Monday, March 25, 2019

মল্লিকবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজা(Mullick Family- Devi Singhabahini)



আজ "বনেদীর-বনেদীয়ানা" ঐতিহাসিক জগদ্ধাত্রী পূজার আলোচনা করছেন পরিবারের গুরুত্বপূর্ন সদস্যা শ্রীমতী দেবযানী বসু মহাশয়া আজ সেই পর্বে মল্লিকবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজা
 প্রাচীন বৈদিক যুগ থেকেই ভারতে শক্তিপূজার প্রচলন বহু রূপে সংস্থিতা শাক্ত দেবীর মধ্যে জগদ্ধাত্রী অন্যতমা প্রাচীন ইতিহাসে আমরা দেখি ভারতে তখন তান্ত্রিক হিন্দু ধর্মের প্রাবল্য এরপর বৌদ্ধধর্মের জোয়ারে যখন প্লাবিত হয় ভারতবর্ষ তখন হিন্দু ধর্মের শক্তিসাধনা আর বৌদ্ধধর্মে তন্ত্র সাধনার মেলবন্ধন ঘটে এই সময়েই দেবী জগদ্ধাত্রীর রূপকল্পনার সূচনা দেবী দুর্গা থেকে বিবর্তিতা হয়ে মহাশক্তির রূপান্তর সিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রীতে জগদ্ধাত্রীর যে মূর্তি বর্তমানে পূজিতা হয়ে থাকে প্রাচীনকালে সে মূর্তি ছিল কিছুটা অন্যরকম ঐতিহাসিক সেই সিংহবাহিনীর আদ্যাস্বরূপা মূর্তি আজও দেখা যায় কলকাতার মল্লিক বংশে
 কী করে এলেন এই বংশে দেবী, তা জানতে হলে তাকাতে হবে ৬০০ খ্রিঃ কাছাকাছি সময়ে সিংহবাহিনীর পূর্ব ইতিহাস যেটুকু জানা যায় তা হল, কনৌজের বৈশ্য বংশীয় রাজা হর্ষবর্ধনের জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতা রাজ্যবর্ধন দেবের কুলদেবী ছিলেন এই দেবীমাতৃকা তবে এই মূর্তি তিনিই তৈরী করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে মতভেদ আছে এর অনেক বছর পরে দেবী সিংহবাহিনীর আবির্ভাব রাজপুত রাজা মানসিংহের দেবমন্দিরে সম্ভবত মানসিংহ যুদ্ধবিগ্রহকালে এই মাতৃমূর্তি লুণ্ঠন করে রাজপুতানায় নিয়ে যান দিল্লির মসনদে তখন বাদশাহ আকবর আসীন
 মানসিংহ ছিলেন একাধারে আকবরের ভগ্নীপতি এবং সেনাপতি তাঁর রাজত্বের শেষদিকে উত্তরভারতে মোগলের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় মানসিংহের মৃত্যুর পর তাঁর মহিষী দেবীমূর্তিকে মুসলিম স্পর্শের হাত থেকে রক্ষা করার উদ্দ্যেশ্যে তাঁর পুরোহিতকে মূর্তি নিয়ে সুদূর কোন স্থানে পালিয়ে যেতে অনুরোধ করেন পুরোহিত দেবীকে নিয়ে চলে আসেন অধুনা বাংলাদেশের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে একটি গুহায় দেবীকে স্থাপন করেন আরাধনা করতে থাকেন এদিকে হুগলির আদি সপ্তগ্রাম নিবাসী বৈদ্যনাথ দে (দেব) মল্লিক ১০১৪সালে কার্যোপলক্ষে ঢাকায় যান সেখানে তিনি পূর্বপুরুষ রাজ্যবর্ধন দেবের কুলদেবী সিংহবাহিনীর অলৌকিক কাহিনী মাহাত্মের কথা জানতে পেরেছিলেন শোনামাত্র তিনি চন্দ্রনাথ পাহাড়ে গিয়ে দেবীমূর্তি দর্শন করেন অসীম ধর্মপ্রাণ ভক্তকে কাছে টেনে নেন দেবী আদি সেবক রাজ্যবর্ধনের উত্তরপুরুষ বৈদ্যনাথ দেমল্লিকের বংশে পুনরায় স্থাপিত হওয়ার ইচ্ছায় দেবী স্বপ্নাদেশ দেন পুরোহিতকে বৈদ্যবংশীয় সুবর্ণবণিক্বৈদ্যনাথ মল্লিকের হাতে বিনাদিধায় মূর্তি তুলে দেওয়ার আদেশ দেন একই