"বন্দে
তং শ্রীমদদ্বৈতাচার্য্যমদ্ভুতচেষ্টিতম্।
যস্য প্রসাদাদজ্ঞোহপি তৎস্বরূপং
নিরূপয়েৎ।।"
(শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত)
অর্থাৎ
যাঁহার প্রাসাদে অতি অজ্ঞ ব্যক্তিও
তাঁহার স্বরূপনিরূপণে সমর্থ হয়, সেই
অদ্ভূত লীলাশালী শ্রীমৎ অদ্বৈতাচার্য্য প্রভুকে
আমি বন্দনা করি।
ইতিহাসের খোঁজে নদীয়ার শান্তিপুরের
বেশকিছু প্রাচীন তথ্যের সন্ধানে "বনেদীর-বনেদীয়ানা" পরিবারের শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী,
শ্রীমান্ বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সৌমজিৎ মাইতি। নদীয়া
জেলার শান্তিপুর একটি অত্যন্ত সুপ্রাচীন
ও ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান, বিশেষত গঙ্গার
তীরবর্তী জনপদ। মহাপুরুষ
চৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষাগুরু অদ্বৈত আচার্যের সাধনপীঠ
নিকটবর্তী বাবলাগ্রামে।
"শ্রীলদ্বৈত গুরুং বন্দে হরিণাদ্বৈতমেব
তং
প্রকাশিত পরম্ ব্রহ্ম যোহবতীর্ণ
ক্ষিতৌ হরিং।।
অন্তঃকৃষ্ণ বহিগৌরং কৃষ্ণচৈতন্য সংজ্ঞ কং।
প্রেমাধিবং
সচ্চিদানন্দং সর্ব্বশক্তাশ্রয়ং ভজে।।
শ্রীনিত্যানন্দরামহি
দয়ালুম্ প্রেম দীপকং।
গদাধরঞ্চ
শ্রীবাসং বন্দে রাধেশসেবিনং।।"
শ্রীঅদ্বৈত
প্রকাশ গ্রন্থের প্রারম্ভে ঈশান নাগর লিখেছেন-
কলিকাল ঘোর পাপচ্ছন্ন, জীবের
দুর্দশা দেখে বৈষ্ণব চূড়ামণি
শঙ্কর কলির জীবকে উদ্ধারের
জন্য যোগমায়ার সঙ্গে পরামর্শ ক'রে কারণ সমুদ্রের
তীরে উপনীত হন।
সেখানে সাতাশ বছর তপস্যায়
জগৎকর্ত্তা মহাবিষ্ণু পঞ্চাননকে দর্শন দিয়ে বলেন-"তুমি আর আমি
অভেদ নই। তোমার
এবং আমার আত্মা এক,
দেহ ভিন্ন।" এইবলে
মহাবিষ্ণু পঞ্চাননকে আলিঙ্গন করেন, ফলে দুই
দেহ এক হয়ে যায়। এই
দৃশ্য দর্শনের সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছিল তারা
অত্যাশ্চর্য হয়ে যায়।
'শুদ্ধ স্বর্ণ বর্ণ অঙ্গ
উজ্জ্বল বরণ' ইহা দর্শন
হয়। মহাবিষ্ণু
তখন কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে
হুঙ্কার ছাড়লেন, সঙ্গে সঙ্গে চমৎকার
এক দৈববাণী হয়। "শোন
মহাবিষ্ণু তুমি এই মূর্তিতে
লাভার গর্ভে অবতীর্ণ হও।"
অদ্বৈতাচার্যের বংশেই জন্ম আরেক
বৈষ্ণবসাধক বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। তাঁরও
স্মৃতি মন্দির রয়েছে এই
শান্তিপুরে। এছাড়া
তন্ত্রসিদ্ধ কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের বংশধর শান্তিপুরে দক্ষিণাকালীমূর্তি
প্রতিষ্ঠা করেন, যা আগমেশ্বরী
নামে পরিচিত। এছাড়া
বহু প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শনও রয়েছে এই অঞ্চলে। তাদের
মধ্যে অন্যতম চাঁদুনীমায়ের প্রাচীন
ইতিহাস, খাঁ বংশের ইতিহাস,
শ্যামচাঁদ মন্দিরের ঐতিহ্য, জলেশ্বর শিবমন্দির, দক্ষিণাকালীর পঞ্চরত্ন মন্দির, প্রাচীন সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির ইত্যাদি। সেই
ইতিহাসের কিছু অংশই গবেষণায়
উঠে এল বনেদীয়ানা পরিবারের
সদস্যদের হাতে। আজ
তাই আলোচনার অন্যতম উদ্দেশ্য।
ভবিষ্যৎ-এ আরও প্রাচীন
ইতিহাস ও ঐতিহ্যপূর্ণ তথ্য
শান্তিপুর তথা বঙ্গের বহু
স্থানের তুলে ধরা হবে।
"জ্ঞান নেত্রং সমাদায়
উদ্ধরেদ্ বহ্নিবৎ পরম।
নিস্কলং নিশ্চলং শান্তং তদ্ ব্রহ্মাহ
মিতি স্মৃতম।।"
জ্ঞাননেত্র
অবলম্বন করে অগিড়বতুল্য পরমজ্যোতি
নিয়ে, জ্যোতির্ময় সেই পরমব্রহ্মকে জানতে
হবে। অমূল্য
নিধির মত সযত্নে তাকে
আহরণ করবে। যাঁরা
বিদ্বান, তাঁরা সবসময় এই
চিন্তাই করবে-"আমিই সেই নিষ্কল(কলাহীন), নিশ্চল(ধ্রুব),শান্ত(নির্বিকার মঙ্গলময়) ব্রহ্ম!"
