ঐতিহ্যের হৈমন্তীপর্বঃ-৪
আজ প্রকাশিত হচ্ছে জগদ্ধাত্রীপুজোর চতুর্থপর্ব। গত তিনটি পর্বে আমরা কলকাতার একটি ও শান্তিপুরের দুইটি পরিবারের জগদ্ধাত্রীপুজোর কথা উল্লেখ করেছি। এই পর্বে আমরা চন্দননগরের প্রাচীন জগদ্ধাত্রীপুজোর কথাই উল্লেখ করবো। প্রসঙ্গত কলকাতা যেমন দুর্গাপুজোর জন্য বিখ্যাত, শান্তিপুর যেমন রাস উৎসবের জন্য বিখ্যাত ঠিক তেমনই চন্দননগর বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য। জগদ্ধাত্রীপুজোর সময় চন্দননগরে দর্শনার্থীদের ভীড় দেখবার মতন। আজ আমরা বনেদীয়ানা'য় দেখব চন্দননগরের "আদি মা"র পুজোর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও রীতিনীতি। লিখলেন বনেদীয়ানা'র সদস্য শুভদীপ, সাহায্য করলেন আদি মা পুজো কমিটির অন্যতম সদস্য শ্রী চন্দন ঘোষ মহাশয়। চলুন দেখা যাক সেই প্রাচীন ইতিবৃত্ত।
ঐতিহ্যের হৈমন্তীপর্বে চন্দননগরঃ- আদি মা
চন্দননগরে বহু বারোয়ারি পুজোমণ্ডপে এবং কিছু বনেদীবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো অনুষ্ঠিত হয়। তবুও তাদের মধ্যে যে অন্যতম তিনি হলেন চন্দননগরের আদি মা। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান ইঁন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী বানিজ্য করতে যাওয়ার সময় এই অঞ্চলে চালের আড়ত ছিল, সেখানে তিনি মায়ের আদেশ পান তাঁর পূজা করাবার জন্য। তখন ইঁন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এই স্থানে মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে তাঁর পুজো শুরু করেন সেই থেকে এই পুজোর নাম চাউলপট্টি আদি জগদ্ধাত্রীমাতা। এই পুজোর বয়স আনুমানিক ৩০০বছর, ভক্তদের ভীড় দেখবার মতন হয় এই জগদ্ধাত্রীপুজোর সময়।
বলাবাহুল্য চন্দননগরের শ্রেষ্ঠ উৎসব জগদ্ধাত্রীপুজো। আদি মায়ের মন্দিরে সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী এই তিনদিনই মায়ের পুজো ও ভোগ নিবেদন হয়। তিনদিনই মায়ের সামনে পশুবলিপ্রথা রয়েছে। এই মন্দিরে যিনি পৌরোহিত্য করছেন তিনি বংশপরম্পরায় করছেন, যিনি মাকে তৈরি করেন তিনিও বংশপরম্পরায় মাকে তৈরি করেন। বর্তমানে পৌরোহিত্য করছেন শ্রী হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য্য।
বলা যেতে পারে ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে আজও আদি মা'র পুজো হয়। এই আদি মায়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল চন্দননগরের পুজোতে প্রতিমার ডানদিকে মায়ের হাতি থাকে কিন্তু আদি মায়ের প্রতিমার বামদিকে হাতি অবস্থান করেন। মাকে রাজবেশে সজ্জিত করা হয় এই সময়।
আদি মায়ের কাছে বহু ভক্তই পুজো প্রদান করেন কিন্তু মায়ের পুজোর প্রথম সংকল্প হয় ইঁন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর নামে, যিনি এই মায়ের পুজোর প্রচলন করেছিলেন। গতবছর আদি মায়ের কাছে ভক্তদের প্রদান করা ফলের পরিমান ছিল ২ক্যুইন্টাল, সেই নিবেদিত ফল আদি মা পুজো কমিটির সদস্যরা চন্দননগর হাসপাতালে প্রদান করেছিলেন। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিনদিনই মায়ের মন্দির থেকে ভক্তদের ভোগ বিতরণ করা হয়। নবমীর দিন প্রায় সাত হাজার মানুষকে ভোগ বিতরণ করা হয়। মায়ের ভোগ সম্পূর্ণ নিরামিষ হয়। ভোগে থাকে পোলাও, খিচুড়ি, ভাজা, তরকারি, পায়েস ইত্যাদি। গতবছর ভক্তদের জন্য ৭০০কিলো চালের পোলাও তৈরি হয়েছিল, বহু ভক্তবৃন্দ মায়ের সেই প্রসাদ পাওয়ার অপেক্ষায় থাকেন সারাবছর। পশুবলি ছাড়াও কলাবলিদান, চালকুমড়ো বলিদানও হয় তিনদিনই। মায়ের যে ভোগ নিবেদন করা হয় সেই ভোগ সর্বপ্রথম ইঁন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর পরিবারে প্রদান করা হয় বর্তমান প্রজন্মের কাছে।
দশমীর দিন মায়ের নিরঞ্জনের আগে আদি মা'কে নিয়ে সম্পূর্ণ চন্দননগর প্রদক্ষিণ করা হয়। চন্দননগর কেন্দ্রীয় পুজো কমিটির দুইটি নিরঞ্জনঘাট আছে যেখানে প্রতিটি প্রতিমা বিসর্জন হয় কিন্তু একমাত্র আদি মা'র বিসর্জন হয় মাঝেরঘাটে, এই নিরঞ্জনঘাটে একমাত্র আদি মা'র বিসর্জন হয়ে থাকে।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- শ্রী চন্দন ঘোষ
তথ্যসূত্র সংগ্রহেঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment