ঠাকুর বলেছেন, "দক্ষিণেশ্বরের
ভবতারিণী, খড়দহের শ্যামসুন্দর.... এনারা সদা জাগ্রত"
"বনেদীর-বনেদীয়ানা"য় আবারও এক
ঐতিহ্যময় মন্দিরের ইতিহাস, শ্যামসুন্দর মন্দির। ইতিহাসের
খোঁজে "বনেদীর-বনেদীয়ানা" পরিবারের
সদস্যরা সবসময় নিজেদের গবেষণায়
যুক্ত। শ্যামসুন্দর
মন্দিরের ইতিহাসের খোঁজে নিয়ে এলেন
পরিবারের সদস্য শ্রীমান্ শঙ্খ।
ষোড়শ
শতাব্দীর প্রথমদিকে নিত্যানন্দ প্রভু খড়দহে বসবাস
স্থাপন করার পর খড়দহের
সমৃদ্ধির ইতিহাস শুরু হয়। নিত্যানন্দ
প্রভুর বাস হেতু খড়দহ
শ্রীপাঠ রূপে পরিচিত এবং
গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের অন্যতম তীর্থস্থান।
নিত্যানন্দের বংশধররাই খড়দহের গোস্বামী বংশ নামে পরিচিত। শোনা
যায়, নিত্যনন্দের তীরধানের পর তাঁর পুত্র
বীরভদ্র খড়দহের শ্যামসুন্দর বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। নিত্যানন্দ
মহাপ্রভু একচক্র গ্রাম থেকে
আনা তাঁদের কুলবিগ্রহ বঙ্কিমদেব,
ত্রিপুরাসুন্দরী ও অনন্তদেব শিলা
নিত্য সেবা পুজা করতেন। কথিত
আছে একই শিলা থেকে
তিনটি বিগ্রহ নির্মান হয়
-খড়দহের শ্যামসুন্দরের বিগ্রহ, শ্রীরামপুরের রাধাবল্লভজীঊর এবং সাইবোনার নন্দদুলাল
বিগ্রহ ।
শ্রী নিত্যানন্দ প্রভুর পূর্বপুরুষ বৃষকেতু
ঘোরতর তান্ত্রিক ছিলেন। ত্রিপুরা
সুন্দরীদেবী তার প্রতিষ্ঠিত।
কিন্তু বৃষকেতু পুত্র চন্দ্রকেতু পরম
বৈষ্ণব ছিলেন। তাহারই
প্রতিষ্ঠাত বঙ্কিমদেব। যে
সময়ে নিত্যানন্দ প্রভু খড়দহে বাস
আরম্ভ করেন,সেই সময়
বঙ্কিমদেব, শ্রী অনন্তদেব, ত্রিপুরাসুন্দরীদেবী
নিয়ে আসেন। সুতরাং
তিনদেবতাই নিত্যানন্দ প্রভুর পুত্র বীরভদ্র
গোস্বামী উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত।
সে সময় বীরভদ্র খড়দহ
শ্যামসুন্দর মূর্ত্তি প্রতিষ্ঠা। এবং
শ্যামসুন্দর তৈরী করেন বিখ্যাত
নয়ন ভাস্কর। ও
খড়দহ শ্রীশ্রী শ্যামসুন্দরের অভিষেক করেন অচ্যুতানন্দ
আচার্য ১৫৭৫ খ্রী: মাঘী
পূর্ণিমার দিন। বীরভদ্র
সেই সময় গোপিজন বল্লভ
ও রামকৃষ্ণ কে বঙ্কিমদেব দান
করিলেন।
খড়দহের
শ্যামসুন্দর, বল্লভপুরের বল্লভজী ও সাঁইবোনার নন্দদুলাল
রাঢ় বঙ্গের অন্যতম প্রাচীন
এবং প্রসিদ্ধ তিন বিগ্রহ।
বাংলার বৈষ্ণব ভক্ত নর-নারী বিশেষ করে
মহিলারা মাঘী পূর্ণিমার দিন
ঐ তিন বিগ্রহ দর্শন
করেন। কারন,
বীরভদ্র গোস্বামী একটি কষ্ঠি পাথর
নিয়ে এসে সেই পাথরের
খন্ড থেকে মাঘী পূর্ণিমার