শান্তিপুর পূন্যতোয়া ভাগীরথীর তীরস্থ একটি নগর,
বৈষ্ণব ও শাক্তের মিলনক্ষেত্র
এবং শৈব ধারারও প্রাচীনত্ব
দেখা যায় এই অঞ্চলে। শুরুতেই শ্রীশ্যামচাঁদ
জীউ- প্রাচীন ইতিহাস
শ্যামচাঁদ জীউঃ শান্তিপুরের প্রাচীন মন্দিরের মধ্যে অন্যতম এই
শ্যামচাঁদ মন্দির। এই
মন্দিরের ইতিহাস বললেন শ্রী
অলোক দাস(মন্দির পরিচালন
কমিটির সদস্য) এবং শান্তিপুরে
বিগ্রহবাড়ি সমন্বয় সমিতির পত্রিকা। অদ্বৈতপ্রভুর
দ্বাদশ বছর বয়েসে যখন
শান্তিপুরে আসে, সঙ্গে আসেন
গোবিন্দ দাস। এই
গোবিন্দদাস সহ অন্যান্য ভাইয়েরা
অদ্বৈত পরিবারে দীক্ষিত। গোবিন্দদাসের
পুত্র ব্যবসা সূত্রে প্রচুর
অর্থ উপার্জন করেন। তিনি
"ভাগ্যবস্তু" খ্যাতি লাভ করে
"ভাগ্যবন্ত" নামে প্রসিদ্ধি লাভ
করেন। তাঁর
পুত্র শ্রীমন্ত সম্মান সূচক খাঁ
উপাধি লাভ করেন।
এঁরা ৮টি দেব বিগ্রহ
এবং ১০৮টি পুষ্করিণী স্থাপন
করেন। শ্রীমন্ত
খাঁ-র তিন পুত্রসন্তান,
যথাক্রমে রঘুনাথ, কৃষ্ণবলভ ও বিশ্বেশ্বর।
বিশ্বেশ্বরের পুত্র রঘুনাথ।
রঘুনাথের পুত্র জগন্নাথ এবং
জগন্নাথের পুত্র চার, যথাক্রমে
রামগোপাল, রামজীবন, রামভদ্র এবং রামচরন।
এই শ্যামচাঁদ মন্দির তৈরী হয়
১৬৪৮শতাব্দে। মন্দির
তৈরী হওয়ার দুইবছর আগে
বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হয়। রামগোপাল
খাঁ চৌধুরীর মাতা স্বপ্ন দেখেছিলেন
রাধাকৃষ্ণের মূর্তি। এঁরা
এতটাই প্রতিপত্তিশালী ছিলেন যে শিল্পী
নিয়ে এসে রামগোপাল মূর্তি
তৈরী করান কিন্তু তাঁর
মা বলেন এই মূর্তি
সেই স্বপ্নাদেশে যে মূর্তি দেখেছিলেন
সেই মূর্তি নয়।
যে মূর্তি রামগোপাল তৈরী
করিয়েছিলেন সেই মূর্তি কালাচাঁদ
মন্দিরে রয়েছে, অবশেষে আবার
মূর্তি তৈরী হল এবং
সেই বিগ্রহ দেখেই রামগোপাল
খাঁ চৌধুরীর মা বলেন এই
বিগ্রহই আমার স্বপ্নে দেখা
মূর্তি। তখন
দুইবছর এই শ্যামচাঁদ জীউ
কালাচাঁদ মন্দিরে সেবা পেতেন।
তারপর ১৬৪৮ শতাব্দে রামগোপাল
খাঁ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই শ্যামচাঁদ
মন্দির তৎকালীন সময় ৮-৯লক্ষ
টাকার ব্যয়ে। শ্যামচাঁদ
মন্দিরটি আটচালা শ্রেণীর।
উচ্চতা ১১০ফুট, দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে ৬৮ফুট। কৃষ্ণনগরের
কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা রাঘুরাম রায়কে
মন্দির উদ্বোধনের জন্য আহ্বান করা
হয়েছিল। বাংলার
স্থাপত্য গৌরবে এই মন্দির
অদ্বিতীয়। সুউচ্চ
চুড়োয় ত্রিশূল ও ধাতু নির্মিত
পতাকা। নদীয়া
রাজ রঘুরাম শান্তিপুরে আসেন
এবং খাঁ বাড়ির বিশাল
সভায় শীর্ষ স্থান অলংকৃত
করেন। মহারাজের
অভ্যর্থনায় লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান
করায় প্রতিষ্ঠাতারা খাঁ উপাধিতে ভূষিত
হন।
বর্তমানে বিধায়ক শ্রী অজয়
দে তিনি একটি মন্দির
কমিটি গঠন করেন, এবং
সেই কমিটির মাধ্যমেই বর্তমানে
শ্যামচাঁদ মন্দির পরিচালিত হয়। এই
বিগ্রহ রাসের সময় শোভাযাত্রায়
যান না। রাস
উৎসবে বিগ্রহ মন্দিরের দালানে
উপস্থিত হন একমাত্র দোলেই
শ্যামচাঁদ নগর পরিক্রমায় যান। এছাড়া
পৌষ মাসের শুক্লপক্ষের দ্বাদশীতিথিতে
এই মন্দিরে ১৫দিন ব্যাপী অনুষ্ঠান
হয় এবং প্রায় ২০,০০০ ভক্তবৃন্দের জন্য
মহোৎসবের আয়োজন করা হয়। এই
বিগ্রহের চরণপদ্মে দাস চৌধুরী লেখা
আছে, রামগোপাল দাস চৌধুরী পরবর্তীকালে
