ঐতিহ্যের হৈমন্তীপর্বঃ-২
আজ দ্বিতীয় হৈমন্তীপর্ব, গতকাল থেকে আমরা শুরু করেছি বঙ্গের প্রাচীন প্রাচীন জগদ্ধাত্রী পূজার ইতিহাস ও রীতিনীতি নিয়ে পর্বালোচনা। আজ শান্তিপুর অঞ্চলের প্রাচীন ব্রহ্মচারী পরিবারের ১২৫তম জগদ্ধাত্রীপুজোর ইতিহাস লিপিবদ্ধ করলাম। লিখলেন বনেদীয়ানা পরিবারের সদস্য শুভদীপ, সাহায্য করলেন ব্রহ্মচারী পরিবারের সদস্য শ্রী শতায়ু ব্রহ্মচারী।
ঐতিহ্যের হৈমন্তীপর্বঃ- শান্তিপুরের ব্রহ্মচারী পরিবার
এই
ব্রহ্মচারী পরিবারের আদি পদবী বাগচী। বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার নাটরে এই বংশের আদি বাসস্থান। এই ব্রহ্মচারী বংশের আদিপুরুষ ছিলেন চামু ব্রহ্মচারী, যিনি রাজশাহী জেলায় নাটরে বসবাস করতেন ১৪৮৫ খ্রীঃ। চামু ব্রহ্মচারীর পৈতের সময় তিনদিন রাত্রীবাসে, তাঁর সৎ-মা এবং নিজের মায়ের দ্বন্দ্বের কারণে তিনি দণ্ডীঘর থেকে আগেই বেড়িয়ে আসেন সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য তাই এরপর থেকে পরিবারের সদস্যরা বাগচীর পরিবর্তে ব্রহ্মচারী পদবী লিখতে শুরু করেন, যদিও চামু ব্রহ্মচারী আবার পরিবারে ফিরে এসেছিলেন তাও যেহেতু তিনি সন্ন্যাসীর জন্য বেড়িয়েছিলেন তাই। সেইসময় বাংলায় হুসেন শাহের আমলে বাংলায় “মাৎসন্যায়” অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেই সময় তিনি আধিপত্যবিস্তারের কারণে জমিদারি প্রদান করেন। তখন এই ব্রহ্মচারী পরিবার দক্ষিনচব্বিশ পরগনার অন্তর্গত সুভাষগ্রাম ও মল্লিকপুরের মাঝে মালঞ্চ গ্রামের জমিদারি পান ১৪৮৮ খ্রীঃ। সেই ১৪৯১খ্রীঃ ব্রহ্মচারী বংশে দুর্গাপুজো শুরু হয় মালঞ্চ গ্রামে। সেইবছরই জগদ্ধাত্রীপুজোও শুরু হয়েছিল পরিবারে।
তার কিছুকাল পরেই ১৮৮০-৮৫ খ্রীঃ পরিবারের পুর্বপুরুষ রামগোপাল ব্রহ্মচারী মালঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসেন ও শান্তিপুরে চলে যান। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে এই পরিবারের পাটের ব্যবসা মূল ছিল এবং পরিবারের ব্যক্তিগত সংঘাতের কারণে রামগোপাল ব্রহ্মচারীর পাটের গুদামে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং রামগোপাল ব্রহ্মচারী সমস্ত সম্বল হারিয়ে ফেলেন। সেই সময় রামগোপাল ব্রহ্মচারীর মাতুলালয় ছিল শান্তিপুরের বনেদী পরিবার মৈত্রপরিবার। মৈত্র পরিবারের রজনীকান্ত মৈত্রের সঙ্গে রামগোপাল ব্রহ্মচারী ব্যবসার সংযোগ স্থাপন করেন এবং ১৮৮০-৯০ খ্রীঃ তিনি শান্তিপুরে নিজে বাড়ি ও আটচালা নির্মাণ করেন। নির্মাণের পর তিনি দেবীর স্বপ্নাদেশ পান জগদ্ধাত্রীপুজোর জন্য, ঠিক কালীপুজোর পরই। সময় কম থাকায় রামগোপাল পরদিন গঙ্গস্নানের সময় এক ৭বছরএ বালিকাকে দেখেন ও তাঁকেই অনুসরণ করে গিয়ে তিনি এক কুমোরের বাড়িতে পৌঁছান এবং সেখানে মূর্তি নির্মাণের ব্যবস্থা করে আসেন। তাই আগে ১৪৯১সালে মালঞ্চে দুর্গাপুজো ও জগদ্ধাত্রীপুজো শুরু হলেও শান্তিপুরে জগদ্ধাত্রীপুজো শুরু হয় ১৮৯৪-৯৫সালে। পরবর্তীকালে রামগোপাল ব্রহ্মচারীর প্রথম ও দ্বিতীয়পুত্রই এই পুজোর পুরোধা ছিলেন। রামগোপাল ব্রহ্মচারীর দ্বিতীয় পুত্র ভুঁতনাথ ব্রহ্মচারীর সময় জগদ্ধাত্রীপুজোর জাঁকজমক বাড়তে থাকে এবং সেই সময় অর্থাৎ ১৯০৫-০৭খ্রীঃ ভুঁতনাথ ব্রহ্মচারী ২৫০০০টাকা দিয়ে মায়ের গহনা নির্মাণ করেন এবং তারসাথে সম্পত্তির পরিমানও বৃদ্ধি করেন।
রামগোপাল ব্রহ্মচারীর সময় আটচালার সংস্করণ করে ভুঁতনাথ ব্রহ্মচারী দেবী দালান নির্মান করেন সামনে নাটমন্দির নির্মাণ করেন। ব্রহ্মচারী বংশে জগদ্ধাত্রীর রঙ উদিত সূর্যের ন্যায় লাল হয়। এই পরিবারে একদিনেই পুজো হয় নবমী তিথিতে অর্থাৎ ত্রিকালীন পূজা। দেবীর চালচিত্রে সম্পূর্ণ হস্তকুটীর শিল্পের ছোঁয়া লক্ষ্য করা যায়। দেবী সিংহবাহিনী এবং রাজসিংহরূপ লক্ষ্য করা যায়। জগদ্ধাত্রীকে স্বর্ণালংকারে সাজানো হয়। এই পরিবারে দেবী স্বয়ং বৈষ্ণবী হলেও তন্ত্রমতে পূজা হয়। দেবীকে সম্পূর্ণ নিরামিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। একমাত্র শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত বাড়ির মহিলারা এবং বাড়ির মেয়েরাই ভোগরান্না করতে পারেন। এই পরিবারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল সম্পূর্ণ গঙ্গাজল ব্যবহৃত হয় ভোগরান্নায় এবং সন্দকনুন ব্যবহৃত হয়। ভোগে থাকে ঘিভাত, খিঁচুড়ি, ভাজা, তরকারি, পায়েস, চাটনি ইত্যাদি। ভোগঘর থেকে দেবীর কাছে ভোগ নিয়ে যাওয়ার সময় অন্দরমহলের সমস্ত দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই পরিবারে এখন নরনারায়ণ সেবার ব্যবস্থা করা হয়। পরিবারে আঁখ, চালকুমড়ো এবং কলা বলি হয়। পূজার সময় ১০৮দীপ প্রজ্জ্বলিত হয়। বর্তমানে এই পুজোর পৌরোহিত্য করেন শ্রী কৃষ্ণেন্দু মুখোপাধ্যায়। পূজার আগের দিন চণ্ডীপাঠ হয় এবং সন্ধ্যায় দেবীর অধিবাস হয় এবং অধিবাস শেষে বাড়ির মহিলারা ঢাকিদেরও বরণ করেন যাকে “তালঠাণ্ডা”বলা হয় এই রীতি কেবলমাত্র নদীয়া জেলাতেই লক্ষ্য করা যায়। দশমীর দিন সকাল থেকে বাড়ির ছেলেরা রীতি অনুযায়ী আতসবাজি তৈরী করেন নিজের হাতে। দশমীর দিন পরিবারে ইলিশ মাছ খাওয়া হয়। এই ব্রহ্মচারী বংশের গৃহদেবী ম শীতলা তাঁরও পূজা হয় এইদিনে এবং নগরের দেবী মা সিদ্ধেশ্বরী, তাঁরও পূজা হয় নৈবেদ্য সহযোগে।
দশমীর দিন কনকাঞ্জলি প্রথার মাধ্যমে দেবীকে বিদায় জানানো হয়। এখনও কাঁধে করে দেবীকে নিরঞ্জনের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। দেবীকে বিসর্জনের সময় যে আতসবাজি পরিবারের সদস্যরা তৈরী করেছিল তা পোড়ানো হয়। বিসর্জন শেষে বাড়ির দালানে জোড়া সত্যনারায়ণ পূজা হয় এবং পূজা শেষে শান্তিজল প্রদানের মাধ্যমে পূজার পরিসমাপ্তি ঘটে ব্রহ্মচারী বংশের।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- শ্রী শতায়ু ব্রহ্মচারী
তথ্যসূত্র লিপিবদ্ধেঃ- শুভদীপ
No comments:
Post a Comment