দিনই ঐ তিন বিগ্রহ
প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।ইতিহাস
বলে, আগে এই তিন
বিগ্রহের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ
হতো। কলকাতার
শোভাবাজার রাজবাড়িতে তিন বিগ্রহ মিলিত
হয়েছিলেন। রাধাকান্তদেব
কর্ত্তৃক প্রকাশিত ' শব্দকল্পদ্রুম ' গ্রন্থে সে কথা লেখা
আছে।আঠারো
শতকের প্রথমদিকে বিক্রমপুর থেকে খড়দহে আসেন
রামকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় । তিনি
খড়দহের নিত্যানন্দবংশীয় গোস্বামীদের শিষ্য ছিলেন।
আঠারো শতকে কলকাতার শোভাবাজারের
রাজা নবকৃষ্ণ দেব (১৭৩২ -১৭৯৭)
একবার খড়দহের শ্যামসুন্দর বিগ্রহকে
শোভাবাজার রাজবাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
সেই সময়ই রামকৃষ্ণের পুত্র
রামনারায়ণের গানে খুশি হয়ে
নবকৃষ্ণ তাকে রাজসভার গায়ক
পদে নিযুক্ত করেন। এই
রামনারায়ণের পৌত্র আনন্দচন্দ্র খড়দহের
শ্যামসুন্দরের অন্নকূট উৎসবের গাড়ি নির্মান
করিয়ে দেন।
১৫৮৩ খ্রী: খেতুরী মহোৎসবের
হয়ে থাকে। এর
পরে নিত্যানন্দ প্রভুর স্ত্রী জাহ্নবাদেবী
যখন বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণবিগ্রহের বাম পার্শ্বে রাধিকামূর্তি
বসাবার জন্য নয়ন ভাস্কর
কে দিয়ে রাধিকামূর্তি নির্মাণ
করাচ্ছিলেন, সেই সময় খড়দহের
শ্যামসুন্দর বিগ্রহের বাম পার্শ্বে বসাবার
জন্য অষ্টধাতুর রাধিকামূর্তি নির্মান করান হয়।
তার পর থেকে খড়দহ
শ্রীশ্রী রাধাশ্যামসুন্দর বিগ্রহকে কেন্দ্র করে শুরু নানা
লীলা ও উৎসব ও
ভক্তবাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে
পড়েন। যেমন
- ফুলদোল, ঝুলন, রাস, দোল। তাই
উনিশ শতকের রুপর্চাদ পক্ষীর
(১৮১৫ - ১৮৯০) গানে দেখা
যায়,কলকাতার উত্তরে 'গুপ্ত বৃন্দাবন' খড়দহের
শ্যামসুন্দর বিগ্রহকে কেন্দ্র করে সংস্কতি ছিল
'....ঝুলন দোল নিত্য রাস
শ্রীকৃষ্ণ বিলাস। ' ওই
সব উৎসবে শ্যামসুন্দর মন্দিরের
নাটমঞ্চে বা কুঞ্জবাটী'তে
কীর্তন - কথকতা - যাত্রাগান হত। তা
ছাড়া গোস্বামী বংশের কয়েকটি বাড়িতে
দুর্গাপুজো উপলক্ষে পাঁচালি-তর্জা-যাত্রাগান হত।
খড়দহ প্রধান উৎসব রাস।উইলিয়াম
কেরীর ছেলে ফেলিক্স কেরী
ও উইলয়াম ওয়ার্ড জলপথে
শ্রীরামপুর থেকে খড়দহে প্রথম
আসেন ১৮০১ খ্রিস্টাব্দের ২০
নভেম্বর(শুক্রবার) সন্ধ্যের সময়। তাঁরা
দেখলেন, খড়দহের গঙ্গাতীরে একটি
বিশাল জায়গায় মিষ্টি বিক্রী