"খাঁ" উপাধি পান।
নবাব মুর্শিদকুলি যখন গঙ্গাবক্ষে যুদ্ধজয়
করে মুর্শিদাবাদে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন
তাদের খাদ্য সংকট দেখা
যায়, তখন নবাব জানতে
পেরেছিলেন এই শান্তিপুরে গ্রামে
একজন প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন, নবাব যোগাযোগ
করেন এবং নবাব ও
তঁর সৈন্যদের পর্যাপ্ত খাদ্য প্রদান করেন
এই শান্তিপুরের প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি। পরবর্তীকালে
নবাব তাঁদের দরবারে ডেকে
পাঠালেন এবং "খাঁ" উপাধি দিলেন।
বর্তমানে এই শ্যামচাঁদ মন্দিরে
নিত্যভোগ, পূজাপাঠ নিষ্ঠার সঙ্গে পালিত হয়ে
আসছে।
শ্রীকালাচাঁদ জীউঃ শ্রীকৃষ্ণের রাসযাত্রা প্রসঙ্গে মহাত্মা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বলেছিলেন,"শান্তিপুরের রাস, ঢাকার জন্মাষ্টমী
এবং বৃন্দাবনের ঝুলন দেখার মতন"। প্রায়
৩০০বছর আগে এই জাঁকজমকপূর্ণ
রাস উৎসব দেখা যায়
শান্তিপুরের খাঁ চৌধুরীর বংশে। এই
পরিবারের প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহগুলির মধ্যে অন্যতম শ্যামচাঁদ,
কালাচাঁদ, গোপীকান্ত, কৃষ্ণরায় উল্লেখযোগ্য। তাই
কালাচাঁদ মন্দিরের ইতিহাসের সন্ধান দলেন পরিবারের
দৌহিত্র বংশের বংশধর শ্রী
রাজীব সেন মহাশয়(দৌহিত্র
বংশের সপ্তমপুরুষ)। রাজীব
সেনের কথায় কালাচাঁদ মন্দির
প্রায় ২৫০-৩০০বছর প্রাচীন। এই
মন্দিরে শ্রীশ্রীরাধা কালাচাঁদ জীউর পূজার্চনা হয়। নিত্যপূজা
ছাড়াও জন্মাষ্টমী, নন্দোৎসব, ঝুলনযাত্রা, দোলযাত্রা অতি ধুমধামের সহিত
পালিত হয়। রাস
উৎসবে কালাচাঁদ বিগ্রহ ঠাকুরদালানে উপস্থিত
হন এবং তিনি সেই
রাসের সময় শোভাযাত্রায় নগর
পরিক্রমায় যান। দোলের
দিন শ্যামচাঁদ আসেন এই মন্দিরে
কারণ কথায় কথায় জানা
গেল শ্যামচাঁদের আদিভিটে এই কালাচাঁদ মন্দির। কালাচাঁদ
হলেন শ্যামচাঁদের বড়ভাই, তাই লোককথায়
তিনি দোলের সময় দাদার
সাথে দেখা করতে আসেন
এই কালাচাঁদ মন্দিরে। রাজীববাবুর
কথায় এই কালাচাঁদ মন্দিরে
অন্নভোগ হয় না, এই মন্দিরে চিরে,
খই, দই, মিষ্টি, ফল
ইত্যাদি ভোগ দেওয়া হয়। নিত্যভোগ
নৈবেদ্য সহযোগে হয়।
বর্তমানে মন্দিরের পৌরোহিত্য করছেন শ্রী পার্থ
মুখোপাধ্যায়। বর্তমানে
২০০৯সালে আবারও মন্দির সংস্কার
করা হয়। বাংলার
প্রচীন মন্দিরের অন্যতম এই মন্দির
যেখানে নিষ্ঠার সঙ্গে পূজা হয়।
শ্রীশ্রীরাধামদনগোপাল জীউঃ
শান্তিপুরের আরও একটি প্রাচীনতম
মন্দির এই মদনগোপাল মন্দির। এই
মন্দিরের ইতিহাসের সন্ধান দিলেন শ্রী
স্বরূপ গোস্বামী(পরিবারের সদস্য), সংগ্রহ করলেন শ্রীমান্
শুভদীপ রায় চৌধুরী।
১৪৩৪ খ্রীঃ শ্রীশ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য শ্রীহট্টের লাউর
গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার
নাম কুবের মিশ্র, মাতার
নাম লাভাদেবী। অদ্বৈতাচার্যের
বাল্যকালের নাম শ্রীকমলাক্ষ।
বারো বছর বয়েসে তিনি
শান্তিপুরে আসেন। স্মৃতি
শাস্ত্র ও ন্যায়শাস্ত্র পড়ার
জন্য। অদ্বৈতাচার্য্য
মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে
পাঁচ বেদ সমাপন করে
বেদ পঞ্চানন উপাধি পান।
পিতামাতার পরলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার
জন্য গয়ায় পিণ্ডদান করে
বৃন্দাবনে উপস্থিত হন। উল্লেখ্য
যে তিনি সারা ভারতবর্ষ
