আজ আলোচনায় মহিষাদল রাজবাড়ির রথযাত্রা ও দুর্গাপুজো।
লিখলেন শ্রীমান্ শঙ্খ। বনেদীয়ানা
পরিবারের অভিনবত্ব এখানেই যে তারা
অনন্য ইতিহাসের সন্ধান করে চলেছে।
মহিষাদল
রাজবাড়ীর রথযাত্রা ও দুর্গাপূজা।
পূর্ব মেদিনীপুর।
জন্মসূত্রে
আমরা রথের দেশের মানুষ। তাই
রথের প্রসঙ্গ আসলেই ভিতরটা কেমন
নেচে ওঠে। আমাদের
জীবনচক্রও এই রথের চাকার
মতো এক অদৃশ্য রজ্জুর
টানে ঘুরতে থাকে।
কিন্তু, কোথায় যে সেই
রজ্জু, আর কে'ইবা
সেই রজ্জুতে টান মারছেন সেটা
খুঁজতে খুঁজতেই জীবনপাত.... যখন তিনকাল এসে
এককালে ঠেকে, তখন উপলব্ধি
আসে, রবিকবির সেই বিখ্যাত পঙক্তি.....
"রথ
ভাবে আমি দেব, পথ
ভাবে আমি;
মূর্তি
ভাবে আমি দেব, হাসেন
অন্তর্যামী।"
যখন নিয়মিত বই পড়ার
অভ্যাস ছিলো, তখন মাঝেমধ্যেই
স্কুল/কলেজের সিলেবাসের বইয়ের
নীচে গল্পের বই রেখে
দেওয়ার বদঅভ্যেসও ছিলো। অসংখ্যবার
ধরা পড়েছি মায়ের কাছে,
মারও খেয়েছি..... কিন্তু, স্বভাবটা পাল্টাতে পারিনি। যাইহোক,
একবার এরকমই কোনো এক
পত্রিকায় বাংলার রথযাত্রা বিষয়ক
একটি সংখ্যায়, বিভিন্ন জায়গার বিভিন্ন ঐতিহ্যমন্ডিত
রথযাত্রার বিষয়ে পড়েছিলাম।
যেমনঃ মাহেশে জগন্নাথের রথযাত্রা,
রাণী রাসমণি প্রবর্তিত রঘুবীরের
রথযাত্রা, রামগড়ের রাধাকৃষ্ণের রথযাত্রা, কাঁঠালীপাড়ায় সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের বাড়ীর রথযাত্রা, আমাদের
মধ্য-কোলকাতায় সুঁরি লেনে মল্লিক
বাড়ীর সোনার চূড়াবিশিষ্ট রথ
ইত্যাদি....... সঙ্গে পড়েছিলাম, মহিষাদলের
ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত রথযাত্রার কথা।
কথায় বলে, মাহেশের রথযাত্রার
পরেই নাকি মহিষাদলের রথযাত্রার
স্থান। শুধু
রথই নয়, মহিষাদল রাজপরিবারের
দুর্গোৎসবের খ্যাতিও এককালে দেশজোড়া ছিলো। রাজপরিবারের
দুর্গোৎসব আজও হয়ে আসছে। তবে,
খরচখরচার বাজারে তাতে কিছু
টান পড়েছে। অলিন্দের
কিছু পলেস্তারা খসে পড়েছে।
কিন্তু, রথযাত্রা আজও সমান প্রাণবন্ত।
ঠাকুরদা'র কাছে শুনেছিলাম,
"রথে চ বামনং দৃষ্ট্বা
পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে।"
তখন মানেটা বুঝিনি।
কিন্তু যত বড় হয়েছি
আস্তে আস্তে বুঝেছি যে,
মানুষের পারমার্থিক লক্ষ্য হলো মুক্তি। তাই
আনন্দকে উপলক্ষ্য করে "রথে দেখা, কলা
বেচা" দুই'য়ের উদ্দেশ্যেই
জগন্নাথের রথের দড়ি ধরার
এত আগ্রহ, কি প্রচণ্ড
উদ্যম..!
মহিষাদলের
রথযাত্রা মেলা আমাদের চিরাচরিত
জীবনযাত্রার যেন স্পষ্ট ও
জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। একমাস
ব্যপী চলা এই মেলায়
আজও কিছুটা হলেও গ্রাম্যভাবের
প্রতিবিম্ব খুঁজে পাওয়া যায়।
মহিষাদলের
রাজপরিবারের গৌরবোজ্জ্বল পরিচয় বা কোষাগারের
বৈভব আজ অস্তমিত, দুর্গোৎসবের
আড়ম্বর আজ কালের গ্রাসে
কিন্তু মহাকালের সর্বগ্রাসী নজরকে যেন তর্জনীনির্দেশ
করে মহিষাদল রাজপরিবারের কুলদেবতা আজও বৎসরান্তে একদিনের
জন্য অন্দমহল ছেড়ে স্বমহিমায় রাজপথে
বেড়িয়ে আসনে। তখন
সেই দৃশ্য কবিগুরুর কথা
মনে করিয়ে দেয়....."উড়িয়ে
ধ্বজা অভ্রভেদী রথে, ঐ যে
তিনি ঐ যে বাহির
পথে..."
মহিষাদলের
জমিদারী একসময়ে অবিভক্ত মেদিনীপুর
জেলার সবচেয়ে বড় জমিদারী
ছিলো। জনার্দ্দন
উপাধ্যায় ছিলেন তার প্রতিষ্ঠাতা। জাতিতে
সামবেদীয় কনৌজদেশীয় ব্রাহ্মণ, আনুমানিক ষোড়শ শতকের প্রথমদিকে
উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে
ব্যাবসায়ীক সূত্রে এখানে আসেন। তখন
এখানকার জমিদার ছিলেন কল্যান
রায়চৌধুরী(রায়চৌধুরী জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা
বীরনারায়ণ রায়চৌধুরীর অধঃস্তন ষষ্ঠপুরুষ)। কল্যান
রায়চৌধুরী, জমিদারী থেকে খাজনা আদায়ের
কাজে অসমর্থ হওয়ায় জনার্দ্দনের
সাহায্য চা'ন।
তার সুদক্ষ পরিচালনায় খাজনা
আদায়ের কাজ সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে
জনার্দ্দন'ই জমিদারীর আসনে
বসেন। প্রথমথেকেই
এনারা বড় এবং শক্তিশালী
জমিদারবংশ রূপেই বিবেচিত হতেন। রাজা
উপাধিতে ভূষিত হ'ন
তৎকালীন শাসক জ্যাতিপ্রসাদ গর্গ,
আনুমানিক ১৮৯০ সালে।
প্রথমদিকে এঁদের রাজধানী ছিলো
রঙ্গীবসানে। পরে
তা গড়কমলপুরে স্থানান্তরিত হয় এবং এখনও
সেখানেই আছে। যদিও
জমিদারী বা রাজত্ব... আজ
আর কিছুই অবশিষ্ট নেই,
আছে শুধু "মহিষাদল রাজপরিবার দেবোত্তর এস্টেট"। ১৯৫৬
খ্রীস্টাব্দে জমিদারী বা রাজত্ব প্রথা
উঠে যাওয়ার পর থেকে
যতটুকু যা জমিজমা পরিবারের
অধীনে থেকে যায়, তা
থেকেই আজ কুলদেবতা শ্রী
মদনগোপাল জিউয়ের নিত্যসেবা, রথযাত্রা
ও শারদীয়া দুর্গোৎসবের যাবতীয় খরচ নির্বাহ
হয়ে আসছে।
যাইহোক,
এবারে পূজোর ইতিহাসে আসা
যাক। ১৭৬৯
খ্রীস্টাব্দে তৎকালীন জমিদার আনন্দলাল উপাধ্যায়
স্বর্গারোহণ করেন৷ তখন তাঁর
নিঃসন্তান বিধবা পত্নী জানকী
দেবী, এক আত্মীয়ের পুত্র
মোতিলাল গর্গ'কে দত্তক
নে'ন। তাঁর
প্রথম কীর্তি, ১৭৭৪ সালে কুলদেবতা
শ্রী মদনগোপালের মন্দির প্রতিষ্ঠা ও
বিগ্রহ স্থাপন। ১৭৭৬
সাল নাগাদ কয়েকজন শ্রীক্ষেত্র
ফেরৎ প্রজার একান্ত অনুরোধে
জানকী দেবী রথযাত্রার সূচনা
করেন। রাজেরিবারের
কুলদেবতা শ্রী মদনগোপাল জিউয়ের
রথযাত্রার সেই থেকেই সূচনা
হয়। প্রথম
থেকেই রথযাত্রা উপলক্ষ্যে একমাস ব্যাপী মেলা
বাউল, কথকতা, কবিগান ইত্যাদির
আসর বসতো। মেলায়
আগত সকলের ভরনপোষণের ব্যয়ভার
রাজপরিবারের তরফ থেকেই সমাধা
হ'তো।
এখানকার
রথের একটিই বৈশিষ্ট্য যে,
রথে আসীন হ'ন
শ্রীকৃষ্ণ, সঙ্গে পরিবারিক শালগ্রাম
শ্রী লক্ষ্মীজনার্দন জিউ। জগন্নাথ,
সুভদ্রা, বলরাম ন'ন। ঠিক
যেমনটা হয়, ধামরাইয়ের যশোমাধবের
রথে। পুরী
বা মাহেশের মতো এখানেও ছাপ্পান্ন
ভোগ নিবেদনের নিয়ম আছে।
আগে বিপুল পরিমাণে ভোগ
প্রস্তুত করে তা জনসাধারণের
মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হতো। এখন
স্বল্প পরিমাণেই ভোগের আয়োজন করা
হয়। এখানকার
রথটি চূড়াসমেত প্রায় পঁচাত্তর(৭৫)
ফিটের কাছাকাছি। রথের
গঠনশৈলী, রত্নঘরানার। এটি
মোট ত্রয়োদশ(১৩) রত্নবিশিষ্ট রথ। চূড়ায়,
পিতলের কলসী, ধ্বজা রয়েছে। রথের
চাকার সংখ্যা ৩৬টি।
জানকী দেবীর প্রতিষ্ঠিত রথ
পরবর্তীকালে অগ্নিদগ্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজা
দেবপ্রসাদ গর্গ, নতুন করে
রথ নির্মাণ করিয়ে দেন।
রথের দিন সকাল থেকেই
পূজোর প্রস্তুতি তুঙ্গে। সকালে
রাজপরিবারের কোনো সদস্য এসে
রথের চাকা ধুয়ে, রাস্তা
ঝাঁট দিয়ে যান।
দুপুর-বিকাল নাগাদ রথের
রশিতে টান পড়ে।
হাজার হাজার পুণ্যার্থীর হরিধ্বনি,
খোল-করতাল, জগঝম্পের মিলিত
তরঙ্গে রাজপথ ধরে রথ
এগিয়ে চলে.....!