সঙ্গে বৈদ্যনাথ মল্লিককেও স্বপ্নদেন তিনি এবং বলেন,"আমি তোমার ভক্তিতে পরিতুষ্ট সাধুর নিকট হইতে আমাকে তোমার আলয়ে নিয়ে গিয়ে যথাবিধি পূজার্চনার ব্যবস্থা কর" পরদিন বৈদ্যনাথ সেখানে গেলেও পুরোহিত মূর্তি দিলেন না দ্বিতীয় রাত্রে পুনরায় দেবী পুরোহিতকে স্বপ্নে বলেন," নির্জনে আমার যথাযথ পূজা হচ্ছে না আগামীকাল রাত্রি প্রভাতে বৈদ্যনাথ পুনরায় আসিবে, সেই সময় তুমি অবশ্যই আমাকে তাহার হস্তে সমর্পণ করিবে" পরদিন পুরোহিত সিংহবাহিনীকে বৈদ্যনাথের হাতে তুলে দেন পূজার আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কেও উপদেশ দেন বৈদ্যনাথ মল্লিক এরপর মূর্তি নিয়ে সপ্তগ্রামে ফিরে আসেন এবং দেবীকে সাড়ম্বরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এরপর বৈদ্যনাথের পৌত্ররা বর্গীদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলে বসবাস করেন সিংহবাহিনীরও পদার্পণ ঘটে কলকাতায় দেবীর আগমনের পর থেকে বংশপরম্পরায় তাঁরা অত্যন্ত ধনবান হয়ে ওঠেন দে-মল্লিকরা যদিও ছিলেন বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত তবুও তাঁরা সম্পূর্ণ শাক্তমতে পূজা করেন সিংহবাহিনীর মানসিংহ কর্তৃক অপহৃত হয়েও নিজ মহিমায় পুনরায় স্থাপিত হলেন দেবী সিংহবাহিনী গত ৪০০ বছর ধরে মল্লিকদের বিভিন্ন শাখার প্রতি পরিবারে দেবী চক্রাকারে পূজা পেয়ে আসছেন সারাবছর
 জগদ্ধাত্রী দেবীর রূপকল্পে সিংহবাহিনীর মূর্তি রচনা হলেও বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা যায় জগদ্ধাত্রীর মত ইনি সিংহপৃষ্ঠাসীনা নন, ইনি সিংহের পিঠে দণ্ডায়মানা অষ্টধাতুর তৈরী স্বর্ণবর্ণা বহুমূল্য দেবীমূর্তি চতুর্ভুজা উপরের দুইহাতে শঙ্খ, চক্র এবং নিচের দুই হাতে ধনুর্বাণ বাহন সিংহটি দেবীর ডান দিকে না থেকে রয়েছে বাঁদিকে সিংহের মুখটি অশ্বমুখ সিংহের পদতলে একটি হস্তীমুণ্ড মহিষাসুর দেবীর সঙ্গে যুদ্ধের সময় একবার হস্তীরূপ ধারণ করেন কিন্তু দেবীর অস্ত্রের আঘাতে মুণ্ড ছিন্ন হয়ে গড়ায় পদতলে হিন্দুধর্মের মূল তিনটি ধারা-বৈষ্ণব, শাক্ত শৈব মতের অপূর্ব সংমিশ্রণ দেবী সিংহবাহিনীর মূর্তিতে তবে অনেকের মতে মূর্তির নির্মাণকালে হয়তো বৈষ্ণব ধর্মকে পদানত করে শাক্তধর্ম মাথা তুলতে থাকে তারই স্পষ্ট ছাপ দেবীমূর্তিতে, হস্তীমুণ্ডের ওপর সিংহবাহনা দেবী এরই প্রতীক শৈব ধর্মের প্রতীক হিসাবে দুটি শিবলিঙ্গ(বাণেশ্বর বিশ্বেশ্বর) দেবীর আনুষঙ্গিক দেবতা হিসাবে পূজা পেয়ে আসছেন রাজ্যবর্ধন দেবের সময় থেকে দেবী সিংহবাহিনী মূলত সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক দেবীর সেবাধিকারী মল্লিক পরিবার বৈষ্ণব হলেও ধর্মীয় গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় না দিয়ে দেবী সিংহবাহিনীর উপাসনা করে আসছেন শাস্ত্রমতে
 মানসিংহের পুরোহিতের নির্দেশানুযায়ী বৈদ্যনাথ দে মল্লিক সিংহবাহিনী পূজার যে প্রথার প্রচলন করেছিলেন, আজও তা যথারীতি পালিত হয় দুর্গাপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা বাসন্তীপূজা-বছর এই তিনবার সিংহবাহিনী দেবীর বাৎসরিক পূজা অনুষ্ঠিত হয় পুরোহিতের কথামতো মাকে রাত্রের শীতলভোগে মুড়কি দেওয়া হয় পুরোহিতের নির্দেশ ছিল প্রতি শনি মঙ্গলবার এবং দুর্গাপুজোয় ছাগবলি দিতে হবে সেইমতো বলিদান প্রথা চলে এলেও, একবার মল্লিকদের গুরুদেব তাঁদের বলিপ্রদানে বাঁধা দেন পরে দ্বিধাগ্রস্ত পূজা কর্তৃপক্ষ তাঁর কাছে সিদ্ধান্তের জন্য উপস্থিত হলে দেখেন গুরুদেব রক্তবমি করেছেন এই ঘটনার পর স্থির হয় যে শনি মঙ্গলবারে বলি বন্ধ করে পরিবর্তে মিষ্টান্ন ভোগ দেওয়া হবে কিন্তু শারদীয়া বলিদান পূর্বের মতোই চলতে থাকবে সেই থেকে আজও পর্যন্ত দুর্গাপূজায় ৪টি কৃষ্ণবর্ণ-ছাগ বলি হয় কিন্তু এঁদের নিজকুল প্রথায় হাঁড়িকাঠ ব্যবহার করা হয় না বালির ওপরে ছাগটিকে স্থাপন করে বলি দেওয়া হয় সিংহবাহিনী মাতার দুর্গাপুজোর সময় কোনও দুর্গাপ্রতিমা আনা হয় না দুর্গাপুজোর ১৫দিন পূর্বে সংকল্প করে পূজা শুরু হয় এবং যথাবিহিত নিয়ম মেনে পূজা সমাপন হয় দেবীর উদ্দেশ্যে "সিংহবাহিনী জয় দুর্গায়ৈ নমঃ"মন্ত্রে অঞ্জলি নিবেদিত হয়ে অষ্টমী এবং নবমী পূজা একত্রে করা হয় বাসন্তী পূজাও হয় চৈত্র মাসের সপ্তমী অষ্টমী নবমীতে
 সিংহবাহিনী দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা তাঁর মহিমা মাহাত্ম্যের কথা আজও মল্লিক বংশের সদস্যদের মুখে মুখে ফেরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সিংহবাহিনী দেবীর সামনে ভাবসমাধিস্থ হয়েছিলেন অর্থাভাবে ক্লিষ্ট কোনও মল্লিকদের বাড়িতে পরমারাধ্যা দেবীর দিব্যদর্শন পেয়ে বলেন-"এক পোড়া বাড়িতেও দেখলুম যে, সেখানেও সিংহবাহিনীর মুখের ভাব জ্বলজ্বল করছে" একবার জনৈক রামগোপাল মল্লিক নামক পালাদারের দুই পুত্র বৈষ্ণব ধর্মের অহিংসনীতির দোহাই দিয়ে সিংহবাহনীর বলিদানের বিরোধীতা করেন রামগোপাল রাজি না হওয়ায় তাঁর পূজার সময় বাড়ি পরিত্যাগ করে সেই নবমীর রাত তাঁরা বিসূচিকা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আর একবার সিংহবাহিনীর মূর্তি চুরি করার উদ্দ্যেশ্যে কোনও পূজারী ব্রাহ্মণ দেবীর শয়নঘরে প্রবেশ করে দেবী পূজারির অভিসন্ধি বুঝতে পেরে এমন জ্যোতি বিস্ফোরণ করেন যে পূজারির দৃষ্টি নষ্ট হয়ে যায়
 দেবী সিংহবাহিনীকে জড়িয়ে রয়েছে এমন আরও অলৌকিক কাহিনী, কিংবদন্তি তবে একথা ঠিক যে সিংহবাহনী মায়ের আগমনের পর থেকেই এই বংশ ধনে-মানে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, ধর্মে-কর্মে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে তাই জগতের কল্যাণার্থে জগতের পালয়িত্রীরূপে, শান্তি বিধানের জন্য মহাশক্তি যে সিংহবাহনীরূপে প্রকটিতা হয়েছিলেন, সেইরূপে আজও তিনি উত্তর কলকাতার খ্যাতনামা মল্লিক বংশের কুলাধিষ্ঠাত্রী
তথ্যসূত্র - শ্রীমতী দেবযানী বসু(সাংবাদিক)
চিত্রঃ শ্রীমতী দেবযানী বসু(সাংবাদিক) এবং শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী


No comments:

Post a Comment