পরিক্রমা করেছিলেন সেই পরিক্রমা শেষ
করতে সময় লাগে প্রায়
পঁচিশ বছর। বৃন্দাবনে
রাতে বটবৃক্ষের তলায় অবস্থানকালে গভীর
রাতে তিনি স্বপ্নাদিষ্ট হন
মদনমোহন বলেন,"হে অদ্বৈত, আমার
অভিনড়ব বিগ্রহ পূর্বে কুব্জা
দেবী সেবা করতেন, তাহা
নিকুঞ্জবনে টিলার তলায় আছে,
তাহা তুমি তুলিয়া সেবার
ব্যবস্থা করো। বলাবাহুল্য
যে মদনমোহন সাক্ষাত এসেছিলেন অদ্বৈতপ্রভুর কাছে রাখালরূপ ধর।
পরের দিন সকালে অদ্বৈতাচার্য্য
সে কথা সকলকে জানিয়ে
একজন বৈষ্ণব ব্রাহ্মণকে সেবার
জন্য আহ্বান করেন।
অদ্বৈতাচার্য্য গোবরধন পরিক্রমা করে
এসে দেখেন সেই মদনমোহন
মন্দিরে নেই। অনেক
অনুসন্ধান করেও সেই খোঁজ
পেলেন না। তারপর
তিনি স্বপড়ব দেখলেন যে
মদনমোহন তাঁকে বলছেন, "অভক্তের
অত্যাচারে আমি ফুলের তলায়
লুকিয়ে আছি। তখন
মথুরার চৌবে ব্রাহ্মণ আসলেন
এবং তাঁকে সমস্ত বৃত্তান্ত
বলে মদনমোহনকে তুলে দিলন।
এরপর অদ্বৈতাচার্য্য আকুল আহ্বানে শ্রীশ্রীমদনমোহনের
আদেশ পেলেন যে আমা
অভিন্ন যাহা পূর্বে শ্রীমতী
রাধারণী সখী বিশাখা দেবী
অঙ্কিত চিত্রপট নিকুঞ্জবনে আছে, তা নিয়ে
তুমি শান্তিপুরে ফিরে যাও ও
আমার সেবাপূজা করো। স্বরূপবাবুর কথায় এই মন্দিরের
বহুবার সংস্কার হলেও মন্দির প্রথম
তৈরী হয় প্রায় আনুমানিক
৪৩৫বছর আগে এবং অদ্বৈতাচার্য্য
নিজেই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই মন্দির।
অদ্বৈতাচার্য্য চারভাই ছিলেন এবং
তিনিই ছিলেন কনিষ্ঠ বাকি
তাঁর তিন ভাই পরিভ্রমণ
করতে গিয়ে ফিরে আসেননি। অদ্বৈতপ্রভু
নিজের বাড়ি শান্তিপুরে ফিরে
এলেন এবং চিত্রপটের সঙ্গে
নিয়ে এলেন গণ্ডকী থেকে
শালগ্রামশিলা। কিছুকাল
পরে অদ্বৈতাচার্য্যের গুরুদেব মাধবেন্দ্র পুরীপাদ, তিনি বাংলাদেশে থাকতেন
সেখানে তাঁর স্ত্রী পরলোকগমনের
পর তিনি শান্তিপুরে চলে
এলেন। তিনি
তখন অদ্বৈতপ্রভুকে বললেন গোপিভাবে সেবা
করো। তখন
মাধবেন্দ্র পুরীপাদ বললেন,"তুমি বিবাহ করো,
কৃষ্ণের কৃপায় তোমার সন্তান
হবে। কৃষ্ণনাম
প্রচার সেইভাবেই হবে।" মাধবেন্দ্র
পুরীপাদ ছিলেন সাক্ষাৎ চলমান
জগন্নাথ এবং তিনি অদ্বৈতাচার্য্যের
গুরুদেব। অদ্বৈতপ্রভুর
বয়স যখন ১০০বছর তখন
মহাপ্রভু পরলোকগমন করলেন। অদ্বৈতপ্রভু
১২৫বছর জীবিত ছিলেন।
অদ্বৈতপ্রভু তাঁর প্রতিষ্ঠিত মদনগোপালে
বিলীন হয়েছিলেন। অদ্বৈতপ্রভুর
ছয়সন্তান। জ্যষ্ঠপুত্র
শ্রীঅচ্যুতানন্দ তিনি গৃহত্যাগ করেছিলনে। দ্বিতীয়
সন্তান শ্রীকৃষ্ণ মিশ্র(মদনগোপাল বাড়ি),
তৃতীয় পুত্র শ্রীগোপাল এবং
চতুর্থপুত্র শ্রীবলরাম মিশ্র(এই বলরাম
মিশ্র থেকেই শান্তিপুরে অন্যান্য
গোস্বামীবাড়ির সৃষ্টি), পঞ্চমপুত্র শ্রীস্বরূপ এবং ষষ্ঠপুত্র শ্রী
জগদীশ।
শ্রীকৃষ্ণ মিশ্র ছিলেন উচ্চমার্গের। অদ্বৈতপ্রভু
এবং মহাপ্রভুর আদেশে মদনগোপাল কৃষ্ণমিশ্রকে
দান করেন। তিনদিন
ধরে রাস উৎসব হয়। প্রথম
দিন মদনগোপাল রাসমঞ্চে ওঠেন। দ্বিতীয়
দিনও রাসমঞ্চে ওঠেন প্রভু।
তৃতীয় দিন ভাঙারাস পালন
হয়। এই
পরিবারের বহু কুলতিলক ছিলেন,
তারমধ্যে অন্যতম শ্রী রাধাবিনোদ
গোস্বামী(শ্রেষ্ঠভাগবত ভাষ্যকার এবং পণ্ডিত), শ্রী
রাধিকানাথ গোস্বামী(পণ্ডিত ও চৈতন্যচরিতামৃত
এবং মহাপ্রভুর
সময়ে যে গ্রন্থ রচিত
হয়েছিল তার সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার
ছিলেন), এছাড়া পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র
গোস্বামী এবং কৃষ্ণগোপাল গোস্বামী
১৩০৫বঙ্গাব্দে পি.এইচ.ডি
করেছিলেন, পণ্ডিত বিশ্বেশ্বর গোস্বামী(দর্শনশাস্ত্রে সুপণ্ডিত এবং সংক্ষিপ্ত মহাভারত
কাব্য প্রণেতা),শ্রী জিতেন্দ্রনাথ গোস্বামী(ভাগবত ভাষ্যকার)।
পরিবারে নিত্যভোগ দেওয়া হয়।
আজও শ্রীশ্রীরাধামদনগোপাল মন্দিরে নিষ্ঠার সঙ্গে পূজাপাঠ হয়।
শ্রীশ্রকৃষ্ণ রায় জীউ ও শ্রীশ্রীকেশব রায় জীউঃ
শান্তিপুরের প্রাচীন মন্দিরের অন্যতম এই দুই
মন্দির এবং বিগ্রহ।
এই মন্দিরের ইতিহাসের সন্ধান দিলেন শ্রী
তপন গোস্বামী(পরিবারের বংশধর-১৪তম)।
পাগলাগোস্বামী বাড়ির দুই বিগ্রহ
কৃষ্ণ রায় ও কেশব
রায় জীউ। এই
পরিবারের পুর্বপুরুষ অদ্বৈতাচার্য্যের চতুর্থপুত্র শ্রী বলরামের দশম
পুত্র কুমদানন্দ গোস্বামী ছিলেন পণ্ডিত ও
সাধক। কথিত
আছে কৃষ্ণনগর রাজ কর্তৃক প্রদত্ত
সম্পত্তি প্রত্যাখ্যান বা নষ্ট করায়,
তাঁহার "আউলিয়া"নামে খ্যাতি রটে
এবং সেই জন্যই এই
শাখার নাম আউলিয়া বা
পাগলাগোস্বামী। কুমদানন্দের
দ্বারা "কৃষ্ণরাই" প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাঁচ বছর
পর পুনরায় "কেবশরাই" প্রতিষ্ঠিত হন। এই
পরিবারে রাস উৎসব, দোলউৎসব,
ঝুলনযাত্রা, জন্মাষ্টমী ইত্যাদি। বলরামের
কনিষ্ঠপুত্র কুমদানন্দ গোস্বামী, তাঁকে নারায়ণ শিলা
দিয়েছিলেন অদ্বৈতাচার্য্য। রাসের
সময় রাসমঞ্চে একই সাথে দুই
বিগ্রহ পূজিত হন।
বিগ্রহের বয়স প্রায় আনুমানিক
৪৫০বছর। কথায়
কথায় জানতে পারলাম রাসমঞ্চে
বিগ্রহ স্বর্ণালংকারে সাজানো থাকে।
বিগ্রহ তৈরীর পাঁচবছর বাদে
তৈরী হয় গৌরনিতাই।
বংশের হরিনাথ গোস্বামীর স্ত্রী
অদ্বৈতমহাপ্রভু ও তাঁর স্ত্রী
সীতাদেবীকে মূর্তি আকারে প্রতিষ্ঠা
করেন। পরিবারে
অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। সকালে
মঙ্গলারতি হয় এবং বাল্যভোগে
খীর, মাখন, মিষ্টি, ছানা,
নারু ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। দুপুরে
শাক, শুক্তনি, ডাল, মোচার ঘন্ট,
পটলের তরকারি, ফুলকপির তরকারি, পোলাও, পরমান্ন, দই,
চাটনি ইত্যাদি নিবেদন করা হয়। সন্ধ্যায়
আরতি হয়। কথায়
কথায় জানতে পারলাম রাসের
সময় রাসমঞ্চে বিগ্রহের সামনে রৌপপাত্রে ভোগ
নিবেদন করা হয় যার
আকার বিশাল। ভাঙারাসের
দিন নগর পরিক্রমায় যান। প্রথমে
বড়গোস্বামী বাড়ির বিগ্রহের পরই
এই পাগলাগোস্বামী বাড়ির বিগ্রহ নগর
পরিক্রমায় যান। ভাঙারাসের
শোভাযাত্রায় দুই বিগ্রহের হাওদা
প্রদর্শন এক অনন্য নান্দনিকতার
আবেশ সৃষ্টি করেন।
চতুর্থ দিন বিগ্রহদ্বয় কুঞ্জভঙ্গ
শেষে নিজ নিজ মন্দিরে
অধিষ্ঠান করেন। এই
ভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে পূজিত হন
দুই বিগ্রহ।
ঐতিহ্যমণ্ডিত বড় গোস্বামী বাড়িঃ
শান্তিপুরের প্রতিটি ধুলিকণা যাঁর লীলার সাক্ষী,
বহুভক্ত এখনও শান্তিপুরের বাতাসে
যাঁর সেই ধ্বনি কর্ণগোচর
করার চেষ্টা করেন সেই
শান্তিপুরনাথ, শান্তিপুর পুরন্দর শান্তিপুরের শ্রীশ্রীঅদ্বৈতাচার্য্যের পুত্র বলরাম মিশ্রের
পুত্র মথুরেশ গোস্বামীর প্রথমপুত্র
রাঘবেন্দ্র গোস্বামী থেকে সৃষ্টি হয়
বড়গোস্বামী। পরিবারের
বংশধর শ্রী সুদেব গোস্বামী
আমাদের সেই ইতিহাসের খোঁজে
দিলেন, তারফলে শান্তিপুর নিয়ে
প্রথম গবেষণার কাজ আরও এগিয়ে