এরও পরে, ১৭৭৮ খ্রীস্টাব্দে
এই জমিদারবংশে(তখনও 'রাজা' হননি)
তৎকালীন শাসক জানকী দেবীর
তত্বাবধানেই দুর্গোৎসবের সূচনা হয়।
এখানে পূজো শুরু হয়
শারদীয়া শুক্ল-প্রতিপদ তিথি
থেকে। সাবেকী
আটচালায়, চিরাচরিত বঙ্গীয় ঘরানার অতসীপুষ্পবর্ণা
প্রতিমা। প্রথা
মেনে, মদনগোপালের রথের দড়িতে টান
পড়লেই দেবীর কাঠামোয় মাটির
প্রলেপ দেওয়া হয়।
আগে, তিথি অনুযায়ী চালের
নৈবেদ্য হ'তো।
যে তিথি, তত মণ
চাল। ১৯৫৩
অব্দি এভাবেই হয়ে এসেছে। এখন
আর্থিক প্রতিবন্ধকতায় বন্ধ হয়ে গেছে। আগে
পূজো চলাকালীন প্রতিদিনই চণ্ডীমঙ্গল, যাত্রা, পালাগান ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন হ'তো। এখন
স্থানীয়দের ও পরিবারবর্গের পারস্পরিক
সহযোগিতায় ছোটোখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়।
আগে সন্ধিপূজোর সূচনায় তোপধ্বনি করা
হ'তো, তা শুনেই
তমলুকের বর্গভীমা মন্দিরে সন্ধিপূজো শুরু হ'তো। এখন
ফাঁকা বন্দুকে আওয়াজ করা হয়। শাক্তমতে
পূজো হতো আগে।
নিয়মিত পশুবলিদানের প্রথাও ছিলো।
এখন তা পরিবর্তিত হয়ে,
ফলমূলাদি বলিদান হয়ে থাকে। বছর
ত্রিশেক আগেও হীজলী টাইডাল
ক্যানাল দিয়ে নৌকা করে
প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হ'তো, রূপনারায়ণে বিসর্জ্জনের
জন্য। এখন
স্থানীয় রাজগড়ের দীঘিতেই প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। আর্থিক
জৌলুশ হারিয়ে গেলেও, পরিবারবর্গ
বা স্থানীয়দের কাছে আজও এই
পূজো স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত। পূজোর
ক'দিন এলাকাবাসীদের প্রসাদ
বিতরণ, ভোগ খাওয়ানো হয়ে
থাকে। সবের
খরচাই "দেবোত্তর এস্টেট" থেকেই আসে।
'কর্তা-মা' জানকী দেবী,
১৮০৪ সাল অব্দি জমিদারীর
আসনে ছিলেন। ধর্মপ্রাণ
জমিদার-গিন্নি তাঁর শাসনকালে
মেদিনীপুর জেলায় অসংখ্য মন্দির,
ধর্মশালা, লঙ্গরখানা স্থাপন করেন।
নন্দিগ্রামের জানকিনাথ মন্দির তাঁর স্থাপিত
মন্দিরগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
তাই একবাক্যে স্বীকার করা যায়, কি
মহিষাদলের রথযাত্রা, কি দুর্গোৎসব দুই
মহোৎসবের সূচনায় জানকী দেবীর
গুরুত্ব অপরিসীম।
তথ্যসূত্র
এবং চিত্রঃ শ্রীমান্ শঙ্খ
No comments:
Post a Comment