Monday, March 25, 2019

বনেদীবাড়ির দোল পর্ব



দোলযাত্রা উপলক্ষে "বনেদীর-বনেদীয়ানা" প্রকাশিত হল বনেদীবাড়ির দোল পর্ব লিখলেন পরিবারের সদস্য শ্রীমতী দেবযানী বসু মহাশয়া
 কথায় বলে বাঙালির দোল দুর্গোৎসব বেশ পুরানো আমল থেকেই বাংলাদেশের দুর্গোৎসবের মতো দোল উৎসবের খ্যাতি ছিল ভারতজোড়া তার মধ্যে কলকাতার বনেদীবাড়িগুলিতে এইসব অনুষ্ঠান হত খুব জাঁকজমকপূর্ণভাবে বনেদিয়ানা মাপকাঠি ছিল এইসব ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি মূলত গৃহদেবতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও সামাজিক ক্ষমতা, বৈভবের রোশনাই প্রদর্শনও ছিল দোল উৎসবের অন্যতম উদ্দেশ্য প্রচুর লোক সমাগত হত প্রতিটি বিত্তবান বাড়ির আঙিনায় খাওয়া-দাওয়ায় জন্য ভিয়েন বসে যেত্ গান-বাজনার আসর বসত প্রায় প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয়স্বজন ছাড়াও আশেপাশের সাধারণ মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এইসব বনেদি বাড়িগুলির দোলযাত্রা দোলের উৎসব নিয়ে বিভিন্ন বর্ধিষ্ণু পরিবারগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল কম নয় সাহেবরা আমন্ত্রিত হতেন বাড়িতে, থাকত খানাপিনার আসর
 দিন পালটেছে, দোলের রমরমাও কমেছে তবু নিয়মমাফিক দোলের পুজো হয় আগের মতো না হলেও লোকজন সমাগম হয় কীভাবে পালন করেন প্রজন্মের বংশধররা জানতে চলুন যাই বনেদী বাড়িগুলিতে আজ দোলযাত্রায় দুই বনেদীবাড়ির ইতিহাস তুলে ধরলাম
 . গুপ্ত বৃন্দাবন (মিত্র বাড়ি)- বৃন্দাবনের মতন শ্রীকৃষ্ণ দোল খেলেন খোদ উত্তর কলকাতার মিত্রদের গুপ্ত বৃন্দাবনে এখানে তিনি রাধানাথ জীউ বৃন্দাবনে তৈরী কষ্টিপাথরের মূর্তি সঙ্গে আছেন অষ্টধাতুর রাধারাণী নারায়ণ শিলাও প্রতিষ্ঠিত আছেন ইতিহাস বলছে মিত্রদের আদিপুরুষ ছিলেন কনৌজে, পরে গৌড়ের বাসিন্দা সারা বঙ্গদেশ জুড়ে ছড়িয়েছিল মিত্রদের অনেকগুলি শাখা এই বংশের পঁচিশতম পুরুষ মদনমোহন মিত্র ব্যবসার সূত্রে কলকাতায় এসে সিমুলিয়া অঞ্চলে বিশাল বসতবাড়ি ঠাকুরবাড়ি তৈরী করেন তাঁর পুত্র এবং পৌত্ররা আরও বসতবাড়ির আয়তনের বৃদ্ধি ঘটান বৃন্দাবনের রীতি অনুযায়ী পূজাপাঠ হয়, তাই গুপ্ত বৃন্দাবন কিন্তু গুপ্ত কেন? বর্তমান সদস্যরা জানালেন কারণ, পূর্ব পুরুষরা চাইতেন না ঠাকুরবাড়ির অবস্থান, জাঁকজমক লোকের সামনে আসুক খানিকটা আড়াল রেখে একান্তে পারিবারিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ ছিল এই ঠাকুরবাড়ি