গেল। শ্রীঅদ্বৈতাচার্য্য
নেপালের গণ্ডকী নদী থেকে
একটি নারায়ণ শিলা পান। তিনি
অপ্রকটের পর সেই শিলার
সেবাভার অর্পণ করেন বলরাম
মিশ্রের হাতে। বলরাম
মিশ্রের পর সেই শিলার
সেবাভার পরম্পরায় মথুরেশ গোস্বামীর পাপ্ত
হয়। মথুরেশ
গোস্বামী বর্তমানে বাংলাদেশের যশোহর থেকে শ্রীশ্রীরাধারমন
বিগ্রহ শান্তিপুরে এনে প্রতিষ্ঠা করেন। শান্তিপুরের
ভাঙারাসের পুরোধা বিগ্রহ শ্রীশ্রীরাধারমন
জীউ প্রথমে পুরীতে রাজা
ইন্দ্রদ্যুম্নের আমলে দোলগোবিন্দ নাম
পূজিত হতেন। কালা
পাহাড়ের মন্দির ও শ্রী
বিগ্রহ ধ্বংস যজ্ঞে আতঙ্কিত
হয়ে রাজা বসন্ত রায়
যশোহরে নিয়ে আসেন এই
দোলগোবিন্দকে। বসন্তরায়ের
গৃহে বেশ কিছুকাল পূজিত
হন। রাজা
বসন্ত রায়ের শ্রীগুরুদেব ছিলেন
সীতানাথের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামী। তখন
ভারত মোঘল শাসনাধীন এবং
রাজা মানসিংহের অত্যাচারে অবিভক্ত বাংলা ভয়ে জর্জরিত। শ্রীবিগ্রহের
রক্ষনাবেক্ষনের জন্য বসন্তরায় গুরুদেবের
হাতে তাঁকে সমর্পণ করেন। প্রভুপাদ
মথুরেশ গোস্বামী শ্রীবিগ্রহ পদব্রজে শ্রী বিগ্রহ নিয়ে
আসেন ও বড় গোস্বামী
বাটীর মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। শান্তিপুরে
এনে বিগ্রহের নতুন নামকরণ হয়
"রাধারমণ জীউ"। শ্রীশ্রীরাধারমনকে
নিয়ে বেশ আনন্দে কাটতে
থাকে, হোঠাৎ ছন্দপতন হয়,
বড় গোস্বামী বাটী থেকে বিগ্রহ
অপহৃত হল। তৎকালীন
প্রভু ও তাঁদের স্ত্রীদের
নাওয়া খাওয়া বন্ধ হল। অনেক
চিন্তার পর মাথায় এল
যে শ্রীধাম বৃন্দাবনে গোপীরা "কাত্যায়নী ব্রত" করে লীলাপুরুষোত্তমকে পেয়েছিলেন,
তাই এই ব্রত করব
শ্রীশ্রীরাধারমনকে পাওয়ার জন্য।
চিন্তানুযায়ী দুর্গাপূজর সময় শ্রীশ্রীকাত্যায়নী মাতার
পূজা শুরু হল।
পূজার তৃতীয় রাত্রে স্বপ্নাদেশে
জানেন যে দিগন-গরে
একটি জলাশয়ে তোমাদের ইষ্টদেবকে
ফেলে রাখা হয়েছে।
নির্দিষ্ট জলাশয়ে পেয়ে আবার
পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হল।
রাধারমণ যাঁর কাছে বাঁধা
সেই রাধারমণকে চিরদিনের জন্য বড় গোস্বামী
বাটীতে রাখতে তৎকালীন প্রভুপাদ
রাধারমণের পাশে রাধারাণীকে প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন। কারণ
পুরী থেকে যশোহর হয়ে
শান্তিপুরে রাধারমণের একম মূর্তি এসেছিলেন। শান্তিপুরে
শোভাযাত্রা করে ঘোরানো হয়
রাধারমণের পাশে রাধারাণীকে প্রতিষ্ঠা
করা হয় রাস উৎসবের
সময়। খাঁ
চৌধুরীরা ছিলেন বড় গোস্বামী
বাটীর শিষ্য। ভাঙারাসের
পরের দিন বড় গোস্বামী
বাড়ীর যুগল বিগ্রহকে নানালঙ্কারে
সজ্জিত করে অনুষ্ঠিত হয়
"কুঞ্জভঙ্গ" বা ঠাকুর নাচ
একটি খুবই মনোরম অনুষ্ঠান,
অনুষ্ঠান শেষে বিগ্রহকে অভিষেক
করে মন্দিরে প্রবেশ করানো হয়। মথুরেশ
গোস্বামীর সময়ে বড়গোস্বামী বাড়িতে
প্রতিষ্ঠিত হন জগন্নাথ, বলরাম
ও সুভদ্রার বিগ্রহ। পরবর্তীকালে
খাঁ চৌধুরী পরিবার থেকে
শ্রীশ্রীরাধা গোপাল রায় জীউ
বিগ্রহ নিত্যসেবার জ্য বড় গোস্বামী
বাটীতে দেওয়া হয়।
তৎকালেই প্রতিষ্ঠিত হয় নদীয়া জেলার
সর্বপ্রথম মহাপ্রভুর ষড়ভুজ বিগ্রহ।
অযোধ্যাপতি রামচন্দ্রের বিশাল বিগ্রহ পূজিত
হয় এই মন্দিরে।
বড় গোস্বামী বাড়িতে ইদানীং প্রতিষ্ঠিত
হয় "শ্রীশ্রী শিবেশ্বর"। বৈশাখ
মাসের বৈশাখী পূর্ণিমায় শ্রীশ্রীরাধারমনের
ফুলদোল হয়। শ্রীশ্রীরাধারমন
জীউর "জামাই ষষ্ঠী" অনুষ্ঠান
হয়। রথযাত্রা
উৎসবও হয়। এইভাবে
বিভিন্ন উৎসব নিষ্ঠার সঙ্গে
পালিত হয় শান্তিপুরের বড়
গোস্বামী বাটীতে।
শ্রীশ্রীবংশীধারী জীউঃ
এই বংশীধারী জীউ
সম্পর্কে ইতিহাসের সন্ধান দিলেন শ্রী
সুশান্ত কুমার হালদার(মন্দিরের
সেবাইত)।শান্তিপুরের
কাঁসারী পাড়া নিবাসী ভক্তিমান
কৃষ্ণচন্দ্রনাথের একমাত্র পুত্র রাম যদু
নাথ যিনি কাঁসারী নামে
পরিচিত ছিলেন। অত্যন্ত
মেধাবী ছিলেন। ব্যবসা
সূত্রে বহু অর্থ উপার্জন
করেছিলেন এবং বহু সম্পত্তি
থাকায় ১৮৬৫সালে বহ দক্ষ কারিগর
নিয়োগ করে বংশীধারীর মন্দির
স্থাপন করেন। শকাব্দ
১৭৮৭-২০শে আষাঢ়।
দেববিগ্রহের কথা উল্লিখিত আছে। পূর্বমুখী
এই মন্দির প্রাঙ্গনের উত্তর
ও দক্ষিণে দুইটি আটচালার শিবমন্দির
আছে। মন্দিরগুলিতে
প্রাণবন্ত পোড়ামাটির মূর্তিগুলির অনুপম ভাস্কর্যের অসামান্য
নিদর্শন। শিবমন্দিরের
গর্ভে উত্তরদিকে যাদবেশ্বর ও দক্ষিণে কেশবেশ্বর
নামের কষ্টিপাথরের শিব এবং মধ্যে
বংশধারী ও রাধিকার আকর্ষণীয়
যুগলমূর্তি সদা জাগ্রত।
বংশীধারী জীউর রাস উৎসব,
দোল, জন্মাষ্টমী ইত্যাদি সমারোহে পালিত হয়।
রামযদুনাথের আরাধ্য শীলার নাম
বংশীবদন বলে অনেকেই বংশীবদন
ঠাকুর বাড়ি বা মন্দির
বলে থাকেন। বহু
নিষ্ঠার সঙ্গে আজও বংশীধারী
জীউ পূজিত হয়ে আসছেন। ঐতিহ্যের
মেলবন্ধন যেন শান্তিপুরে পাওয়া
যায়।
শান্তিপুরের বিখ্যাত সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরঃ
শান্তিপুর বৈষ্ণব ও শাক্তদের
মেলবন্ধনের পীঠস্থান। তাই
এই অঞ্চলের অন্যতম মন্দির সিদ্ধেশ্বরী
কালীমন্দির। এই
মন্দির তৈরী করা হয়
১৬০৬সালে, যা আজ প্রায়
৪০০বছর অতিক্রান্ত। তৎকালীন
রাজা ভবানন্দ মজুমদার(কৃষ্ণচন্দ্রের ঠাকুরদাদা) তিনি পার্বতীচরণ মুখোপাধ্যায়
অথবা মতান্তরে ফকিরচাঁদ মুখোপাধ্যায়কে এই মন্দিরের দায়িত্ব
তুলে দেন। এই
মুখোপাধ্যায় পরিবারের আদি পদবী ওঝা(কৃত্তিবাসের বংশধর)। এই
মন্দিরের বার্ষিক পূজা হয় দীপান্বিতায়। এছাড়া
অক্ষয়তৃতীয়া বা বিভিন্ন পূজায়
মন্দিরে দর্শনার্থীদের ভীড় দেখবার মতন। দীপান্বিতায়
দেবীকে পোলাও, খিঁচুড়ি, মাছভোগ
দেওয়া হয়, মিষ্টি, পরমান্ন,
ক্ষীর ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করা
হয়। কথায়
কথায় জানা গেল শান্তিপুরে
যে কটি কালীপূজা হয়
এই সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে পূজা দিয়ে শুরু
হয়। সিদ্ধেশ্বরী
কালীমন্দিরের সামনে নাটমন্দির তৈরী
করা হয় পরবর্তীকালে।
তৈরী করেছিলেন মালদার সরকার পরিবারের
সদস্য। আগে
সিদ্ধেশ্বরী কালীমূর্তি আগে মাটির ছিল
পরবর্তীকালে পাথরের মূর্তি করা
হয়(১৩৮৭বঙ্গাব্দে), কাশী থেকে নিয়ে
আসে হয়েছিল। সবথেকে
বিশেষ বৈশিষ্ট্য দীপান্বিতায় পূজা ১১.৪০মিনিটেই
হবে পূজা, কোনকোন সময়
যদি দীপান্বীতার সময় কিছুটি এগিয়ে
থাকে তাও রাত ১১.৪০মিনিটেই পূজা শুরু করার
রীতি রয়েছে।
শ্রীশ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বাটীঃ
শান্তিপুরের প্রাচীন মন্দিরের অন্যতম শ্রীশ্রী শ্যামসুন্দর
জীউ-এর মন্দির।
এই শ্যামসুন্দর মন্দিরের ইতিহাসের সন্ধান দিলেন শ্রী
প্রশান্ত গোস্বামী(এই পরিবারের ১৪তম
বংশপুরুষ)। কথিত
আছে অদ্বৈতাচার্য্য বলরাম আর দেবকীনন্দনের
