Friday, August 23, 2019

কাঠামোপুজোর মাধ্যমে শুরু হল রায় চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজোঃ- কলকাতা


ঐতিহ্যের ইতিহাসপর্বঃ

 আজ প্রকাশিত হল কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গাপুজোর ইতিহাস প্রকাশিত হল সাবর্ণ গোত্রীয় রায় চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো এবং পরিবারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে আনলেন বনেদীয়ানা পরিবারের শ্রীমান মৃন্ময় চক্রবর্তী চলুন দেখা যাক কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজোর ইতিহাস

আভিজাত্যে  ঐতিহ্যে রায় চৌধুরী বাড়িঃকলকাতা

সাল ১৬০৮, তখন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় বঙ্গে মানসিংহ প্রতাপাদিত্যকে দমন করে তাঁর গুরুদেব(মানসিংহের) কামদেব ব্রহ্মচারীর বংশধর লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রদান করলেন বিস্তৃত জমিদার প্রায় ৮টি পরগনার যা উত্তরে হালিশহর থেকে দক্ষিনে ডায়মন্ডহারবার অবধি শুধু জমিদারিই নয় প্রদান করলেন রায় এবং চৌধুরী উপাধিও লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ই কলকাতার প্রথম জমিদার এবং প্রথম সমাজসংস্কারক ১৬১০ সালে সাবর্ণ গোত্রীয় লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী ভগবতীদেবী শুরু করলেন কলকাতার প্রথম দুর্গাপুজো, বড়িশার আটচালায় কেন বড়িশাকেই তাঁরা বেছে নিলেন? কারণ বড়িশা তখন উন্নত জনপদ তাই তাঁরা বড়িশায় একটি আটচালার চণ্ডীমণ্ডপ নির্মান করে শুরু করলেন দুর্গাপুজো লক্ষ্মীকান্তের এতই বিশাল জমিদারি ছিল তিনি চাইলেই অট্টালিকা নির্মাণ করে পুজো করতে পারতেন কিন্তু তিনি সাধারণ বাংলার চণ্ডীমণ্ডপ নির্মান করেই পুজো করলেন যাতে পুজোর সময় তাঁর সকল প্রজারা পুজোয় অংশগ্রহণ করতে পারে এই ঘটনায় প্রমাণ হয় লক্ষ্মীকান্ত রায় চৌধুরীর প্রজাদরদী মনোভাব পুজোর কটাদিন সকল প্রজারা আসতে পারতেন জমিদার বাড়ির পুজো দেখতে

 বলাবাহুল্য লক্ষ্মীকান্তই প্রথম যিনি এই একচালায় দেবী দুর্গার সাথে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক এবং গনেশ অর্থাৎ সপরিবারের রূপ নিয়ে আসেন আগে কার্তিক পুজো পেতেন আদিবাসী সম্প্রাদায়ে, কিন্তু লক্ষ্মীকান্ত কার্তিকে নিয়ে এলেন রাজারূপে, অর্থাৎ রায় চৌধুরী পরিবারে কার্তিক যুবরাজ রূপে পূজিতা হন রায় চৌধুরী পরিবারের কাঠামোপুজো হয় জন্মাষ্টমীর দিন এবং রাধাষ্টমীর দিন দেবীর গায়ে প্রথম মাটির প্রলেপ প্রদান করা হয় আজও সেই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য নিয়েই পুজো হয় সাবর্ণ বাড়িতে
 রায় চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো হয় বিদ্যাপতি রচিত "দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী"মতে অতীতে পশুবলিপ্রথা থাকলেও বর্তমানে পশুবলিপ্রথা বন্ধ তাই ফলবলি দেওয়া হয় সাবর্ণ বাড়ির একচালার প্রতিমায় ত্রিচালা বসে অর্থাৎ মটচৌরী আকৃতির হয়, সেখানে দশমহাবিদ্যা অঙ্কিত থাকে জগত্তারিণি দুর্গার একপাশে থাকেন রাম এবং একপাশে থাকেন শিব, তাদেরও নিয়মিত পুজো করা হয় কৃষ্ণানবমীতে বোধন হয় আটচালায়, সেই দিন থেকে চণ্ডীপাঠ, হোম, ভোগ নিবেদন ইত্যাদিও শুরু হয় আটচালায় বর্তমানে সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারে ৮টি দুর্গাপুজো হয় বড়িশাতে ছয়টি- আটচালা বাটী, মেজবাড়ি, বড়বাড়ি, মাঝেরবাড়ি, কালিকিঙ্করবাড়ি এবং বেনাকীবাড়ি আর নিমতাবাড়ি বিরাটিবাড়িতেও পুজো হয় এই ৮টি বাড়ির জগত্তারিণি দুর্গার রঙ হয় শিউলি ফুলের বোঁটার মতন স্বর্ণবর্ণা বড়বাড়ি, মেজবাড়ি এবং নিমতাবাড়ির সিংহটি হয় অশ্বমুখী বড়বাড়ি বিরাটিবাড়িতে নবমীর দিন হয় কুমারীপুজো বড়বাড়িতে সপ্তমীর রাত্রে অর্ধরাত্র বিহিত পুজো হয় যেখানে দেবীকে ঠিক সন্ধিপুজোর মতন চামুণ্ডারূপে পুজো করা হয়




 সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারে দেবীকে সাদাভাত, পোলাও, খিচুড়ি, নানান রকমের ভাজা, নানান তরকারি, মাছ, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করা হয় শুধুমাত্র নিমতার বাড়ির ভোগ নিরামিষ হয় পরিবারের সন্ধিপুজোর সময় একটি ল্যাঠামাছ পোড়া দেওয়া হয় দেবীকে নিমতায় রয়েছেন রায় চৌধুরী পরিবারের কুলমাতা তথা কলকাতার আদিকালিকা মা ভুবনেশ্বরী সেই দেবীরও বিশেষপুজো হয় এই দুর্গাপুজোর সময় এছাড়া এই পরিবারে বিজয়া দশমীর দিন দেবীকে পান্তভাত, কচুর শাক ইলিশমাছের মাথ দিয়ে, চালতার চাটনি ইত্যাদি প্রদান করা হয় প্রাচীন ঐতিহ্য মেনেই আজও পুজো হয় এই জমিদারবাড়িতে


 সাবর্ণবাড়িতে কনকাঞ্জলিপ্রথা রয়েছে দশমীর দিন উমাকে বিদায় জানানোর জন্য শুরু হয় দেবীবরণ, চলে মহিলাদের সিঁদুর খেলা তারপর নিরঞ্জনপর্ব শুরু হয় এইভাবে ৪১০বছর ধরে পুজো হয়ে আসছে কলকাতার সাবর্ণ রায় চৌধুরী বাড়িতে, যা কলকাতার একমাত্র প্রাচীনতম দুর্গাপুজো  এই প্রাচীন ধারা এবং রীতিনীতির আজও মেনে নিষ্ঠার সাথে পুজো পেয়ে আসছেন জগত্তারিণি দুর্গা

শুধু দুর্গাপুজোই নয় এই পরিবারেরই প্রতিষ্ঠিত মন্দির কলকাতার কালীঘাট মন্দির, যেই কালীঘাটের সাথে ১৫৬৯সাল থেকে এই সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের যোগাযোগ এবং কালীঘাটের বর্তমান মন্দিরও ১৮০৯ সালে তৈরি করে দেন এই পরিবারের সন্তোষ রায় চৌধুরী কালীঘাটই নয় রায় চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠিত মা করুণাময়ী কালীমন্দির- টালিগঞ্জ, নিমতা কালীবাড়ি, ময়দা কালীবাড়ি, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির-হালিশহর, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির-পানিহাটী, এছাড়া কেশবেশ্বর শিবমন্দির, বড়িশার দ্বাদশ শিবমন্দির, বড়িশার চণ্ডীবাড়ির মা চণ্ডী, বড়িশার বড়বাড়ির মা অন্নপূর্ণা মাতাঠাকুরাণী, বড়বাড়ির জগন্নাথ মন্দির, এছাড়া অসংখ্য শিবমন্দির ইত্যাদি অন্যতম আজ জন্মাষ্টমীর পুণ্যতিথিতে যেমন দুর্গাপুজোর কাঠামো পুজো হল তেমনি সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠিত ৪টি প্রাচীন রাধাকৃষ্ণ মন্দিরেও অনুষ্ঠিত হবে জন্মাষ্টমীর পুজো বড়িশার রাধাকান্ত মন্দির, হালিশহরের শ্যামরায় (এই শ্যামরায়ই রাইটার্স বিল্ডিং যেখানে অবস্থিত ছিল সেখানে সাবর্ণদের কাছারি বাড়ি ছিল সেই বাড়িই কলকাতার প্রথম পাকাবাড়ি সেই কাছারী বাড়িতে শ্যামরায়ের মন্দির ছিল সেখানে দোলউৎসবও হত বর্তমানে সেই শ্যামরায়ই সাবর্ণদের হালিশহরে রয়েছেন), পানিহাটির গোবিন্দ রাধারানির মন্দির, রাসবাড়ি ইত্যাদি মন্দিরে অনুষ্ঠিত হবে জন্মাষ্টমীর পুজো

কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- শ্রী শুভদীপ রায় চৌধুরী (সাবর্ণ পরিবারের সদস্য)
তথ্য লিপিবদ্ধেঃ- শ্রীমান্ মৃন্ময় চক্রবর্তী





No comments:

Post a Comment