 যে সময় ঠাকুরবাড়ির রমরমা চলছে সেই সময় তখন কলকাতায় গোরা সাহেবের রাজত্ব তাদের নজর, ছোঁয়া থেকে বাঁচানোর জন্য হয়ত এই ঠাকুরবাড়ি একটু আড়ালেই রাখা হত কালে কালে নাম হয়ে যায় গুপ্ত বৃন্দাবন খিলানওয়ালা প্রশস্ত ঠাকুরদালান পাশে দোতলার ওপরে রাধানাথ জীউ রাধারাণীর বাৎসরিক সংসার
 দোলের আগের দিন হয় হোম হোমের আগুন দিয়ে জ্বালানো হয় চাঁচর ২৮টি লাল করবী দিয়ে হয় হোম পুরোহিত সবাইকে আবির দেন প্রসাদ হয় ফুটকড়াই, মঠ দিয়ে দোলের দিন সকালে দেবদোল ১২টায় মধ্যাহ্ন দোল, বিকাল -৩০টে ভোগারতি হয় দোলের দিন ঠাকুরের হাতে আবিরের পুঁটলি দেওয়া হয় যেন তারাও দোল খেলবেন বিকেলে ঠাকুরের স্নান হয় নিজেস্ব স্নানকুণ্ডে গুপ্ত বৃন্দাবন, ঠাকুরবাড়ি, ঠাকুরের সম্পত্তি সবই রাধানাথজীউয়ের নামে উৎসর্গিত তিনিই বিশাল পরিবারের গৃহদেবতা গৃহকর্তা দোলপূর্ণিমায় গৃহকর্তা ছাড়াও বাড়ির সমস্ত সদস্য দোলখেলায় মাতেন
. বাওয়ালি মন্ডলদের রাসবাড়িঃ প্রশস্ত তোরণ দরজা দিয়ে  ঢুকলে ডানদিকে উঁচু ভিতের ওপর সুন্দর মন্দির সামনে থামওয়ালা বিশাল নাটমন্দির যদিও সংস্কারের অভাবে অনেকটাই ভগ্নপ্রায় আদিগঙ্গার পাশে টালিগঞ্জ রাসবাড়ি নামেই বেশি পরিচিত এই ঠাকুরবাড়ি দক্ষিণ ২৪পরগনার বাওয়ালি মন্ডল পরিবারের ঠাকুরবাড়ি এটি উদয়নারায়ণ মণ্ডল ১৮১৮ সালে কলকাতায় টালিগঞ্জ রোডে বসতবাড়ি তৈরী করেন, সঙ্গে রাসবাড়ি তৈরী করে প্রতিষ্ঠা করেন রাধামদনমোহনজীউ বিগ্রহ সঙ্গে অষ্টধাতুর রাধিকামূর্তি দোল উৎসবও শুরু হয় অন্যান্য বৈষ্ণব ধারার অনুষ্ঠানগুলির মতো মণ্ডল পরিবার নেড়া পোড়ানোকে বলে বুড়ির ঘর পোড়ানো দোলের আগের সন্ধ্যায় উঠোনের একপ্রান্তে খড় দিয়ে তৈরী হয় বুড়ির ঘর বিগ্রহ পুজোর পর আগুন দেওয়া হয় তাতে পরদিন সকালে রাধামদনমোহনজীউ রাধিকা বিগ্রহ দুটি বাইরে রাখা হয় ফুল দিয়ে সাজিয়ে এই একদিন ভক্তেরা ছুঁতে পারেন বিগ্রহ ভোগে থাকে মণ্ডা, নানা রকমের মঠ, কদমা, লুচি, ব্যঞ্জন ইত্যাদি আজও আশপাশের এবং দূরের চেনা পরিচিত ভক্তজনের দোলের দিনের অবশ্য পালনীয় নিয়ম হল মণ্ডলদের রাসবাড়ির বিগ্রহকে রং ছুঁইয়ে দোলোৎসব পালন করা
 তথ্যসূত্র এবং  কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ শ্রীযুক্তা দেবযানী বসু(অ্যাডমিন-"বনেদীর-বনেদীয়ানা")


No comments:

Post a Comment