হচ্ছে,বাচ্চাদের খেলানা বিক্রী হচ্ছে
এবং প্রচুর লোক "Celebrete the debauchery of
Krishna"।আসলে শ্রীকৃষ্ণের(রাধা-শ্যামসুন্দর বিগ্রহের) রাসযাত্রা ও রাসমেলার জন্য
লোকের ভিড়। ওয়ার্ডের
বলে ছিলেন যে - রাসমেলার
অঞ্চলটি "Like a
race - course in England"।
কলকাতার বাবুরা নৌকা,বজরায়
করে রাসের মেলায় আসতেন। তাই
নৌকায় করে গরুর গাড়ি
চেপে বা পায়ে হেটে
দু'তিন আগে খড়দহে
পৌছতেন। ওই
যাত্রীরা এলাকার বাগান বাড়িতে
থাকতেন। শ্রীরামপুর,
কোননগর,রিষড়া আঞ্চল থেকেও
মানুষজন ওই সময় এখানে
সমবেত হতেন। তখন
রাসখোলায় ফেরীঘাট ছিল। রাসখোলা
ফেরী ঘাটে রাসের ক'দিন পানসি নৌকা,
বাইচ ও অন্য জলযানের
ভীর থাকত। ১৮২২
খ্রী: লোকনাথ ঘোষ স্টেটস্ম্যান
পত্রিকায় ফেরীঘাটর ভীড় ও পুলিশ
কর্তার ভীর সামাল দেওয়া
সংক্রান্ত বিষয়ে কটাক্ষ পূর্ণ
চিঠি টি সাক্ষী হয়ে
আছে। (100 years ago The Statesman
1982)। খড়দহ বড়াল বাগানে
ঘোরানো মঞ্চ ছিল।
সেখানে গানের আসর বসত। মেলায়
চীনারা জুয়ার বোর্ড বসাতেন। এলাকার
মানুষজন কেনাকাটা করার ও রং
তামাসা দেখার জন্য ভীর
জমাতেন।রাসের
চতুর্থ দিনে যে বিরাট
ভোগ (খিচুরি লুট) উৎসব
পালিত হয় তাহা প্রথম
শুরু করের নিত্যানন্দপ্রভুর দশম
বংশধর কেশবকৃষ্ণ গোস্বামী।।সেকালে
খড়দহ শ্রীশ্রী রাধাশ্যামসুন্দরের ফুল দোল ও
ছিল বিখ্যাত। ১৮৬৩
সালে ফুল দোল উপলক্ষে
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে প্রায়
১০ হাজার যাত্রী সোদপুর
স্টেশনে এসেছিলেন।
খড়দহে
বিখ্যাত তান্ত্রিক সাধক প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাস
তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত ১২টি
মন্দিরের সঙ্গে নিজে এখানে
আরও ১৪টি মন্দির নির্মাণ
করিয়েছিলেন। তিনি
আশি হাজার শালগ্রাম শিলা
ও কুড়ি হাজার বাণলিঙ্গ
শিবের একটি 'রত্নবেদী' প্রতিষ্ঠা
করতে চেয়েছিলেন। তাঁর
অকাল প্রয়াণের পর থেকে এখনো
জরাজীর্ণ অট্টালিকার অন্ধকার কক্ষে এই হাজার-হাজার শিলামূর্তি ছোট
জৈন মূর্তির সাথে পূজিত হয়। তিনি
জীবদ্দশায় প্রাণতোষিণীতন্ত্র, বৈষ্ণবামৃত, বিষ্ণুকৌমুদী, শব্দকৌমুদী, ক্রিয়াম্বুধি প্রভৃতি গ্রন্থ সংকলন করে
বিনামূল্যে জনসাধারণের কাছে বিতরণ করেছিলেন।
কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ শ্রীযুক্তা নন্দিনী বসাক
তথ্যসংগ্রহেঃ শ্রীমান্ শঙ্খ
No comments:
Post a Comment