঈশ্বরের
কৃপায় তাহার তুলো ও
সয্যা দ্রব্যের ব্যবসা ধীরে ধীরে
সমৃদ্ধি লাভ করতে থাকে। সেই
সয্যা দ্রব্যের ব্যবসা বংশ পরম্পরায়
আজও বর্তমান।
এবার আসা যাক পুজোর
কথায়...
গুরুজনদের
থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে
শুনে আসা কথা অনুযায়ী
- পুজোর শুরু হয়েছিল দেবীর
মাতৃরুপী আগমনের মাধ্যমে।
একদিন সন্ধ্যায় এক লাল পাড়
সাদা শাড়ি পরিহিত মহিলা
তাহার দুই পুত্র ও
দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে
প্রবেশ করেন এই ২৬
নং চন্দ্রনাথ স্ট্রিট-এর বাড়িতে।
তিনি তার সন্তানদের নিয়ে
কাউকে কিছু না বলেই
গৃহের দালান হতে ভিতর
মহলের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
বাড়ির এক সদস্যা তৎক্ষণাৎ
তাহার পিছু নেওয়া সত্ত্বেও
পরবর্তী মুহূর্তে তাহাদের বাড়ির কোথাও আর
খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বেশ কিছু দিন পরে
সেই একই বেশে সেই
মহিলাকে আবারও দেখা যায়
বাড়ির ছাদের কারনিশে বসে
পা দোলাতে। ইতিমধ্যে
শ্রী রামলাল দে-ও
সেই একই বেশ ধারনকারী
মহিলার স্বপ্নাদেশ পান দেবী দুর্গার
পূজা করার জন্য।
সেই বছর অর্থাৎ ১৮৭০
খ্রিস্টাব্দ থেকে দেবী দুর্গাকে
মাতৃ রূপে পুজো শুরু
করেছিলেন রামলাল দে।
পরবর্তী
সময়ে এই বাড়ির পুজোর
সাথে জড়িয়ে পড়েছিলো স্বাধীনতা
সংগ্রামের ইতিহাস। দিনে
দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছিলো ইংরেজদের
তুমুল অত্যাচার ও অপসাসন।
ক্রমশ মাথাচারা দিচ্ছিলো স্বদেশীদের স্বাধীনতা সংগ্রাম। বংশ
পরম্পরায় আমরা শুনে আসছি
ব্রিটিশ সরকারের অরাজকতা ও ভারতীয়দের উপর
অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই বিগত অষ্টাদশ শতক
থেকে মহিষাসুরকে ব্রিটিশ সাহেবের রূপ দান করা
হয়। কালো
কোট ও বুট পরিহিত
গোরা সাহেব বিরাজমান থাকেন
মা দুর্গার পায়ের তলায়।
দেবী দুর্গা ত্রিশূল দিয়ে
সাহেব রুপী অশুভ শক্তির
বিনাশ করেন। সেই
রূপ আজও অপরিবর্তিত।
বর্তমানে
দেবীর পূজা করে আসছেন
শ্রী রামলাল দে'র
তিন পুত্রের মধ্যে দুই পুত্র
শ্রী অতুল কৃষ্ণ দে
ও শ্রী অনুকূল কৃষ্ণ
দে'র বংশধরেরা।
বংশ পরম্পরায় প্রতি বছর রথ-যাত্রার দিন কাঠামো পুজোর
মাধ্যমে দেবী দুর্গার আরাধনার
সূচনা করা হয়।
এক-চালার সাবেকি প্রতিমা
পূজিত হন একই কাঠামোতেই। অর্থাৎ
দেবীর বিসর্জনের পর কাঠামো ফিরিয়ে
আনা হয়। পরের
বছর সেই ১৫০ বছরের
পুরোনো কাঠামোতেই পূজিত হন দেবী
দুর্গা।
প্রতি
বছর জন্মাষ্টমীর পর থেকে প্রতিমার
নির্মাণকার্য শুরু হয় বাড়ির
ঠাকুর দালানেই। ইংরেজ-অসুর নিধন ছাড়াও
মূর্তির বিশেষত্ত্ব হল দেবীর বাহন
রূপে থাকা সিংহের গায়ের
রঙ হল সাদা।
কুমোরের
মূর্তি নির্মাণের পর, পরিবারের সদস্যরা
নিজে হাতেই দেবীকে সাজিয়ে
তোলেন। চতুর্থীর
দিন পরিবারের মহিলারা দেবীর জন্য নারকেল
নাড়ু প্রস্তুত করেন। সিঁদুর
দিয়ে রাঙানো দেবীর অস্ত্র
দান করা হয় বোধনের
প্রাক্কালে। নিত্য
ভোগ রূপে ১৩ টি
লুচি ও ১৩ রকমের
মিষ্টি দেবীকে অর্পণ করা
হয়।
অষ্টমী
তিথিতে কুমারী ও সদবা
পুজোর সাথে সাথে এই
বাড়ির মহিলা সদস্যাদের মাথায়
ও দুই হাতে সরা
নিয়ে ধুনো পোড়ানোর রীতি
আজও প্রচলিত।
অষ্টমী
ও নবমী তিথির সন্ধিক্ষনে
৪৮ মিনিটের সন্ধি পুজোতে ফল
ও ২১ কিলো চাল
দিয়ে নির্মিত নৈবিদ্য দেবী কে উৎসর্গ
করা হয়। তার
সাথে ১০৮ প্রদীপ ও
১০৮ পদ্মের মালার নিবেদন
আবশ্যিক।
পুজোর
প্রাক্কালে পরিবারের সকল সদস্য একত্রিত
হয় এবং সম্মিলিত ভাবে
নৃত্য, সঙ্গীত, আবৃত্তি, নাটক প্রভৃতি শিল্পকলা
পরিবেশনের মাধ্যমে আনন্দ উৎসবে মেতে
ওঠে।
বিজয়া
দশমীর দিন জল-আয়নায়
দেবীর চরণ দর্শন, দেবীকে
বরণ ও সিঁদুর খেলার
মাধ্যমে দেবীকে বিদায় জানানো
হয়।
অতীতের
ন্যায় বর্তমানেও এক-চালার প্রতিমা
বাঁশে বেঁধে, কাঁধে করেই
হেঁটে গঙ্গায় গিয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন
করা হয় এবং কাঠামো
ফিরিয়ে আনা হয়।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ-
শ্রী দেবরাজ দে
সংগ্রহেঃ-
শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment