ঐতিহ্যের রাস উৎসবপর্বঃ- ৫
আজ প্রকাশিত হল শান্তিপুরের রাস উৎসবের পুরোধা বড় গোস্বামী বাড়ির শ্রীশ্রীরাধারমণের রাস উৎসবের ইতিহাস। শান্তিপুরের ভাঙারাসের শোভাযাত্রা দেখার জন্য বহু ভক্তসমাগম হয় এই শ্রীধাম শান্তিপুরে। বড় গোস্বামী বাড়ির রাস উৎসবের কাহিনী লিখলেন শুভদীপ। চলুন দেখা যাক সেই ইতিহাস।
ঐতিহ্যের শ্রীশ্রীরাধারমণঃ- শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাটী
শ্রীঅদ্বৈত পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর বড় পুত্র রাঘবেন্দ্র থেকে এই বাড়ির সৃষ্টি। কথিত আছে ঈশ্বর দর্শনের উদ্দেশ্যে ভারত ভ্রমণে বেড়িয়ে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য নেপালের গণ্ডকী নদী থেকে একটি নারায়ণ শিলা প্রাপ্ত হন। সেই শিলা তিনি শান্তিপুরে নিজ বাড়িতে এনে পূজা করতেন। আচার্যদেবের সেই নারায়ণ শিলা আজও নিত্য পূজিত হন বড় গোস্বামী বাটীতে। এই বাড়ির প্রধান দেবতা কষ্টিপাথরের শ্রীশ্রীরাধারমণ জীউ।
এই মূর্তি আগে পুরীতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের আমলে দোলগোবিন্দ নামে পূজিত হতেন। পরবর্তীকালে বারোভুঁইয়া পরিবারের বসন্ত রায় তাঁকে যশোরে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ১৫৯২ খ্রীঃ মানসিংহ বাংলা আক্রমণ করলে মূর্তির পবিত্রতা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বসন্ত রায়ের পরিবার এই কৃষ্ণমূর্তি তুলে দেন তাঁদের গুরুদেব অদ্বৈতপৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর হাতে। মথুরেশ গোস্বামী সেই মূর্তি নিয়ে এসে নিজের শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীশ্রীরাধারমণ জীউ নামে। সেই থেকে ৪২৬বছর ধরে শ্রীশ্রীরাধারমণ পূজিত হচ্ছেন বড় গোস্বামী বাড়িতে। পরবর্তীকালে রাধারমণ বিগ্রহের সাথে যুক্ত হয়েছেন শ্রীমতী। এছাড়াও বাড়িতে রয়েছেন সুপ্রাচীন মদনমোহন-শ্রীমতী মূর্তি। এছাড়াও আছেন শ্রীশ্রীরাধাবল্লভ-শ্রীমতী, শ্রীশ্রীগোপালরায়-শ্রীমতী ও শ্রীশ্রীবিশ্বমোহন-শ্রীমতী বিগ্রহ। রয়েছেন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা এবং রামচন্দ্রের দারুমূর্তি। এছাড়া বড় গোস্বামী বাড়িতে রয়েছেন শান্তিপুরের একমাত্র ষড়ভুজ মহাপ্রভু মূর্তি, শ্রীঅদ্বৈতাচার্য, সীতাদেবী ও পুত্র অচ্যুতানন্দের দারুমূর্তি ও কষ্টিপাথরের শিবমূর্তি।
শ্রীশ্রীরাধারমণকে নিয়ে বেশ আনন্দে কাটছিল, এমন সময় হঠাৎ ছন্দপতন হলো, বড় গোস্বামী বাটীর মন্দির থেকে অপহৃত হলেন শ্রীশ্রীরাধারমণ বিগ্রহন। তখন তাঁদের বাড়ির সদস্যদের চিন্তার পর প্রভুদের মাথায় এলো যে শ্রীধাম বৃন্দাবনে গোপীরা "কাত্যায়নীব্রত" করে লীলাপুরুষোত্তমকে পেয়েছিলেন, সুতরাং আমরাও কাত্যায়নী পুজো করবো শ্রীশ্রীরাধারমণকে পাওয়ার জন্য। চিন্তানুযায়ী শারদীয়া দুর্গাপুজোর সময় শ্রীশ্রীকাত্যায়নী মাতার পুজো শুরু হল। মায়ের কাছে হত্যে দিয়ে থেকে তৃতীয় দিনে স্বপ্নাদিষ্ট হলেন যে দিগন-গরে একটি জলাশয়ে তোমাদের ইষ্টদেবকে ফেলে রাখা হয়েছে। নির্দিষ্ট জলাশয়ের থেকে রাধারমণকে উদ্ধার করে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হল। শান্তিপুরবাসীকে দর্শন দিয়ে ধন্য করবার জন্য যুগল বিগ্রহকে বরকন্যারূপে নানালঙ্কারে সজ্জিত করে সারা শান্তিপুর শোভাযাত্রা করে ঘোরানো হয় রাধারমণের পাশে রাধারানীকে প্রতিষ্ঠা করা হয় রাস উৎসবের সময় এবং এই শোভাযাত্রা সৃষ্টি করে বিখ্যাত ভাঙারাস উৎসব। রাধারমণ ও শ্রীরাধিকার বরবেশের শোভাযাত্রার পেছনে বরযাত্রী রূপী শান্তিপুরের সকল পূজিত যুগল বিগ্রহ সুসজ্জিত হয়ে অংশ নেন, এই অনুষ্ঠানটি সম্পূর্ণ সংগঠিত করেন খাঁ চৌধুরী বাড়ি (খাঁ চৌধুরীরা হলেন বড় গোস্বামী বাটীর শিষ্য)। ভাঙারাসের পরের দিন বড় গোস্বামী বাড়ির সব যুগল বিগ্রহকে নানালঙ্কারে সজ্জিত করে অনুষ্ঠিত হয় "কুঞ্জভঙ্গ" বা ঠাকুর নাচ। এই অনুষ্ঠানটি খুবই মনোরম এবং অনুষ্ঠান শেষে সকল বিগ্রহকে অভিষেক করে মন্দিরে প্রবেশ করানো হয়।
এছাড়া এই বড় গোস্বামী বাড়িতে শ্রীশ্রীরাধারমণ জীউএর জামাই ষষ্ঠী পালিত হয়, এছাড়া শ্রীশ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের প্রথম পুত্র অচ্যুতানন্দের জন্মতিথি পালিত হয়। ঝুলনযাত্রা অনুষ্ঠানে শ্রীশ্রীরাধারমণ জীউ ও আরও যুগল বিগ্রহদের সুসজ্জিত করে ঝুলনে তোলা হয়। বৈশাখ মাসের বৈশাখী পূর্ণিমায় শ্রীশ্রীরাধারমণের ফুলদোল ও বনভোজন অনুষ্ঠান সাড়ম্বরে পালিত হয়।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী এই শান্তিপুর। যেখানে শাক্ত ও বৈষ্ণবদের মেলবন্ধন দেখা যায়। সেই শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ির ঐতিহ্য যা আজও বাংলার ইতিহাস ও ধারাবাহিকতার চিহ্নযুক্ত। বড় গোস্বামী বাটীর সকল সদস্যবৃন্দকে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
বড়
গোস্বামী বাটীর দুই সদস্যকে বনেদীয়ানা পরিবারের পক্ষথেকে অনেক অভিনন্দন জানাই তারা সাহায্য করেছেন ইতিহাস লিপিবদ্ধে। কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ শ্রী সত্যনারায়ণ গোস্বামী মহাশয় এবং শ্রী দেবজিৎ গোস্বামী
তথ্যসূত্র সংগ্রহেঃ- শুভদীপ রায় চৌধুরী
No comments:
Post a Comment