ঐতিহ্যে বনেদীয়ানাঃ
বহুদিন ধরেই বনেদীয়ানাতে ধারাবাহিকভাবে চলেছে দুর্গাপুজো, কালীপুজো, জগদ্ধাত্রীপুজো ও রাস উৎসব নিয়ে পর্বালোচনা। এবার বনেদীয়ানা'র গন্তব্য বাংলার প্রাচীন মন্দিরের ইতিহাস লিপিবদ্ধকরণ। আজ আমরা এমন এক মন্দিরের কথা উল্লেখ করবো যা বহু মানুষের কাছেই অজানা। এই পর্বের আলোচনা করতে ও ইতিহাস সংগ্রহ করতে যিনি সাহায্য করেছেন তিনি হলেন শ্রী ইন্দ্রনাথ হাজরা, ধন্যবাদ আপনাকে। আজ আমরা প্রকাশ করলাম শান্তিপুরের গ্রামীণ সৌন্দর্যের মধ্যে অন্যতম বাগদেবী মন্দিরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। লিপিবদ্ধ করলেন শুভদীপ।
শান্তিপুরের গ্রামীণ বাগদেবী মন্দিরঃ- বাগআঁচড়া
বনেদীয়ানা পরিবার আয়োজন করতে চলেছে এক ঐতিহ্যসভার। তার আগেই শুরু প্রাচীন মন্দিরের ইতিহাস নিয়ে পর্বালোচনা।
সুপ্রাচীন শহর এই শান্তিপুর। শান্তিপুর শহরের কাছাকাছি গ্রামগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- বাগআঁচড়া, বাবলা, চাঁদরা, হরিপুর, গয়েশপুর, বাথনা ইত্যাদি। গ্রামগুলি যেমন প্রাকৃতিক সুষমায় সমৃদ্ধ তেমনিই এখানে ইতিহাসের বহু প্রাচীন উপাদানও বিদ্যমান।
শান্তিপুর শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে সুপ্রাচীন এই গ্রামটি মাটির রাস্তা থেকে পাকা রাস্তায় উন্নীত। টোটো বা যে কোন গাড়িতে যাওয়া যেতে পারে এই বাগআঁচড়া গ্রাম। এই বাগআঁচড়া গ্রাম শান্তিপুরের এক প্রাচীন বর্ধিষ্ণু গ্রাম। একসময় গঙ্গানদী শান্তিপুরকে ত্রিধারায় বেষ্টিত করে রেখেছিল, তার একটি ধারা প্রবাহিত ছিল বাগআঁচড়া গ্রাম দিয়ে। কালের বিধ্বংসী স্রোতে গঙ্গা আজ একমুখী। এই গ্রামের সারাবছর ভালো চাষ হলেও বর্ষায় সেই খাতে জল জমে শীর্ণ নদীর চেহারা নেয়। চারদিকে সবুজ গাছের গালিচা বিছানো এই গ্রাম জুড়ে রয়েছে তাই গঙ্গানদীর অকৃপণ দান। শীতকালে সরষে ক্ষেত এই গ্রামের এক অপরূপ শোভা।
এই বাগআঁচড়া গ্রামেই আছে প্রাচীন বাগদেবীর মন্দির। কথিত আছে কয়েকশো বছর আগে রঘুনন্দন বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক সিদ্ধপুরুষ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গঙ্গার অপর পাড় কালনার গঙ্গাতীরে এক বনপ্রান্তে রঘুনন্দনের নিজস্ব আশ্রম ছিল। সেখানে তিনি শ্যামরাই নামে এক দারুমূর্তির সেবাকার্য করতেন। জনশ্রুতি অনুযায়ী, রঘুনন্দন দিনের বেলায় বৈষ্ণবোরিচ কৃষ্ণসাধনা করলেও রাত্রে শক্তিসাধনা করতেন। শোনা যায় জঙ্গলাকীর্ণ এই জায়গায় পঞ্চমূণ্ডির আসন স্থাপন করে তিনি এখানে তন্ত্রসাধনা করতেন। তিনটি প্রস্তরখণ্ডে দেবী চণ্ডীর আরাধনা করতেন। এছাড়া আরও একটি প্রস্তরখণ্ডে পঞ্চাননের সেবা করতেন। সাধক রঘুনন্দন ১৫৪৫ খ্রী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মধ্যবয়সে বাগদেবীমাতা এবং শ্যামরাই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।জনশ্রুতি অনুযায়ী অতীতে এই অঞ্চলে বাঘের আনাগোনা ছিল, তাই অঞ্চলের দেবী হলেন বাঘদেবী বর্তমানে সেই দেবীই বাগদেবী নামে পরিচিত। বাগদেবী অর্থাৎ ব্যাঘ্র বাহিনী দুর্গা আবার অনেকের মতে দেবী সতীর বাগযন্ত্র ওই স্থানে পরে, তাই নাম বাগদেবী মন্দির। তবে মন্দির কবে প্রতিষ্ঠা হয় সেই নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। ফাল্গুনমাসের শনিবার অথবা মঙ্গলবারে বহু ভক্তসমাগম ঘটে এই মন্দিরে। ভক্তবৃন্দ মন্দিরে এসে প্রসাদ গ্রহণও করেন।
বাগআঁচড়ার এখানে ১৫৮৭ শকাব্দে চাঁদ রায় কয়েকটি শিবমন্দির নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু জনশ্রুতি অনুযায়ী, পরবর্তীকালে কোন এক সাধুর অভিশাপে নাকে মন্দিরগুলি ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে তা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে এমনকি শিবলিঙ্গগুলিরও কোন হদিশ নেই। সেইসময়ের বর্ধিষ্ণু জনপদ এই বাগআঁচড়াতে অনেক বিখ্যাত মানুষের বসবাস ছিল। বিখ্যাত লেখক কবি চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বাগআঁচড়ার বাসিন্দা। তিনি রঘুনন্দনের উত্তরপুরুষ ছিলেন। তাঁর রচিত বইয়ের মধ্যে 'সিদ্ধাশ্রম','কীর্তিকথা','বন্দনা' ইত্যাদি অন্যতম। এই বাগদেবীর মন্দিরে অতীতে পশুবলিপ্রথা থাকলেও ২০১৭ সালে সেই পশুবলিপ্রথা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী এই বাগআঁচড়া গ্রামের বাগদেবীর মন্দির।
তথ্যসূত্র ও চিত্রঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment