Wednesday, November 13, 2019

ঐতিহ্যের শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর জীউঃ- খড়দহ


ঐতিহ্যের রাস উৎসবপর্বঃ- 
শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর জীউ

রাস উৎসব উপলক্ষে বনেদীয়ানা' বিশেষ নিবেদন গতপর্ব থেকেই শুরু হয়েছে আমরা চেষ্টা করছি রাস উৎসবের কিছু পর্বালোচনা করার আজ প্রকাশিত হল খড়দহের শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর জীউ এর ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা লিখলেন শুভদীপ রায় চৌধুরী সাহায্য করলেন নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর চতুর্দশ বংশধর শ্রী সরোজেন্দ্রমোহন গোস্বামী এবং শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর জীউ ট্রাস্টি বোর্ডের কোষাধ্যক্ষ শ্রী দেবমাল্য গোস্বামী মহাশয় চলুন দেখা যাক শ্যামসুন্দর মন্দিরের ইতিহাস

ঐতিহ্যের শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর জীউঃ- খড়দহ 

১৩৯৫ শকাব্দে(ইং ১৪৭৩খ্রীঃ) মাঘ মাসের শুক্লা ত্রয়োদশীতে মধ্যাহ্নে বীরভূমের একচক্রা গ্রামে নিত্যানন্দপ্রভু আবির্ভূত হন পিতা হাড়াই পণ্ডিত মা পদ্মা দেবী বাল্যকালে নাম ছিল, অনেকের মতে চিদানন্দ হঠাৎ একদিন নিত্যানন্দপ্রভুর গৃহে এসে হাড়াই পণ্ডিতের আতিথ্য নিলেন আতিথ্য নিয়ে ফেরার পথে হাড়াই পণ্ডিতকে বলেন,'আমার সঙ্গে কোন ব্রাহ্মণ নেই আপনার বড় ছেলেটিকে দিন, আমার সে সঙ্গী হবে' প্রতিজ্ঞা করেছিলেন অতিথিকে বিমুখ করবেন না নিত্যানন্দের হাত ধরে সন্ন্যাসী পথে বেরিয়ে পড়লেন সেই সন্ন্যাসীর কে? প্রেমবিলাসে নাম পাওয়া যাচ্ছে "ঈশ্বরপুরী" অভিধায় শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী যে নিয়ে যান নিত্যানন্দকে একচক্রা হতে, একথা মধ্যযুগীয় তথ্য ইতিহাসময় গ্রন্থ "প্রেমবিলাসে" পাওয়া যায়
বক্রেশ্বর থেকে বৈদ্যনাথ, তারপর গয়া হয়ে কাশী, শিব-রাজধানী সেখান থেকে প্রয়াগ, মথুরা, বৃন্দাবন হয়ে হস্তিনাপুর তারপর প্রভাস, দ্বারকা, গোমতী অতিক্রম করে হরিদ্বার বিশ বছর পর্যটন করে নবদ্বীপে এলেন নিত্যানন্দ নিত্যানন্দকে একদিন গৌরসুন্দর নিজের হাতে চন্দনে-মাল্যে সাজালেন স্তব করতে লাগলেন 'নামে নিত্যানন্দ তুমি, রূপে নিত্যানন্দ স্তব শেষে বললেন, তোমার একখানা কৌপীন আমাকে দাও কৌপীন পেয়ে তাকে টুকরো টুকরো করলেন, ভক্তদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন, বললেন, এই পবিত্র বস্ত্রখণ্ড মাথায় বাঁধো, কৃষ্ণ দাস হয়ে যাও তারপর আদেশ করলেন, নিত্যানন্দ, হরিদাস ঘরে ঘরে গিয়ে কৃষ্ণ নাম ভিক্ষা করো  
কাটোয়ায় গিয়ে কেশব ভারতীয় কাছে গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস নিলেন তখন তাঁর বয়স ২৪বৎসব আর নিত্যানন্দের ৩৬বৎসর গৌরহরি শেষ পর্যন্ত শান্তিপুরে অদ্বৈতাচার্যের ঘরে গিয়ে উঠলেন গৌর বললেন নিত্যনন্দ, সংকীর্ত্তন, প্রেম রসে সর্ব দেশ প্লাবিত কর নাম, প্রেমে বিশ্ব ভরে দেব বলেই তোমার নাম বিশ্বম্ভর প্রাণ গৌরের আদেশ পেয়ে নিত্যানন্দ চললেন গৌড়দেশে  নিত্যানন্দপ্রভু, মহাপ্রভুর ইচ্ছাপুরণের জন্য বসুধা-জাহ্নবাকে বিয়ে করেন খড়দহে এসে বসবাস করেন পরম পরমহংস শ্রীনিত্যান্দের খড়দহে বসবাসের জন্যই অনেক মনিষী খড়দহে আসেন উত্তর ২৪পরগণা জেলার খড়দহ শুধুমাত্র বৈষ্ণব পীঠস্থানই নয়, বাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক জীবন ধারার অন্যতম কেন্দ্রস্থল
 শ্রী নিত্যানন্দ মহাপ্রভু খড়দহে এসে পুরন্দর পণ্ডিতের বাসগৃহে বসবাস করেন এই বাসগৃহ প্রাঙ্গণে তুলসী, চাঁপাফুল, কদমফুল, নানান রকমের করবী, দোপাটি, কেষ্টকলি, টগরফুলের গাছ ছিল তাই স্থানটির পরবর্তী নাম "কুঞ্জবাটী" খড়দহের শ্যামসুন্দর জীউ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর পুত্র বীরভদ্র গোস্বামী, আনুমানিক ১৫৭৫ খ্রীঃ পরবর্তীকালে নিত্যানন্দপ্রভুর স্ত্রী তথা বীরভদ্র গোস্বামীর মাতা জাহ্নবা প্রতিষ্ঠি করেছিলেন রাধারানী শ্যামসুন্দরের পাশেই কারণ জাহ্নবাদেবী বৃন্দাবনে গিয়ে গোপীনাথের রাধারাণিকে দেখে তার উচ্চতা একটু বেশী হলেই ভালো হত বলে মনে করেন তাই তিনি গৌড়দেশে ফিরে নয়ন ভাস্করকে দিয়ে রাধারাণি তৈরি করেছিলেন বৃন্দাবনে পাঠাবার জন্য একটি শ্যামসুন্দরের জন্যও রাধারাণী তৈরি করেছিলেন
শ্রীশ্রীরাধামদনমোহন জীউ

রাস উৎসব প্রথম শুরু হয় কুঞ্জবাটীতে এটাই শ্যামসুন্দরের প্রাচীন মন্দির এটিই নিত্যানন্দপ্রভুর বাসস্থান ছিল পরবর্তীকালে পুরাতন রাসখোলায় শ্মশান ঘাটের কাছে একটি রাসমন্দির তৈরি করে বিগ্রহ নিয়ে যাওয়া হত পরবর্তীকালে যেহেতু শ্মশানের জায়গা কম, প্রতিনিয়ত শবদাহ করা হত তাই ওখান থেকে সরিয়ে রাসখোলার গঙ্গার ঘাটের পূর্বদিকে গঙ্গাতীরে অষ্টকোনাকৃতি তিন স্তরের একটি অপূর্ব রাসমন্দির তৈরি করা হয় আগে যেখানে রাস উৎসব হত সেটি পুরাতন রাসখোলা নামে পরিচিত আর বর্তমানে রাস মন্দিরটি নতুন রাসখোলা নামে খ্যাত বলাবাহুল্য শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দরের রাস বঙ্গের রাস উৎসবের মধ্যে ভিন্ন রাস উৎসব
নিত্য শ্যামসুন্দরের সকালে সাজসজ্জা হয়, তারপর হয় বাল্যভোগ, তারপর মধ্যাহ্নে ভোগ নিবেদন হয় তারপর বিগ্রহের শয়ন হয় তারপর সন্ধ্যায় সন্ধ্যারতি হয়রাত্রিবেলা ভোগ নিবেদন হয়ে গেলে শ্যামসুন্দরের সেই দিনের পূজা সমাপ্ত হয়- এই ভাবেই নিত্য সেবাপূজা হয়ে আসছে খড়দহের শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর মন্দিরে প্রসঙ্গত মেজবাড়ির গোস্বামী বাটীর নিজেস্ব একটি মন্দির আছে যেখানে শ্রীশ্রীগোপীনাথ জীউ রয়েছেন তাঁরও নিত্য সেবাপূজা হয় প্রাচীন রীতি মেনেই গোপীনাথ জীউেরও রাস উৎসব হয় তিন দিনের বিশেষ সাজসজ্জা হয় প্রথম দিন নটবর বেশ, দ্বিতীয় দিন হয় রাজবেশ তৃতীয়দিন হয় রাখালবেশ ঠাকুর রাসমঞ্চে যান চতুর্দোলা করে আর পরের দিন ভোরের আরতির পর ঠাকুর যখন নিজমন্দিরে ফিরে আসেন তখন পালকি করে ফেরেন রাখালবেশ অর্থাৎ তৃতীয়দিনের পর ঠাকুর নিজমন্দিরে আসেন চতুর্থদিনের দুপুরবেলায়, কারণ সকলার মঙ্গলারতির পর বহু ভক্তসমাগম হয় রাসমন্দিরে সেখানে বিশেষ পূজাপাঠ হয় তারপর দুপুরে ঠাকুর তাঁর শ্রীমন্দিরে ফেরার সময় প্রতিটি গোস্বামী বাড়িতেই তাঁর জন্য পূজাপাঠ ভোগ নিবেদনের ব্যবস্থা করা হয়
 তারপর শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর মন্দিরে ফিরে এলে সেখানে হয় বিরাটভোগ উৎসব, অর্থাৎ খিচুড়ি তৈরি হয় আনুমানিক ১৫-১৬ ক্যুইন্টাল পরিমাণের এই রাস উৎসবে শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দরের সাথে যিনি রাসমঞ্চে যান তিনি হলেন চতুর্দশ চক্র বিশিষ্ট অনন্তদেব নিত্যানন্দপ্রভুর পূর্বপুরুষেরা শাক্ত ছিলেন, কনৌজ থেকে ক্ষিতিষ এসেছিলেন শাণ্ডিল্য গোত্রীয় তাঁদের প্রথম পুরুষ হলেন ভট্টনারায়ণ চতুর্বেদী, দশমপুরুষ হলেন মহেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, উনিশতম পুরুষ বিশকেতু ছিলেন তান্ত্রিক তাঁরই পূজিত ছিলেন ত্রিপুরাসুন্দরী যন্ত্র নীলকণ্ঠশিব তাঁর পুত্র অর্থাৎ বিংশতম পুরুষ চন্দ্রকেতু ছিলেন পরম বৈষ্ণব এই বিংশতম পুরুষের সময় থেকেই এই পরিবারে আছেন চতুর্দশ চক্র বিশিষ্ট অনন্তদেব শালগ্রামশিলা

সেই বংশরেই কুলতিলক হাড়াই পণ্ডিতের পুত্র নিত্যানন্দপ্রভু পুরন্দর পণ্ডিত প্রদান করেছিলেন ছাব্বিশ বিঘা জমি নিত্যানন্দপ্রভুকে এই ছাব্বিশ বিঘা জমির ওপরে নিত্যানন্দপ্রভুর বংশধরগণ আজও বর্তমান এই গোস্বামী বাটীর শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর জীউ গোপীনাথ জীউ ছাড়াও একটি বিগ্রহ রয়েছেন সেটি হল শ্রীশ্রীরাধামদনমোহন জীউ তাঁরও রাস উৎসব পালিত হয় এই রাসের সময় গোস্বামী বাটীর সকল সদস্য এবং অগণিত ভক্তগন কীর্তন করে ওঠেন যা খড়দহ ঘরানা নামে খ্যাত ঠাকুর চতুর্দোলায় ওঠার সময় গাওয়া হয়-"মনোচোরা ওই দেখ ব্রজগোপী", এছাড়াও গাওয়া হয়-"ওই কালো পূর্ণশশী, চল্ না মোরা দেখে আসি"রাসমঞ্চে গাওয়া হয়-"মুখে মৃদু মৃদু হাসি, রাসলি কুঞ্জে বসি" এইভাবে আভিজাত্য ধারাবাহিকতাকে অক্ষুণ্ণ রেখে আজও পুজো হয়ে আসছে শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর জীউ সহ গোস্বামী বাটীর সকল যুগলমূর্তির 
গোপীনাথ জীউ

 বনেদীর-বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে নিত্যানন্দপ্রভুর সকল সদস্যবৃন্দ, শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর জীউ ট্রাস্টি বোর্ডের সকল সদস্যদের অগণিত ভক্তদের জানাই রাস উৎসবের শুভেচ্ছা অভিনন্দন

কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ- শ্রী সরোজেন্দ্রমোহন গোস্বামী(নিত্যানন্দপ্রভুর চতুর্দশ বংশধর), শ্রী দেবমাল্য গোস্বামী(শ্রীশ্রীরাধাশ্যামসুন্দর জীউ ট্রাস্টি বোর্ডের কোষাধ্যক্ষ) এবং শ্রী অরিন্দম ভট্টাচার্য্য 
তথ্যসূত্র লিপিবদ্ধে চিত্রঝণঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী



No comments:

Post a Comment