শ্রীশ্রী রাধাশ্যামসুন্দর শ্রীবিগ্রহের প্রতিষ্ঠা কার্য স্বহস্তে করেছিলেন
এবং দেবকীনন্দনের সেই নির্দেশ মতন
এখনও বিগ্রহের সেবাপূজা হয়ে আসছে।
দোলপূর্ণিমা, ঝুলন পূর্ণিমা, জন্মাষ্টমী
এই বাড়িতে সাড়ম্বরে হলেও
এই বাড়ির বিশেষত্ব রাস
উৎসব। রাসের
তৃতীয়দিন যুগল মূর্তি বর্ণাঢ্য
শোভাযাত্রা সহকারে শান্তিপুরের পথে
নগর পরিক্রমায় অংশ নেয়।
এই বংশে শ্রীশ্রীঅদ্বৈতপ্রভুর নবম পুরুষ
আনন্দ কিশোর গোস্বামী নামে
এক পরম ভাগবত পুরুষ
জন্ম নেয়। আনন্দ
কিশোর গোস্বামী ছিলেন শ্যামসুন্দর অন্তপ্রাণ। প্রশান্তবাবুর
কথায় শ্যামসুন্দর মন্দির প্রায় আনুমানিক
৪৫০বছর প্রাচীন। শ্রীশ্রীঅদ্বৈতপ্রভুর
নাতি দেবকীনন্দন গোস্বামী এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। কথায়
কথায় জানা গেল এই
বিগ্রহের সাথে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী
খেলা করতেন, মন্দির প্রতিষ্ঠার
দিন স্বয়ং শ্রীশ্রীঅদ্বৈতপ্রভু পৌরোহিত্য করেছিলেন। রাস
উৎসবের দিন দরিদ্রনারায়ণ সেবা
হয়।এছাড়া
এই পরিবারে রাসের প্রথম দুইদিন
গুণিজনের উদ্দ্যেশ্যে সম্মান প্রদান করা
হয়। তাঁদের
মধ্যে অন্যতম জগৎগুরু কাশীর
শঙ্করাচার্য, স্বনামধন্য শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়,
শ্রীমতী হৈমন্তী শক্লা ইত্যাদি মানুষের
আগমন ঘটেছে এই পরিবারে। রাস
উৎসবের জন্য কলকাতা থেকে
সমস্ত ধরনের ফল আনা
হয়। ভোগে
থাকে পোলাও, পঞ্চব্যঞ্জন,পরমান্ন,
দই, মিষ্টি ইত্যাদি প্রদান
করা হয়। এই
পরিবারের কুলপুরোহিত ছিলেন শ্রী অমূল্য
ভট্টাচার্য্য। আজও
এই বাড়িতে নিষ্ঠার সঙ্গে
পূজিত হন শ্রীশ্রী শ্যামসুন্দর
জীউ। শান্তিপুরের
প্রাচীন মন্দিরের মধ্যে অন্যতম এই
গোপীকান্ত জীউ। শান্তিপুরের
গোস্বামী বাড়ীগুলির শ্রীকৃষ্ণ রাধিকার যুগল বিগ্রহের রাসীলীলা
অনুষ্ঠানের নগর পরিক্রমানুষ্ঠানের প্রচলনের
খাঁ বংশের পূ্র্বপুরুষ।
এই বংশের রামগোপাল খাঁর
তিন ভাই, রামজীবন, রামচরণ
ও রামভদ্র। রামচরণ
খাঁ শ্রীশ্রীগোপীকান্ত জীউ নামে কৃষ্ণ
রাধিকা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। মতান্তরে
কৃষ্ণবল্লভ(শ্রীমন্ত খাঁর দ্বিতীয় পুত্র)
এই জীউ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গোপীকান্তের
নিত্যসেবার জন্য অনুকূল চন্দ্রকে
দায়িত্ব দেওয়া হয়।
রাস উৎসব, দোল, জন্মষ্টমী
ইত্যাদি উৎসব পালিত হয়
এই মন্দিরে। আজও
নিষ্ঠার সঙ্গে পূজিত হন
শ্রীশ্রী গোপীকান্ত জীউ।
শান্তিপুরপর্বের
প্রাথমিক গবেষণায় ছিলেন শ্রীমান্ বিশ্বরূপ
বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীমান্ সৌমজিৎ মাইতি এবং
শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী। শান্তিপুরের
ইতিহাসচর্চার পর্ব ভবিষ্যৎ-এ
আরও বিস্তারিত হবে। ইতিহাসের
সাথে থাকুন, ঐতিহ্য, ধারাবাহিকতা,
মেলবন্ধন এবং সঠিক তথ্যের
অনুসন্ধান করাই বনেদীর-বনেদীয়ানা
পরিবারের মূল লক্ষ্য।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ
সমস্ত মন্দিরের সদস্যদের, পরিবারের সদস্যদের এবং শান্তিপুরের বহু
মানুষ যারা বিভিন্ন ভাবে
গবেষণায় সাহা্য্য করেছেন ।
তথ্যসূত্র
গবেষণায়ঃ শ্রীমান্ শুভদীপ রায় চৌধুরী
চিত্রঃ
শ্রীমান্ বিশ্বরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
No comments:
Post a Comment